জীবনী – বিখ্যাত অলী মালেক ইবনে দীনার (র) এর জীবনী

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

পতিত মানব জাতিকে পথ প্রদর্শনের নিমিত্তে যুগে যুগে এ ধরাধামে আগমন করেছেন অসংখ্যা পূণ্যাত্মা। তাদেরই একজন হলেন হযরত মালেক ইবনে দীনার (র)। খাজা হাসান বসরী (রা) এর সমসাময়িক ছিলেন তিনি। অত্যন্ত উচ্চমানের সাধক ছিলেন তিনি।

আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশ

দামেস্ক শহরে বাস করতেন মালেক ইবনে দীনার (র)। সুন্দর চেহারার অধিকারী ছিলেন তিনি এবং তাঁর ছিল অঢেল সম্পত্তি। তরুণ বয়সে একবার তিনি মনে মনে ফন্দি আটলেন, শহরের এক মসজিদে পুরো একবছর এতেকাফ করবেন তিনি, যাতে সকলের আস্থাভাজন হতে পারেন এবং পেয়ে যান মসজিদ এবং মসজিদ সংক্রান্ত ভূমিসমুহের রক্ষকের দায়িত্ব! মসজিদে প্রবেশ করে তিনি মগ্ন হলেন এবাদতে। কোনো এক রাত্রে মসজিদের বাইরে যেতেই শুনতে পেলেন দৈববাণী। আকাশবাণীতে তাকে বলা হলো, “হে মালেক, আল্লাহর দরবারে এখনো তুমি তওবা করছো না কেনো?” বিচলিত হয়ে পড়লেন মালেক ইবনে দীনার (র)।

বুঝতে পারলেন নিজের ভুল। তিনি তো প্রকৃত আল্লাহপ্রেমে উপাসনায় লিপ্ত হননি। অন্তরের কপটতাকে ঘৃণা হলো তাঁর। অনুতপ্ত হৃদয়ে তওবা করলেন। প্রকৃত আল্লাহপ্রেম জাগ্রত হলো তাঁর হৃদয়ে। এবার সত্য সত্যই তিনি উপাসনায় মগ্ন হলেন। অন্তরে বাহিরে খোদাপ্রেমের এক অভূতপূর্ব অনুভূতি অনুভব করলেন। পার্থিব লালসা আর রইলো না তাঁর।

পরের দিনই মুসল্লিগণ বলাবলি করতে লাগলেন, এ এলাকার একজন মুতাওয়াল্লী (রক্ষক) নিয়োগ দেয়া দরকার। এ কাজের জন্য মালেক ইবনে দীনার (র) ই বিশেষ উপযুক্ত ও বিশ্বস্ত ও বটে। ততক্ষনে পুরো বদলে গেছে মালেক ইবনে দীনার (র) এর মন। তিনি আল্লাহপ্রেমে প্রকৃত উপাসনায় যে স্বাদ পেয়েছেন, আর তিনি কোথাও যেতে চান না। ফিরিয়ে দিলেন সকলের প্রস্তাব। নিয়োজিত হলেন উপাসনায়।

‘দীনার’ নামকরণ

পার্থিব জীবনের উর্দ্ধে তিনি স্থান দিয়েছিলেন ধর্ম জীবনকে। একবার তিনি নৌকায় কোথাও নদী পার হচ্ছিলেন। মাঝনদী পার হওয়ার পর মাঝি খেয়ার ভাড়া চাইল। কিন্তু মালেক ইবনে দীনার (র) এর নিকট কোনো পয়সা ছিল না। তিনি বিনীতভাবে মাঝিকে বললেন, তার কাছে কোনো টাকা নেই। কিন্তু মাঝি টাকার দাবি ত্যাগ করলেন না।

উত্তেজিত হয়ে উঠলো মাঝি। পারের টাকা তাকে দিতেই হবে। রুঢ় এবং অত্যন্ত বাজে ব্যাবহার করতে শুরু করলো সে মালেক ইবনে দীনার (র) এর সাথে। প্রচন্ড রাগের সাথে মাঝি মালেক ইবনে দীনার কে মারতে শুরু করলেন তিনি। একপর্যায়ে মালেক ইবনে দীনার (র) কে মাঝ নদীতে ফেলে দেওয়ার জন্য তেড়ে এলেন মাঝি। এমন সময় দেখা গেলো নদীর ভেতর অসংখ্য মাছ মুখে একটি করে দীনার (টাকা) নিয়ে ভেসে উঠেছে। মালেক ইবনে দীনার (র) সেখান থেকে একটি দীনার উঠিয়ে নিয়ে মাঝি কে দিলেন। এ ঘটনা দেখে দারুণভাবে অনুতপ্ত হলেন মাঝি। পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন তিনি। এ ঘটনা টি থেকেই মালেক ইবনে দীনার (র) এর নামের সাথে দীনার কথাটি যুক্ত হয়ে পড়ে।

সাধনা ও ধর্মজীবন

কঠোর তপস্বী ছিলেন হযরত মালেক ইবনে দীনার (র)। প্রভূপ্রাপ্তির পথে কাটিয়েছেন তাঁর সারা জীবন। উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন একজন আউলিয়া তিনি। সারাজীবন প্রবৃত্তি তথা নফসের সাথে করেছেন কঠোর সংগ্রাম। তার জীবনে রয়েছে অসংখ্যা অলৌকিক ঘটনাবলির সমাহার। অগনিত মানুষকে সত্য সুন্দরের পথপ্রদর্শন করেছেন তিনি।

অন্তিম জীবন

দীর্ঘ জীবন স্রষ্টার পথে ব্যায় করে প্রভূ স্বানিধ্যে গমন করেন মালেক ইবনে দীনার। কথিত আছে, মালেক ইবনে দীনারের ইন্তোকালের পর এক ব্যক্তি তাকে স্বপ্নে দেখলেন। ব্যক্তিটি মালেক ইবনে দীনার (র) কে জিজ্ঞেস করলেন, “আল্লাহর দরবারে আপনি কেমন ব্যবহার পাচ্ছেন?” মালেক ইবনে দীনার (র) উত্তরে বললেন, “আমি পাপী। তবে আমার মধ্যে বিশ্বাস ছিল বলে আল্লাহ আমাকে মুক্তি দিয়েছেন।”

কয়েকটি উপদেশ বাণী

১. এ যুগের বন্ধুত্বে রয়েছে কপটতা। প্রত্যেকের বাইরের দিকটা সুন্দর আর ভেতরটা বিশ্রী। এমনকি আলেমগণের অন্তর আলো কলুষিত।

২. দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করো। নিজে বাঁচো। অন্যকে বাঁচার পথ দেখাও।

৩. ঐ লোকের অল্পজ্ঞান এবং হৃদয় অন্ধ, যে আল্লাহর ধ্যান-জ্ঞান, সাধনা ও প্রার্থনার চাইতে দুনিয়ার বা পার্থিব আলাপকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

৪. আল্লাহপ্রাপ্তির উদ্দেশ্য নিয়ে ধৈর্যের সাথে তাঁর পথে অগ্রসর হোন।

৫. আল্লাহ বলেন, দুটি প্রতিশ্রুতি যা আমি জিব্রাইল মিকাইলকেও দিইনি, তা আমি উম্মতে মোহাম্মদী কে দান করেছে। তার একটি হলো, তোমরা আমাকে স্বরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্বরণ করবো, আর একটি হলো, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি সঙ্গে সঙ্গে ডাকের জবাব দিবো।

৬. যে সব সময় প্রবৃত্তির অনুগত, শয়তান তার কাছে বেশি যাতয়াত করে না। কারণ, সে নিজেই তো স্বয়ং শয়তান।

৭. যে তোমার সেবা করছে, তার সেবায় সন্তুষ্ট থাকো। তাহলেই আখিরাতে মুক্তি পাবে।

রচনাকাল – 16/08/2018
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর