প্রবন্ধ – মহাজীবনের সুরধ্বনী

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

জগতের যত ক্লান্ত প্রাণ, অবাঞ্ছিত মোহ যন্ত্রনায় আবদ্ধ হয়ে আছে পরাধীনতা ও কূপমন্ডুকতার নাগপাশে। আপনার আপন কে হারিয়ে তারা বদ্ধ হয়ে আছে দূরবর্তী মোহলিপ্সায়। নিজেকে ঢেকে রেখেছে অনিত্যের শৃঙ্খলে। সতত বন্দী তারা ধ্বংসের নিগঢ়ে। মায়াবিভ্রমে বন্দী আত্মা গুলো আজ তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। হারিয়ে ফেলেছে তাদের আত্মিক তেজ। আত্মা আজ তাদের বলহীন। আত্মার অনাত্মীয় যারা, তাদের প্রবল আক্রমণে আজ দিশেহারা এই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত আত্মাগুলো। অবস্থা তাদের “কাহি মৃতবৎ”। চারিদিকে তাদের বিরাজ করছে যুগপৎ অন্ধকার। মানুষগুলো সংস্কারের অতলে হারাতে হারাতে ভূলে গেছে তাদের নিজস্ব আবাসের কথা। আর স্বরণ হচ্ছে না। আত্মার শত্রুগন এই সুযোগে সর্বস্ব হরণ করে নিচ্ছে তাদের। আত্মার অনাত্মীয় যারা তথা যারা প্রাণের প্রবল শত্রু, যারা কুমন্ত্রনা দেয় একদম ভিতর থেকে, তারই মারপ্যাচে আজ দিশাহারা এরা। ধ্বংসের অতলে নিমজ্জিত মানবগণ। চির তেজোদ্দীপ্ত মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়ে মানব সম্প্রদায় আজ ধুকে ধুকে মরছে। আশার আলো অতি ক্ষীণ।

মানুষ হলো পরম মহিমাময় সত্ত্বার চির প্রেমোন্মত্ততার পূর্ণাঙ্গ এবং প্রস্ফুটিত রুপ। মানব মোহনাতে পূর্ণাঙ্গ রুপে নিজেকে প্রকাশিত করে তোলেন পরম প্রভু। মহান স্রষ্টার অঙ্গ হতে সরাসরি মানুষ প্রেমলীলা প্রকাশের নিমিত্তে আগমন করছে ধরাধামে। আগমন করছে প্রতিনিয়ত। মানব তরীতে স্থান নিয়ে প্রভু উপভোগ করছেন জগতের লীলাবৈচিত্র। প্রভুর অনন্ত অখন্ড চির নিত্য শাশ্বত জাতরুপ থেকে মানুষ ধীরে ধীরে, সুরে সুরে প্রকটিত হচ্ছে সুরময় এ অনন্ত প্রেমের অমর লোকে। প্রেমলীলা উপভোগ করবেন বলে। শিশুর মতো জগতের প্রেমখেলায় নিজেকে শামিল করবেন বলে। প্রেমলীলা সমাপনান্তে তিনি আবার মিলিয়ে যাচ্ছেন অনন্তে।

প্রেম লীলা বৈচিত্রের এ জগতে যে আত্মা সমূহ স্থিত রয়েছে স্বীয় স্বকীয়তায়, ধরে রেখেছে নিজেকে, হারিয়ে যেতে দেয়নি – তারাই টিকে আছে মহাকালের এ চিরন্তন খেলায়। তারাই জগতের পূর্ণ মানব, পূণ্যাত্মা। তারাই জগতের মূলাধার। তারাই প্রভুর মূর্তরুপ। তাদের মানব মানস গগনের এক জ্যোতির্ময় কুঠরী স্থান নিয়ে মহাপ্রভু বসে আছে মহাকালের সাক্ষী হয়ে। তারাই প্রভূময়। তারাই “অমৃতস্য পূত্র”। তারাই মহাত্মা, মহামানব। তাদেরই শ্রী চরণে প্রতিনিয়ত পূজা পূষ্পসম উৎসর্গীকৃত হয় এ জগত।

আর যারা নিজেকে ভূলে আছে, বিস্বরণ হয়ে আছে আপনার মহত্ত্বকে, তারাই ধ্বংসের পথের পথিক। ‍মোহমায়া, বিষয়জ্বালা তথা সংস্কার সমুদ্রে ডুবে যারা ত্যাগ করেছে নিজস্ব স্বকীয়তাকে, তারাই হবে ধ্বংসপ্রাপ্ত। আপনত্বকে ভূলে যাওয়া তথা চেতনা কে ভুলে যাওয়ার শাস্তি স্বরুপ তারা নিমজ্জিত হবে চির অন্ধত্বের জগতে। মায়াঘুমে মত্ত যারা, তারা চিরকালের জন্য বঞ্চিত করছে নিজেদেরকে। সংস্কারের অতলে যাদের বাস, তারা অনিত্যকালে বন্দী। নিত্যের তথা শাশ্বত অমর প্রেমের ধামের আনন্দ তারা কোনদিনই লাভ করতে পারবে না। তারা ভূলে গেছে মহাপ্রেমের ওয়াদা। তারা মূলচ্যূত বিটপী সম ভেসে যাচ্ছে নিরুদ্দেশের অজানা স্রোতে। কোথায় তাদের গন্তব্য তা তারা নিজেরাও জানে না। তারাই জন্ম পরিচয় হীন। তাদের গতি অবশ্যই ধ্বংসের দিকে।

এই মানুষের হৃদয় কমলে স্থান নিয়ে মহাপ্রভু সকলকে বিলিয়ে যাচ্ছেন প্রেমের অমৃত সুধা। জগতের যত মৃত্যু পথের পথিক, যারা নিজের অজান্তেই ধেয়ে চলেছে অন্ধ মৃত্যুকূপের পানে – তাদেরকে তিনি বিলিয়ে যাচ্ছেন চির জীবনের আবহায়াত। মানুষ কে অমর করে তুলতে তথা শাশ্বত প্রেমের সন্ধান দিতে প্রভু স্বয়ং মানব মোহনায় বসে সকল মানবকে দিয়ে চলেছেন এ আবহায়াত। মানুষপ্রেমিক পরম সত্ত্বা মানুষকে ভালোবেসে কাওসারের পেয়ালা হাতে ঘুরছেন মানুষের দুয়াড়ে দুয়াড়ে। স্বয়ং জীবন বাদ্য হাতে নিয়ে অবিরাম বাজিয়ে চলেছেন মহাজীবনের সুর। যে সুরে নিজেকে শামিল করলে মানুষ সীমাবদ্ধ এ জীবন থেকে নিজেকে উত্তোরিত করতে পারবে মহাজীবনে। স্বয়ং প্রভু মানুষকে মানবী জান্নাতের খোঁজ জানাতে মানব বোধির দ্বারে দাড়িয়ে আছেন। জ্ঞান দরজায় তিনি প্রহরী হয়ে মানুষকে জাগ্রত রেখে চলেছেন চিরকাল ধরে।

যদি খুলে যায় মানুষের অজ্ঞানতার নাগপাশ, যদি মানুষ ফিরে পায় তার চেতনা, তবেই সে ফিরে আসবে সকল মায়াবিভ্রম ত্যাগ করে মহান প্রভুর সমীপে। তবেই প্রভুর জগত বাসনা হবে পূর্ণ। মানুষ আপনত্বে প্রভুকে ধারণ করে প্রভুময় হয়ে অধিষ্ঠিত হবে চিরকালে। অমর প্রেমের লোকে। মানুষ; মানুষ হয়ে পূর্ণ করবে সে অপূর্ণ চেতনাকে। স্থিত হবে মানবী জান্নাতে।

যে মানুষটি জাগতিকতা থেকে তথা পার্থিব মোহমায়া তথা বিষয়জ্বালা থেকে বেড়িয়ে আসে সংস্কারের দেয়াল থেকে, সেই হয় মুক্ত মানুষ। সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ তথা আশরাফুল মাখলুকাত। হৃদয় টাকে যারা আবদ্ধ রাখে সংষ্কারের মোহরাশির নোংরামী দ্বারা, সে নোংরা হৃদয়ে প্রভুর নূর প্রতিফলিত হয় না। আর যারা মানুষ গুরু তথা পথ প্রদর্শকদের দেখানো পথে সাধনার মাধ্যমে পরিষ্কৃত করে তোলো আপন হৃদয়টাকে, সেই পবিত্র হৃদয়েই প্রতিবিম্বিত হয় মহান জাতপাকের তাজাল্লী। সেই তাজাল্লীর আলোকমহিমায় তখন সে খুঁজে পায় চিরকালের শাশ্বত পথ। প্রভুর পথ। তখনই তার কর্ণগহ্বরে নিয়ত বেজে চলে প্রভূর আহ্বান। সেই আহ্বানের সুরে সুর মিলিয়ে সে অনন্তের পথিক শুরু করে তার পথচলা। অমৃতের পথে। মুক্তির পথে। ভালোবাসার পথে। ঐশী প্রেমের পথে।

রচনাকাল – 16/02/2019
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর