লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
৪র্থ হিজরীর ৩রা শাবান। ৬ মাস মাতৃগর্ভে থেকে মদিনা শরীফে জগত জননী (আ.) এর কোল আলোকিত করে ভুমিষ্ঠ হলেন এক জ্যোতির্ময় শিশু। খবর শুনেই রাসুল পাক (সা.) ছুটে গেলেন মা ফাতিমা (আ) এর ঘরে। “তাড়াতাড়ি আমার সন্তানকে আমার কাছে নিয়ে এসো” বললেন ধাত্রীকে। নবজাতককে আনা হলেই রাসুল পাক (সা.) তুলে নিলেন কোলে। ঘোষণা করলেন, “এ শিশু চির পবিত্র। আল্লাহপাক এঁকে পাক পবিত্র করে দিয়েছেন।
নিজেই নাম রাখলেন “আল হুসাইন আলাইহিস সালাম।”
হুসাইন (আ.)। যার সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, “হুসাইন আমা হতে এবং আমি হুসাইন হতে; যে কেহ হুসাইনকে মহব্বত করে, আল্লাহ তাকে মহব্বত করেন; হুসাইন স্বয়ংই একটি বংশ; হুসাইনকে যে ভালোবাসলো, সে আমাকে ভালোবাসলো; দুই ইমাম জগতের আমার দুটি সুগন্ধ পুষ্প; জান্নাতীদের সর্দার; হুসাইনের কান্না আমাকে কষ্ট দেয়; হুসাইন আমার উদারতা ও বীরত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করবে; ইত্যাদি।
ইমাম হুসাইন (আ.)। যিনি দ্বীনে মোহাম্মদীর ধারক ও বাহক। বর্ণনা করে যার গুণাবলী উল্লেখ করা অসম্ভব। যার সম্পর্কে যথোপযুক্ত উক্তি করেছেন ভারতবর্ষে দ্বীনে মোহাম্মদীর বিজয়কেতন উড্ডয়ণকারী গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (র.)। তিনি বলেছেন, “আমি নিজেকে ইমাম হুসাইনের ঘোড়ার পদধূলি বলতেও লজ্জাবোধ করি”। ইমাম হোসাইন (আ.) দ্বীনের সবচাইতে কঠিনতম কাজটি সম্পাদন করেছেন। সমস্ত পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সুহৃদ-বন্ধুদের সাথে আপন মস্তককেও হাসিমুখে উৎসর্গ করেছেন কারবালার মাঠে। ইনছানিয়াতকে প্রতিষ্ঠিত করার যুগধর্মের এ সংগ্রামে, শত যন্ত্রণাকে অবলীলায় অতিক্রম করে রুখে দিয়েছেন হায়ানাতের দূর্ভেদ্য প্রাচীরকে। কারবালায় মুয়াবিয়া-এজিদ গংদের বিরুদ্ধে আপন জীবন, পরিবার-পরিজন সহ শিবিরের সকলের জিবনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সত্যধর্মকে। মোহাম্মদী ফুল বাগিচায় এনেছেন বসন্ত!
রাসুলে পাক (সা.) এর ধর্ম বিধান কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবৈধভাবে মসনদ দখলকারী কুট-কৌশলী মুয়াবিয়া তার লম্পট, চরিত্রহীন, কান্ডজ্ঞানহীন, ধর্মভয় বিবর্জিত, মদ্যপ কুপুত্র ইয়াজিদ কে ক্ষমতায় অভিষিক্ত করেন এবং অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতাকে কি করে কন্টকমুক্ত করা যাবে তার সাম্ভাব্য সকল পথ-পদ্ধতি তার কুপুত্রকে বাতলে যান। যার পথ ধরেই ইয়াজিদ পিতার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই সকল জনগণ থেকে এমনকি ইমাম হুসাইন (আ.) সহ আহলে বাইয়াতের অনুসারী সকল ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে আনুগত্যের বাইয়াত দাবী করে। ইমাম হুসাইন (আ.) এ অযৌক্তিক দাবীর উত্তরে বলে দিলেন, “ইসলাম বিদায় হয়ে যাবে যদি উম্মত ইয়াজিদের ফাঁদে পরে”।
ইয়াজিদ নিজেকে মুসলিম জগতের একমাত্র খলিফা ঘোষণা করে উন্মত্তপ্রায় হয়ে উঠলো ইমাম হুসাইন (আ.) এর বাইয়াত আদায়ের জন্য। তৎকালীণ মদিনার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে ওতবা কে জানিয়ে দেয়া হলো, “যে কোনো উপায়ে ইমাম হুসাইন (আ.) থেকে বাইয়াত আদায় করতে হবে। অবাধ্য হলে তাঁকে হত্যা করে মস্তক দামেস্কে পাঠিয়ে দিবে।” ওয়ালিদ ইয়াজিদের ঘোষণা এবং পরিণতির হুমকি ইমাম হুসাইন (আ.) কে জানিয়ে দিলেন। কিন্তু দ্বীনে মোহাম্মদীর ধারক, মানবজাতির মুক্তির দিশারী ইমাম হুসাইন (আ.) এর পক্ষে ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত নেয়া মানেই ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া, যেটা কখনোই সম্ভব নয়।
ইয়াজিদ অটল থাকলো তার পরিকল্পনায়। যে করেই হোক ইমাম হুসাইন (আ.) এর বাইয়াত আদায় করতেই হবে। এদিকে ইমাম হুসাইন (আ.) ও ভাবছেন, ইয়াজিদ তার পিছু ছাড়বে না। হুসাইন (আ.) এর ইচ্ছা হলো তিনি মদিনা ত্যাগ করে চলে যাবেন। এমনিতেই মদিনাতে তাঁর অনেক শত্রু ছিল যারা ইয়াজিদ কর্তৃক নিযুক্ত ছিল। দ্বীনে মোহাম্মদীকে প্রাণের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করতে হবে। চারদিকে শত্রু। অবশেষে ৩রা শাবান তিনি অশ্রু বিগলিত চিত্তে মদিনা ছেড়ে মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন।
মক্কাবাসীগণ সাদরে গ্রহণ করলেন ইমাম হুসাইন (আ.) কে। মক্কায় পৈতৃক বাড়িতে ইমাম হুসাইন (আ.) তার বৈমাত্রেয় ভাই মোহাম্মদ হানিফ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর তাদের সাথে বাস করতে লাগলেন।
থেমে থাকলো না ইয়াজিদের কু-প্রচেষ্টা। ইমাম হুসাইনের বাইয়াত অথবা হত্যা, এমন পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকলো স্বার্থান্ধ ইয়াজিদ। মক্কাও ধীরে ধীরে অনিরাপদ এবং শত্রু বেষ্টিত হয়ে উঠলো ইমাম হুসাইন (আ.) এর জন্য। ওদিকে মারওয়ানের কুটকৌশলে কুফার অস্থিরচিত্ত জনগণ ইমাম হুসাইন (আ.) কে আহ্বান করে শত শত চিঠি পাঠাতে লাগলো মক্কায়। কুফার তৎকালীণ গভর্নর আহলে বাইয়াতের অনুসারী নোমান বিন বশির সহ কুফার জনগণ জিবনের বিনিময়ে ইমাম হোসাইন (আ.) কে রক্ষা করবে এমন প্রতিজ্ঞা করে তাঁকে কুফায় আহ্বান করতে লাগলেন।
ইমাম হোসাইন (আ.) এর সম্মুখে দুটি পথ খোলা। ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত তো অসম্ভব। এখন হয় মক্কায় বসে থেকে ইয়াজিদের আক্রমণের দিন গুনতে হবে, অথবা কুফাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কুফায় গমন করতে হবে।
কুফায় যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। কিন্তু কুফাবাসীর অস্থিরচিত্ততার কথা তিনি জানতেন। তাই প্রথমে চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য কূফায় পাঠালেন ইমাম হুসাইন (আ.)। মুসলিম বিন আকীল কূফায় পৌঁছামাত্র দলে দলে কূফাবাসী এসে মুসলিম বিন আকীলের নিকট ইমাম হুসাইন (আ.) এর নামে বাইয়াত গ্রহণ করতে লাগলো। জানা যায়, ১৮ হাজার মানুষ মুসলিম বিন আকীলের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেছিল। মুসলিম বিন আকীল কূফাবাসীর আগ্রহ, ভক্তি আর দৃঢ়তা দেখে ইমাম হুসাইন (আ.) কে সবিস্তারে বর্ণনা করে কূফায় আসতে বলে চিঠি লিখেন।
ওদিকে কূফায় মুসলিম বিন আকীলের ইমাম হুসাইনের নামে বাইয়াত গ্রহণের কথা জানিয়ে ইয়াজিদ কে পত্র লিখলো কূফার ইয়াজিদ মিত্র আবদুল্লাহ বিন মুসলিম বিন রাবিয়া হাযরামি। একই ধরণের চিঠি ইয়াজিদ কে লিখলো আম্মারাহ বিন উকবাহ এবং ওমর বিন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস। পত্র পেয়ে মস্তক ঘুরে গেলো ইয়াজিদের। সাথে সাথে কূফার গভর্নর নোমান বিন বশীর কে সরিয়ে তার অনুগত ধর্মভয় বিবর্জিত পাষন্ড জিন্দিক ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ (আবু সুফিয়ানের অবৈধ সন্তান) কে কূফার গভর্নর করে কূফায় পাঠিয়ে দিলো। জিয়াদের প্রতি হুকুম দেয়া হলো, মুসলিমের বায়াত বন্ধ করো, প্রয়োজনে তাকে হত্যা করো। যদি হুসাইন কূফায় আসে, তাকেও বন্দী করো অথবা মস্তক কেটে দামেষ্কে পাঠিয়ে দাও।
ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কূফার গভর্নর হয়ে এসেই মুসলিম বিন আকীল কে বন্দী করলেন। জিয়াদের ভয়ে কূফার অনুকূল পরিবেশ মুহুর্তেই প্রতিকূল হয়ে উঠলো। যারা বাইয়াত নিয়েছিল, সবাই জিয়াদের ভয়ে আত্মগোপন করলো। মুসলিম বিন আকীল বন্দী। তখন মুসলিম বিন আকিলের একটাই ভাবনা। ইমাম হুসাইন (আ.) কে তো অনুকূল পরিবেশ দেখে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন তো পরিবেশ পুরোটাই প্রতিকূল। এখন কে ইমামকে এ সংবাদ পৌঁছে দিবে?
ওদিকে কূফার উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি কাফেলা নিয়ে রওয়ানা হলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। আত্মীয়, ভক্ত, স্ত্রী-সন্তানদের একটি ছোট্ট কাফেলা। চলতে হবে আটশত মাইল পথ! পথে নামলো নবী বংশের এ ছোট্ট কাফেলাটি।
মুসলিম বিন আকীল কে হত্যা করলো ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ। ইরাকের কাছাকাছি পৌঁছে সেই সংবাদ কর্ণগোচর হলো ইমাম হুসাইন (আ.) এর। মর্মাহত হলেন তিঁনি। তবু দ্বীনে মোহাম্মদীকে জগতের বুকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে কাফেলা নিয়ে এগিয়ে চললেন ইরাকের দিকে। কূফার দিকে।
অভিশপ্ত ইয়াজিদ ও জিয়াদের বাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.) কে বাধা দেয়ার জন্য কূফার সকল পথে সৈন্য নিয়োগ করে রেখেছিল। ইমাম হুসাইন (আ.) মহররম মাসের ১ তারিখ ইরাক সীমান্তের ‘শাফার’ নামক স্থানে পৌঁছান। আর সম্ভব নয় পেছন ফেরা। সামনে অভিশপ্ত ইয়াজিদ জিয়াদের উন্মুক্ত তরবারী; ঈমানের বলে বলীয়ান, ঐশী শক্তিতে শক্তিশালী, প্রভুপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ইমাম হোসাইন (আ.) এগিয়ে চললেন কারবালার পথে। মহাজীবনের পথে!
যখন ইমাম হুসাইন ইরাকের ‘শারাফ’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন সেনাপতি হুর বিন ইয়াজিদ তামিমির নেতৃত্বাধীন ১ হাজার ঘোরসওয়ার সেনা এসে হুসাইন (আ.) এর তাবু ঘেরাও করলো। দিনে রাতে, আলোয় অন্ধকারে চলতে থাকে তাবু। চারদিকে এজিদি সৈন্য। ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর ছোট্ট কাফেলা। চলতে চলতে কাফেলা এসে থামে বিরাট এক উন্মুক্ত প্রান্তরে। ইমাম হুসাইন (আ.) প্রান্তরের নাম জানতে চাইলে তাঁকে জানানো হলে এ স্থানটির নাম মারিয়া (কারবালার অপর নাম)। চমকে উঠলেন হুসাইন (আ.)।
ইতোমধ্যে জিয়াদের অপর সেনাপতি ওমর বিন সাদ অসংখ্য সৈন্যসহ ঘেরাও করলো ইমাম হুসাইন (আ.) এর ছোট্ট কাফেলাকে। ইয়াজিদের নির্দেশ, হয় বাইয়াত নয়তো মস্তক। জিয়াদের সৈন্য আসতেই থাকলো কারবালার দিকে যতক্ষন না তাদের সংখ্যা ত্রিশ হাজারে উপনীত হয়।
ফোরাত নদীর কূলে তাবু স্থাপন করতে দেয়া হলো না ইমাম পরিবারকে। নদী থেকে তিন মাইল দূরে তাবু স্থাপন করলেন তারা। খাদ্য বিহীন, পানি বিহীন। পিপাসার আর্তি উঠতে লাগলো ইমাম শিবির থেকে। পরিস্থিতি বিবেচনায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলো। যুদ্ধ যখন অনিবার্য, তখন ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর তাবুর অন্যান্য আত্মীয় বন্ধুদের অন্যত্র সরে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু যারা সরে যাবার ছিল, তারা পূর্বেই সরে গিয়েছিল। এখন তাবুতে যারা আছেন, তারা প্রত্যেকেই মূর্তিমান হোসাইন। দ্বীনের জন্য, সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য সবাই জিবন দিতে প্রস্তত। ইমাম হুসাইন (আ.) শেষবারের মতো রক্তারক্তি এড়ানোর জন্য তিনটি প্রস্তাব পেশ করলেন ইয়াজিদের সেনাপতির নিকট। ১. হয় আমাকে মদিনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক, ২. নয়তো আমাকে ইয়াজিদের নিকট যেতে দেয়া হোক। আমি তার সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করবো, ৩. অথবা আমাকে অন্য কোনো মুসলিম আশ্রয় নিতে দেয়া হোক।
শর্ত শুনে ওবায়দুল্লাহ জিয়াদ শিমার ইবনে যিলজোশান এর নেতৃত্বে হুসাইন (আ.) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং হুসাইন (আ.) কে হত্যা করার জন্য প্রচুর সৈন্যসহ কারবালায় পাঠায়। শিমার কারবালায়
এসেই যুদ্ধ অনিবার্য এবং ত্বরান্বিত করে তোলে।
৯ই মহররমের রাত কে বলা হয় আশুরার রাত। একটু তন্দ্রালু হয়ে পড়েছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। স্বপ্নে দেখলেন, রাসুল পাক (সা.) বলছেন, “হে বৎস! তোমাদের আমার নিকট আসার সময় হয়েছে।” চিৎকার দিয়ে জেগে উঠলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। সবাইকে জানালেন স্বপ্নের কথা। ভাবকাতর আবহ তৈরী হলো ইমাম তাবুতে। কেঁদে বুক ভাসালেন জয়নব। এমনি সময়ে, আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে প্রস্তুত ইমাম শিবিরে অবমুক্ত হলো ধর্মবোধ তথা সত্যবোধের এক সুউচ্চ মাকাম। জিবন দেয়ার এ অসম লড়াইয়ে আপন দ্বীন কে জয়ী করতে বদ্ধপরিকর হলো ইমাম শিবির। তাবুর নিকট এসে হুংকার ছাড়লো নরপিশাচ শিমার ইবনে যিলজোশান। বন্দী নবী পরিবার হতে জানিয়ে দেয়া হলো, আজ রাত আমরা ইবাদত বন্দেগীতে কাটাবো। আগামী কাল যুদ্ধ হবে।
১০ই মহররম। দ্বীনে মোহাম্মদীর মূর্তমান রূপ মাওলা ইমাম হুসাইন (আ.) তার সঙ্গী-সাথী, আত্মীয়-স্বজন, ভক্তদের নিয়ে প্রস্তুত হলেন কারবালার মাঠে। দ্বীনে মোহাম্মদীর শাশ্বত পতাকা বুকে ধরে তৈরী হলেন আত্মবলিদানের জন্য। ৩২ জন অশ্বারোহী আর চল্লিশজন পদাতিক সৈন্য নিয়ে তৈরী হলেন এ অসম যুদ্ধের জন্য। অপরদিকে ইয়াজিদের গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের নেতৃত্বে ওমর বিন সাদ, শিমার বিন যিলজোশানের ত্রিশ সহ¯্রাধিক অস্ত্র-সুসজ্জিত সেনা। ইমামের পক্ষ থেকে হযরত জোহায়ের (রা.) ঘোড়া চালিয় যেয়ে শত্রু সেনাদের সামনে এক আবেগপ্রবণ বক্তব্য রাখলেন। যে বক্তব্য দাগ কাটলো সেনাপতি হুর এর অন্তরে। সে বুঝতে পারলো, নবী বংশকে ধ্বংস করাই ইয়াজিদের মূল পরিকল্পনা। অনুতপ্ত হুর আশ্রয় নিলেন ইমাম হুসাইন (আ.) এর পবিত্র চরণ মোবারকে!
শুরু হলো যুদ্ধ! একদিকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ইমাম সেনা, অন্যদিকে সুসজ্জিত ইয়াজিদি সৈন্য। একদিকে ঈমানী বলে বলীয়ান ৭২ জন ইমাম প্রেমিক, অন্যদিকে ত্রিশ হাজার ইয়াজিদি সেনা।
অসম এ যুদ্ধে একে একে ইমাম সৈন্য প্রাণ হারাতে লাগলেন। অসীম বিক্রমে যুদ্ধ করে অসংখ্য পাপী ইয়াজিদ সৈন্যকে ধরাশায়ী করে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করতে লাগলেন এক একজন ইমাম সৈন্য। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে গেলেন সেনাপতি হুর। শহীদ হলেন দুভাই জাফর এবং আব্দুল্লাহ। শাহাদাতের সুধা পান করলেন মুসলিম বিন আওসাজা। ওমায়ের কালবী, উম্মে ওয়াহাব, জাবীব ইবনে মোযাহের সবাই শহীদ হয়ে গেলেন। ইমাম হুসাইন (আ.) এর আওলাদগণ ব্যতিত সবাই পান করলেন শাহাদাতের অমীয় সুধা।
১০ই মহররম শুক্রবার দুপুরের পর ইমাম শিবিরে ইমাম পরিবারের কয়েকজন ব্যতিত আর কেউ অবশিষ্ট নেই। সবাই শহীদ হয়েছে। এবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন ইমাম হুসাইন (আ.) এর বড় ছেলে আলী আকবর। ‘লাহিক’ নামক ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে অমিত তেজে যুদ্ধ করে অগণিত শত্রু সৈন্য ভূপতিত করে শহীদ হন আলী আকবর (আ.)। ইয়াজিদ সৈন্যের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন সখিনার স্বামী হযরত কাসেম (আ.)।
এরপর যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন ইমাম বাহিনীর পতাকাবাহক সানী আব্বাস আলামদার। ইমাম তাবুতে পিপাসার আর্ত কান্না শুনে সানী আব্বাস ছুটলেন ফোরাতের তীরের দিকে। অসীম শক্তিমান যোদ্ধা সানী আব্বাস আলামদার, ফোরাত তীর অবমুক্ত করে নদী থেকে পানি নিয়ে ছুটলেন ইমাম তাবুর দিকে। ইয়াজিদ বাহিনী এবার চারদিক থেকে শুরু করলো আক্রমণ। প্রচন্ড আক্রমনে কেটে গেলো যথাক্রমে ডান ও বাম হাত। তীর এসে বিদ্ধ হলে পিঠে। তবু তিনি হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলেন তাবুর দিকে। এমন সময় একটা তীর হলে বিদ্ধ হলো তার পানির মশকে। মরুভূমির বুকে গড়িয়ে পড়লো মশকের সব পানি। ইমাম হুসাইন (আ.) দৌঁড়ে এসে কোলে তুলে ধরলেন সানী আব্বাসকে। ইমামের নূরানী চেহারা মুবারকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিদায় নিলেন সানী আব্বাস আলামদার। শোকে মূহ্যমান ইমাম হুসাইন (আ.) শিবিরে ফিরে দেখেন, মাসুম শিশু আলী আসগর পানির পিপাসায় মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। সহ্য করতে না পেরে ইমাম হুসাইন (আ.) শিশু আলী আসগর কে দুহাতে উঁচু করে ধরলেন ইয়াজিদ সেনাদের সামেনে। চিৎকার করে বললেন, “হে ইরাক ও সিরিয়ার অধিবাসীরা! তোমরা হুসাইনকে শত্রু মনে করতে পারো, কিন্তু এ মাসুম শিশুতো তোমাদের কোনো ক্ষতি করেনি। শিশুটি তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছে। সামান্য পানি তাকে দাও। আল্লাহর কসম, এক ফোটা পানিও আমরা পান করবো না।” নিষ্ঠুরতার কি নির্মম প্রদর্শনী! শত্রু শিবিরের মধ্য হতে হারমলা বিন কাহেন আসাদী নামক এক ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.) কে লক্ষ্য করে তীর ছুড়লেন। সে তীর এসে বিদ্ধ হলো শিশু আলী আসগরের কচি বুকে। ফিনকি দিয়ে ছুটলো রক্ত। শোকে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ইমাম হুসাইন (আ.)।
এবার যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তত হলেন স্বয়ং ইমাম হুসাইন (আ.)। মাথায় আমামা, কোমরে কোমরবন্ধনী, হাতে জুলফিকার, পৃষ্ঠে ঢাল, বাম হাতে বর্শা, ডান হাতে তরবারী নিয়ে প্রস্তুত হলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। চিরমুক্তির পথপ্রদর্শক, বাক্সময় কোরান, ধর্মের ধারক বাহক, ত্যাগ ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক আজ যোদ্ধার বেশে চলেছেন ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচণ করতে। মুসলিম বেশধারী মুনাফিকদের চিহ্নিতকরণের জন্য এ বেশ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইমাম হুসাইন (আ.) শত্রুসৈন্যর নিকট গিয়ে প্রদান করলেন তার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য। “আলাইছা ফি মুসলিমুন? তোমাদের মধ্যে কি একজনও মুসলমান নেই?” নিরব সৈন্যবাহিনী। তাবুতে ফিরে এলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। সবার থেকে শেষ বিদায় নিয়ে, সবাইকে শেষ নসীহত করে তিনি দুলদুলে সওয়ার হয়ে রওয়ানা হলেন যুদ্ধে।
অমিত বিক্রমে যুদ্ধ শুরু করলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। তাঁর অপ্রতিরোধ্য বিক্রমের কাছে টিকতে পারলো না সম্মিলিত শত্রু বাহিনী। ফোরাত কূল অবমুক্ত করলেন একাই। পানিতে নেমে দুহাতে পানি তুলতেই মনে পরলো শিশু বাচ্চাদের পানির জন্য আহাজারীর করুণ দৃশ্য। ফেলে দিলেন হাতের পানি। এমনি মুহুর্তে একটি তীর এসে বিদ্ধ হলো তাঁর মুখে। অতি কষ্টে মুখ থেকে তীরটি খুলে পুনরায় ফিরে আসলেন যুদ্ধের ময়দানে। অগনিত আঘাতে শরীর হতে বেগে নির্গত হচ্ছে রক্ত। তবু ক্ষিপ্ত সিংহের ন্যায় যাকে যেখানে পেলেন সংহার করে চললেন। ওমর বিন সাদ সম্মুখ থেকে সরে গেলো ভয়ে। শেরে খোদার শের পুত্র ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর, শোকে মূহ্যমান, তবু কি অসীম তাঁর বিক্রম! চলতে থাকলো যুদ্ধ।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইমাম হুসাইন (আ.) এর শরীর দূর্বল হতে থাকলো। পাপিষ্ঠ জোরআ বিন শরীফ তামিমী পেছন দিক থেকে এসে ইমাম হুসাইন (আ) এর বাম হাতটি কেটে ফেলে। ইমাম কে বর্শা দিয়ে আঘাত করে পাপিষ্ঠ সেনান বিন আনাস নাখায়ী। বুকে বর্শার আঘাত, গলায় বিধে যাচ্ছে তীর! তীব্র যন্ত্রনায় মাটিতে পড়ে যান ইমাম হুসাইন (আ.)। চারদিক থেকে অবিরাম আঘাতের পর আঘাত পতিত হচ্ছে ইমাম হুসাইনের শরীরে। শত শত তীর বিধে যাচ্ছে পাকতনে! বুকে তলোয়ারের আঘাত করে সালেহ বিন ওহাব! ওমর বিন সাদ ঘোষণা দিলেন, শীঘ্রই হুসাইনের মাথা কেটে ফেলো! চির অভিশপ্ত শিমার বিন যিলজোশান ইমাম হুসাইন (আ.) এর মস্তক দ্বিখন্ডিত করে ফেললো।
শহীদ হলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে শাহাদাতের অমীয় পেয়ালা পান করে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে চিরঞ্জীব জীবনের অধিকারী হওয়া যায়।
ইমাম হুসাইন (আ.) এর শাহাদাতের পর দেখা গেলো তার পবিত্র শরীরর ওপর তেত্রিশটি বর্শার আঘাত, তেতাল্লিশটি তলোয়ারের আঘাত এবং অসংখ্য তীরের আঘাত রয়েছে। ইমাম পরিবারের এবং ইমাম শিবিরের যোদ্ধা সবাই শাহাদাত বরণ করেছিলেন এবং শত্রু শিবিরে জাহান্নামী হয়েছিল আটাশি জন।
ইয়াজিদের হিং¯্র হায়েনার দল ইমামের শাহাদাতের পর তাঁর পবিত্র দেহ মুবারকের ওপর ঘোড়া চালিয়েছিলেন দেহ মুবারককে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার জন্য। যুদ্ধ শেষে শাহাদাত প্রাপ্তদের মস্তক মোবারক বর্শায় বিদ্ধ করে ওবায়দুল্লাহ জিয়াদের নিকট নেয়া হয়েছিল। তারপর সেই মস্তকসমূহ শিমার ইবনে যিলজোশানের নেতৃত্বে দামেস্কে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য শাহাদাত বরণ করলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। চিনিয়ে দিয়ে গেলেন সত্য মিথ্যাকে। যুগ যুগ যারা জীবন্ত ধর্ম কে হত্যা করে অনুমান কল্পনায় ধর্ম করে আসছে, উন্মোচিত করলেন তাদের মুখোশ। হৃদয়ে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো সত্যধর্ম। ত্যাগের অপার মহিমার মধ্য দিয়েই উদ্ভাসিত হলো সত্য।
* আতায়ে রাছুল হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতী আজমেরী (র.) বলেছেন, “ইমাম হুসাইন (আ.) হলেন দ্বীনের স¤্রাট, তিঁনি দ্বীনের বাদশাহ। ইমাম হুসাইন (আ.) দ্বীনের মাপকাঠি এবং দ্বীনের আশ্রয়। ইয়াজিদের কাছে তিঁনি মাথা দিলেন, তবু হাত দেননি। সত্য কথা ইহাই যে, লা ইলাহা’র ভিত্তি হলেন ইমাম হুসাইন (আ.)।
* খাজা গরীবে নেওয়াজ (র.) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি হুসাইন (আ.) এর গোলাম, আমি হলাম সেই গোলামের গোলাম।”
* খাজাবাবা (র.) বলেন, “বোকারা বুঝতে পারেনি ইমাম হুসাইন (আ.) পানি পিপাসায় অসহায়ের মতো মারা যাননি, বরং তিনি আসল ও নকলের ভাগটি পরিষ্কার করে দেখিয়ে গেছেন।”
রচনাকাল – 01/01/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী