পত্রিকা – রঁওযা বা মাজার জিয়ারত ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী

রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযায় গিয়ে কিভাবে মুনাজাত করবে সে সম্পর্কে “সিফাউস সেকাম” কিতাবের ৪৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, আবু মনছুর মুহাম্মদ ইবনে মোকাররম করমানী তাঁর “মনাসেক”-এর মধ্যে এবং আবদুল্লাহ ইবনে মাহ্মুদ “শরহুল মুখ্তার” কিতাবের মধ্যে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা দিয়েছেন এবং “ফাতাওয়া আবুল লাইস সমরকন্দী”- এর মধ্যে হাসান ইবনে যিয়াদের রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি বলেছেন, “হাজীদের এটাই উত্তম যে, প্রথমে সে মক্কায় যাবে। সেখানকার আরকান (কার্যসমূহ) আদায় করার পর মদিনায় যাবে। আর যদি প্রথমেই মদিনা হয়ে আসে, তবে সেটাও জায়েজ। মদিনায় পৌঁছে রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের পবিত্র রঁওযায় যাবে। কেবলা এবং রঁওযার মাঝখানে এমনভাবে দাঁড়াবে যে, তার মুখ রঁওযার দিকে থাকবে। এরপর হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের উপর ছালাত ও ছালাম পড়বে এবং হযরত আবু বকর এবং ওমরের উপরও ছালাম পড়বে এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করবে।

আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আস্ সাম্রী আল্ হাম্বলী তাঁর কিতাব “আল্ মুস্তাওয়াব”- এর মধ্যে বলেছেন, “যখন মদিনাতুর রাছুলে উপস্থিত হবে, তখন তার জন্যে মুস্তাহাব কাজ হচ্ছে, মদিনায় প্রবেশের সময় গোসল করা। তারপর মসজিদে নব্বীতে যাবে এবং প্রবেশের সময় প্রথমে ডান পা প্রবেশ করাবে। এরপর রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারকের দেয়ালের নিকটে পৌঁছে এমনভাবে দাঁড়াবে যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারক সামনে থাকবে এবং কেবলা থাকবে পিছনের দিকে, আর নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের মিম্বর থাকবে বাম দিকে। তারপর ছালাত, ছালাম পড়বে এবং নিজের জন্য দোয়া করবে। এরপর এটাও যেন বলে, তুমি তোমার কিতাবে বলেছ, “সুম্মা জাউকা ইয়াহলেফূনা, বিল্লাহে ইন্ আরাদ্না ইল্লা ইহসানাও ওয়া তাওফিকান্”। অর্থাৎ অতঃপর তারা তোমার নিকট এসে আল্লাহর নামে শপথ করবে (এবং বলবে) আমরা তো সম্প্রীতি এবং সুন্দর ব্যতীত অন্য কিছুই ইচ্ছা করিনি (সুরা আন নিসা-৬২ আয়াত)। “ওয়া লাও আন্নাহুম ইজ্জালামু আন্ফুসাহুম্ জাউকা ফাস্তাগ্ফারুল্লাহা ওয়াস তাগ্ফারা লাহুমুর রাছুলু। লাওয়াজাদুল্ লাহা তাওয়্যার্বা রাহিমান্”। এবং যদি তারা তাদের নফসের উপর জুলুম করে এবং তোমার নিকট ফিরে এসে (এবং) আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং রাছুলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন তা হলে তারা আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল (এবং) পরম রাহিম (দয়ালু) রূপে পাবে (সুরা আন-নিসা- ৬৪ আয়াত)। এবং বলে, “এখন আমি তোমার নবীর নিকট মাগফেরাত চাওয়ার জন্য উপস্থিত হয়েছি এবং তোমার নিকট আবেদন করছি, অতএব তুমি তোমার মাগফেরাত আমার জন্য ছাবিত করে দাও, যেভাবে তুমি তাদের জন্য মাগফেরাত ছাবিত বা পুরা করে দিয়েছ যারা তাদের জীবদ্দশায় মাগফেরাতের জন্য এসেছে। হে আল্লাহ! আমি তোমার নবীর উছিলা দিয়ে তোমার দিকে মুতাওয়াজ্জাহ (মুখ ফিরিয়েছি বা উপস্থিত) হয়েছি। তারপর যখন ফিরে আসার ইচ্ছা করবে তখন আবারও নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের পবিত্র রঁওযা মোবারকে উপস্থিত হয়ে তাঁর নিকট হতে বিদায় নিবে”। তাছাড়া লোক মারফত মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের নিকট (রঁওযা মোবারকের নিকট) ছালাম পৌঁছানোর নিয়মও শরিয়ত সম্মত বলে সাব্যস্ত আছে। যেমন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ শাম (সিরিয়া) থেকে শুধু নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওয়া মোবারকে ছালাম পেশ করার জন্য কাসেদ (বাণী বাহক) পাঠাতেন। এ কাজ শুধু ছালামের উদ্দেশ্যেই করা হতো।

কাজী আয়ায তাঁর “আশ্ শিফা” কিতাবের মধ্যে সনদসহ উল্লেখ করেছেন যে, খলিফা আবু জাফরের সঙ্গে হযরত ইমাম মালেক রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির মসজিদে নব্বীতে কথাবার্তা হলো। ইমাম মালেক রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি বললেন, “আমিরুল মুমিনীন, এ মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলবেন না। কারণ, আল্লাহপাক বলেছেন, “ইয়া আইয়্যুহাল্লাজীনা আমানু লা তারফা’উ আসওয়াতাকুম্ ফাওক্বা সাওতিন্ নাবিয়্যি ওয়ালা তাজ্বহারু লাহু বিল্ক্বাওলি কাজ্বাহ্রি বা’দ্বিকুম্ লিবা’দ্বিন আন্ তাহ্বাত্বা আ’মালুকুম্ ওয়া আন্তুম লা তাশউরূন” অর্থাৎ হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বরকে নবীর কণ্ঠস্বরের উপর উঁচু করো না, তোমরা একে অপরের ন্যায় তাঁর সঙ্গে উচ্চঃস্বরে কথা বলো না; এতে তোমাদের আমল তোমাদের অজান্তেই নিস্ফল হয়ে যাবে। (সুরা হুজরাত-২ আয়াত)। এবং প্রশংসা করে বললেন, “ইন্নাল্লাজীনা ইয়াগুদ্বদ্বুনা আসওয়াতাহুম্ ইন্দা রাছুলিল্লাহি উলাইকাল্ লাযীনাম্ তাহানাল্লাহু কুলুবাহুম লিত্তাকওয়া; লাহুম্ মাগ্ফিরাতুও ওয়া আজ্বরুন্ আজীম্” অর্থাৎ নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর রাছুলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য বিশুদ্ধ করে দিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে বিরাট ক্ষমা ও মহা প্রতিদান (হুজরাত-৩ আয়াত)। এবং যারা উচুঁ স্বরে ডাকে তাদের নিন্দা করতে গিয়ে বলেছেন, “ইন্নান্লাজীনা ইউনাদূনাকা মিও ওরাইল হুজুরাতি আক্ছারুহুম লা ই’য়াকিলূন” অর্থাৎ নিশ্চয়ই যারা আপনাকে হুজরার বাহির হতে চিৎকার করে আহ্বান করে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ। (হুজরাত-৪ আয়াত)।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামকে এহতেরাম করা যেভাবে তাঁর জীবদ্দশায় জরুরী ছিলো তাঁর ওফাতের পরও সেভাবেই জরুরী রয়েছে। একথার পর খলিফা আবু জাফর লজ্জিত হয়ে গেলেন এবং বললেন, “হে আবু আবদুল্লাহ! আমি কেবলার ইস্তেক্বাল করার পর (স্বাগত জানানোর পর) হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারকের নিকট দোয়া করবো বা স্বাগত জানাবো”। ইমাম মালেক রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি বললেন, “হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারক হতে কেনো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ যখন রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের পবিত্র জাত তোমার এবং তোমার পিতা হযরত আদম আলায়হিস সালামের কেয়ামতের দিন আল্লাহর জন্যে উছিলা হবে? তাঁর দিকে মুখ করো এবং তাঁর মাধ্যমে শাফায়াত কামনা করো। আল্লাহপাক তার শাফায়াত কবুল করবেন। আল্লাহপাকের নির্দেশ রয়েছে, “ওয়ামা আরসালনা মির রাছুলিন্ ইল্লা লেইউতাআ বেইজ্নিল্লাহ” অর্থাৎ এবং আমরা রাছুলগণকে এ জন্যে পাঠিয়েছি যে, তাঁরা আল্লাহর জন্য নির্দেশ (হুকুম) অনুসারে তার আনুগত্য করবে। “ওয়া লাও আন্নাহুম্ ইজ্জালামু আনফুসাহুম জাউকা ফাস্তাগ্ফারুল্লাহা ওয়াস্ তাগ্ফারা লাহুমুর রাছুলু” অর্থাৎ এবং যদি তারা তাদের নফসের উপর জুলুম করে এবং তোমার নিকট ফিরে আসে (এবং) আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং রাছুলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। “লাওয়াজাদুল্ লাহা তাওয়্যার্বা রাহিমান” অর্থাৎ তা হলে তারা আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল (এবং) পরম রাহিম (দয়ালু) রূপে পাবে (সুরা নেসা-৬৪ আয়াত)।

মাজার জিয়ারত করা হলো সুন্নাত। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম, আওলাদে রাছুলগণ এবং সাহাবায়ে কেরামগণ মাজার জিয়ারত করেছেন এবং মাজার জিয়ারতের হুকুম করেছেন। রাছুল করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম প্রথম দিকে মুসলমানদের আলাদা কবরস্থান না থাকায় এবং আল্লাহর হুকুম না পাওয়ায় কবর বা মাজার যিয়ারত নিষেধ করেছিলেন। (সাহাবাগণ কামালতধারী বিধায় তাঁরা আল্লাহর অলি এবং তাদের সমাধিগুলো হলো রঁওযা বা মাজার)। কিন্তু পরবর্তীতে মুসলমানদের পৃথক কবরস্থান যখন হলো, তখন জিয়ারতের হুকুম দিলেন। সাধারণ মানুষের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্য হলো তাদের নফসের মাগফেরাত কামনা করা এবং এ উদ্দেশ্যেই দান খয়রাত করা। আর তাতে জিয়ারতকারীর দীল নরম হয়, চোখে অশ্রু ঝরায় এবং পরকালকে স্মরণ করায়। আর আল্লাহর অলির মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্য হলো তাদের সাথে আত্মিক নিছবত ও ফায়েজ বরকত লাভ করা, এবং অলিগণের উছিলা দিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা। তাতে স্বীয় মকসুদ আল্লাহপাক তাঁর অলির উছিলায় পূর্ণ করেন এবং এ উদ্দেশ্যেই ওরশ শরীফ পালন করা হয়।

এ সম্পর্কে কতিপয় দলিল পেশ করা হলো –

১। নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বলেছেন, “আমি তোমাদেরকে প্রথম দিকে কবর জিয়ারত নিষেধ করছিলাম। এখন তোমরা জিয়ারত করো। কেননা, কবর জিয়ারত কলবকে নরম করে, চোখে অশ্রু ঝরায় এবং পরকালকে স্মরণ করায় (মুসলিম শরীফ, মেশকাত শরীফ ও বায়হাকী শরীফ)।
উক্ত হাদিসের আরবী এবারতে “ফাজুরুহা” একটি শব্দ রয়েছে এবং এর দ্বারা কবর জিয়ারতের হুকুম করা হয়েছে বিধায় জিয়ারত সুন্নত প্রমাণিত হলো। আর এ হুকুম নারী-পুরুষ সবার সাধারণ ভাবে জন্যে প্রযোজ্য। কারণ, অবস্থা বিশেষ মেয়েদের শর্তও জড়িত হতে পারে, যদি সমস্যা থাকে। কবর বা মাজার জিয়ারত সুন্নত হলে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফরও অবশ্যই সুন্নত হবে এবং এ হুকুম “জা’আল হক” এবং “আহকামুল মাজার” কিতাবে বিধৃত আছে। কবর জিয়ারতের হুকুম নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম হুকুম দিয়েছেন অথচ তার জন্যে সফরের হুকুম দিবেন না এ ধরনের অবাস্তব নির্দেশ রাছুল করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের দ্বারা কখনো সম্ভব নয়। আজমীর শরীফ, বাগদাদ শরীফ বা অন্যান্য দূরবর্তী মাজার সমূহ সফর ব্যতীত জিয়ারত সম্ভব নয়। কাজেই জিয়ারত ও সফর উভয়ই হলো সুন্নত। উক্ত হাদিসে জিয়ারতের সাথে অবশ্যই সফর কথাটাও বৈধ প্রমাণিত।

২। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা বর্ণনা করেছেন, “নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম শেষ রাত্রে মদীনা শরীফের “বাকিউল গারকাদ” বা জান্নাতুল বাকী নামক কবরস্থানে গমন করে স্বীয় পরিজনদের মাজার জিয়ারত করতেন। তিনি পরলোকগত সাহাবীগণকে এভাবে ছালাম দিতেন এবং দোয়া করতেন, “হে পরকালের মুমিন বান্দাগণ; তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। তোমাদের সাথে কৃত ওয়াদা তোমরা আগামীতে পেয়ে যাবে। তোমরা আমাদের পূর্বে গমন করেছ। আমরাও ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই তোমাদের সাথে মিলিত হবো। হে আল্লাহ! বাকিউল গারকাদ কবরস্থানের বাসিন্দাদের তুমি ক্ষমা করে দাও” (মুসলিম শরীফ)।

৩। ১০ হিজরীতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম একলাখ চব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মক্কায় হজ্জ করতে আসলেন, তখন একদিন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহাকে সাথে নিয়ে জান্নাতুল মোয়াল্লা’তে (পূর্বনাম “হাজুন”) হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহার মাজার জিয়ারত করতে গেলেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা গাধার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম জিয়ারত কালে প্রথমে খুব কাঁদলেন, পরে হাসলেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা এর কারণ জানতে চাইলে হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বললেন, “আমার পিতা-মাতাকে আল্লাহপাক জীবিত করে আমার সামনে হাজির করলেন। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করে পূনরায় ইন্তেকাল করলেন। আমি পিতা-মাতাকে দেখে খুশী হয়েছি”। এ ঘটনাটি ইমাম সোহায়লীর বরাত দিয়ে আল্লামা ইবনে কাসির তার বিখ্যাত কিতাব “আল বেদায়া ওয়ান নেহায়ার” মধ্যে বিধৃত করেছেন।

যেহেতু রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম খাতামুন আম্বিয়া, সাইয়্যেদুল মুরছালীন, রাহমাতাল্লিল আলামীন তাই তিনি তাঁর আলে রাছুল সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম এবং সাহাবাগণের মাজার জিয়ারত করে তাদের জন্য দোয়া করেছেন এবং সমস্ত সৃষ্টিই তাঁর রহমতের প্রত্যাশী; তিনি হলেন রহমতের বন্টনকারী। তাই রাছুল করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারক জিয়ারতের সময় নবীজির জন্য দোয়া করা চরম বেয়াদবী ছাড়া কিছুই নয়, যা মুনাফেক ওহাবীগণ করে থাকে। সমস্ত মানুষকেই রাছুল করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারক জিয়ারত করার সময় তাঁর নূরী ফায়েজ বরকত ও দয়া পাওয়ার আকাক্সিক্ষত থাকতে হবে আজিজি, নম্রতা ও আদবের মাধ্যমে। নবুয়তে যাদেরকে নবী-রাছুল বলা হয়, বেলায়েতে তাদেরকেই বলা হয় অলি- আউলিয়া। বিধায় ঠিক তেমনি, আল্লাহর অলিদের মাজার জিয়ারতের সময়ও আদব-নম্রতার মাধ্যমে তার নিছবত ও ফয়েজ বরকত কামনা করতে হবে। বেআদবের মত তাদের জন্য শুধু দোয়া করা উচিত নয়। কোরানে বলা হয়েছে, “ওয়ালিল্ললাহি ইজ্জাতো ওয়া লি রাছুলিহি ওয়ালিল মুমিনীনা ওয়া লাকিন্নাল মুনাফেকিনা লাইয়া লামুন” অর্থাৎ এবং সম্মান আল্লাহর জন্য এবং রাছুলের জন্য এবং মুমিগণের জন্য কিন্তু মুনাফেকগণ তা বুঝে না। আত্মশুদ্ধি ও আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে যিনি আল্লাহকে চিনেছেন তিনিই মুমিন তথা ইনছানি আত্মার অধিকারী ব্যক্তিই হলেন মুমিন। কাজেই মুমিনকে যারা আমানু বা মুত্তাকী বা সাধারণ মানুষের মতো ধারণা করে বা তাদের মর্যাদার সমান মনে করে কোরানুল কারিমে তাদেরকে মুনাফেক বলা হয়েছে।

৪। হযরত মাওলা আলী ইবনে আবি তালিব আলায়হিস সালাম তাঁর মাতা হযরত ফাতেমা বিনতে আসাদ রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহার ওফাতের পর রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম তাঁর লাশ কবরে রেখে দোয়া করলেন, “আল্লাহ জীবিত করেন এবং মৃত্যু দান করেন। তিনি চিরঞ্জীব, কখনো মরেন না। হে আল্লাহ, আমার মা ফাতেমা বিনতে আসাদকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর প্রবেশ পথ প্রশস্ত করুন, আমার এবং আমার পূর্ববর্তী সকল নবীর উছিলায়। নিশ্চয় আপনি সর্বাধিক দয়ালু।” সেখানে হযরত আব্বাস ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুম ও সঙ্গে ছিলেন।

৫। ফতোয়ায়ে শামীর প্রথম খন্ডের “জিয়ারাতুল কবর” অধ্যায়ে হযরত ইবনে আবি শাইরাবাহ রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে, “রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম প্রতি বৎসর উহুদ যুদ্ধে শহীদানদের মাজারে জিয়াতের জন্য উপস্থিত হতেন এবং তাঁদের জন্য দোয়া করতেন। এ বর্ণনাটি “সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ” ২য় খন্ডের ১৯৩ পৃষ্ঠায়ও বর্ণিত আছে। এ হাদিসে রাছুল কারিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম জিয়ারতের জন্য সফর করতেন বলে প্রমাণিত হলো।

৬। খুলাফা-ই রাশেদাসহ সাহাবা-ই কেরামগণও এরূপ জিয়ারত করতেন বলে “তাফসীরে কবির” ও “দুররে মনসুরে” উল্লেখ আছে। আরো বর্ণিত আছে “ফতোয়ায়ে সফরুচ্ছায়াদাতের” ১১ পৃষ্ঠায় এবং “আহকামুল মাজার” কিতাবে।

৭। শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির বিখ্যাত কিতাব “জজবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব”- এর ২য় খন্ডের ১৯৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে, ‘মা ফাতেমা আলায়হিস সালাম হযরত আমীর হামযা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মাজার জিয়ারত করতেন এবং মাজার সংস্কার করতেন। তিনি ২/৩ দিন পর পর শহীদানদের মাজার জিয়ারত করতেন। জিয়ারতের জন্য হযরত মা ফাতেমা শহীদানদের মাজারে সফর করতেন ইহাতে প্রমাণিত।
“আল বাছায়ের ও গাউছুল ইবাদ” কিতাবের সূত্রে “আহকামুল মাজার” কিতাবের ৩৫-৩৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা প্রতি বৎসর তাঁর ভাই হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর মাজার শরীফ জিয়ারত করার জন্য মদীনা হতে মক্কায় সফর করতেন। এখানেও মেয়েদের জিয়ারতের প্রমাণ হলো এবং জিয়ারতের জন্য সফর করাও প্রমাণ হলো।

৮। “মাদারেজুন নবুয়াত” কিতাবের ৩য় খন্ডের ৯৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, এক রমণী হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহার নিকট এসে বললেন, দয়া করে একটি বার রঁওযা মোবারকের দরজাটি খুলে দিন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা রঁওযার মোবারকের দরজা খুলে দিলেন। মেয়ে লোকটি রওযা শরীফ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। একটানা কেঁদেই চললেন তিনি। কান্না থামলে দেখা গেলো রমণীটি মারা গিয়েছে।

৯। অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা আবদুল জলিল সাহেব তাঁর “আহকামুল মাজার” কিতাবে “ফতোয়ায়ে শামীর” মোকাদ্দমায় “ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহ আলাইহির মাহাত্ম্য” অধ্যায় হতে ইমাম শাফেয়ীর একটি বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তা হলো, “আমি (ইমাম শাফেয়ী) বরকত লাভের উদ্দেশ্যে ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির মাজারে আগমন করে থাকি। যদি কোনো বিষয়ে সমাধান প্রয়োজন হতো, তখন আমি দু’রাকাত নামাজ পড়ে তাঁর মাজারে গিয়ে খোদার কাছে (তাঁর উছিলা ধরে) প্রার্থনা করতাম। সাথে সাথে আমার সে মকসুদ পূর্ণ হয়ে যেতো। তাহলে ইমাম শাফেয়ীও জিয়ারতের জন্য সফর করতেন বলে এ ঘটনার দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো।

১০। “আনোয়ারে আউলিয়া” কিতাবের ৩১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, হযরত বায়েজীদ বোস্তমী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি প্রতি বৎসর “ধনছান” নামক স্থানে তাশরীফ নিতেন এবং শহীদানদের মাজার জিয়ারত করতেন। এখানেও সফরের প্রমাণ নিশ্চিত হলো।

১১। “সৌভাগ্যের পরশমণি” বিখ্যাত কিতাবের ৩য় খন্ডের ৬৫১ পৃষ্ঠায় ইমাম গায্যালী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি বলেছেন হজ্জ ও জেহাদ করার জন্য, নবী-রাছুল, সাহাবা, তাবেঈন অলি-আউলিয়া বা পীর-মুর্শিদ প্রভৃতি মহাত্মাগণের রঁওযা মোবারক বা মাজার মোবারক দর্শনের জন্য এবং আলেম ও ধার্মিক লোকদের দর্শন লাভের জন্য দেশ ভ্রমন করা বা সফর করা আবশ্যক। তদ্রুপ মহাপুরুষদিগের আশির্বাদ হতে মহা-কল্যাণ পাওয়া যায়। তাদেরকে দর্শনে যে সকল ফল লাভ হয়, তন্মধ্যে ইহাও এক লাভ যে, তাদেরকে দর্শন করতে গেলে, তাদের আচার ব্যবহার ও কার্যের অনুকরণ করতে স্বভাবতঃ ইচ্ছা জন্মে। এ জন্য ওফাতপ্রাপ্ত মহাপুরুষগণের রঁওযা বা মাজার এবং জীবিত মহাত্মাদের দর্শনকে এবাদতের অন্তর্গত ধরা হয়। আবার উহা এবাদতের বীজ স্বরূপ ধরা হয়ে থাকে। এই কারণে শহীদগণের গোরস্থান ও জ্ঞানীলোকের মাজার জিয়ারত করতে যাওয়া ভালো। কল্যাণ লাভের মানসে পীর-মুর্শিদ বা অলি- আউলিয়া-আম্বিয়াগণের মাজার বা রঁওযা মোবারক দর্শনে সফরে যাওয়া অবশ্যই জায়েজ।

১২। ইমাম গায্যালী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি উক্ত কিতাবে আরো বলেছেন, যখন কোনো শহরে প্রবেশ করবে তখন এরূপ সংকল্প করবে যে, তথাকার সাধু ও জ্ঞানী লোকের মাজার দর্শন করবে এবং তথায় পরিপক্ক পীরের অনুসন্ধান করবে এবং তাদের প্রত্যেক হতে উপকার নিবে।

আপন খবর