হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
নবীজির দাদার দাদা ‘আবদে মান্নাফের’ তিন স্ত্রী হতে এগার সন্তান। তার মধ্যে পাঁচজন পুত্র এবং ছয়জন মেয়ে ছিল। হাশেম এবং আব্দে শামছ এক সাথে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় দেখা যায় হাশেম ও আব্দে শামছের মাথার সম্মুখ ভাগটি সামান্য জোড়া লাগানো অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিল। জন্মের পর তলোয়ার দিয়ে কেটে তাদেরকে আলাদা করা হয়। যাক, আব্দে শামছ হতে মানুষ কখনো উপকার বা সৎ আচরণ পায়নি এবং এ কথা ইতিহাসে বিধৃত রয়েছে। কারণ, কোরাইশ বংশের এ দু’ধারা কাবার সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং হাজীদের খেদমতে নিয়োজিত ছিল বহুপূর্ব হতেই। তাই হাশেম আব্দুদ্দারের অযোগ্যতা লক্ষ্য করে কাবার মোতাওয়াল্লি নিজের হাতে নিয়ে নেন। অবশ্য এ কার্য সমাধা করতে অনেক বিচার শালিশেরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। হাশেম অত্যন্ত সুচারু রূপে এবং ন্যায়নিষ্ঠ ভাবে কাবার মোতাওয়াল্লি পরিচালনা করেছিলেন। অধিকাংশ কোরাইশদের মতো তিনিও বাণিজ্যে ব্যাপৃত ছিলেন। তিনিই কোরাইশদের মধ্যে নিয়মিত ভাবে মক্কা থেকে দু’টি বাণিজ্য যাত্রীদল প্রেরণের প্রথা চালু করেছিলেন, একটি শীতকালে ইয়ামেনে ও অন্যটি গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায়। হাশেম বাণিজ্য নিয়ে শাম দেশে যাবার পথে মদীনায় নাজ্জারিয়া উমরের বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন এবং তার পরমা সুন্দরী মেয়ে ছালমাকে বিবাহ করেন। হাশেম সিরিয়ায় এক বাণিজ্য অভিযান কালে গাজ্জা শহরে ৫১০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ইন্তেকাল করেন। তিনি ইন্তেকালে সময় তার মদীনাবাসিনী মহিলা ছালমার গর্ভজাত একমাত্র পুত্র শায়বাকে রেখে যান। তার ইন্তেকালের পর ‘রিফাদা’ ও ‘মিকায়ার’ দায়িত্ব তদীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা মুত্তালিবের উপর ন্যাস্ত হয়। তিনি তার স্বদেশ বাসীর দৃষ্টিতে উচ্চস্থান লাভ করেছিলেন এবং তার ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও দানশীলতার জন্য মহান উপাধি ‘আল ফয়েজ (বা দানবীর)’ পেয়েছিলেন। মুত্তালিব শ্বেতকেশ বিশিষ্ট যুবক শায়বাকে (সাদাচুল বিশিষ্ট) মদীনা থেকে মক্কায় নিয়ে আসেন। শায়বাকে মুত্তালিবের দাস মনে করে মক্কাবাসীরা তাকে আবদুল মুত্তালিব বলে অভিহিত করতো। ইতিহাসে হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের পিতামহ আবদুল মুত্তালিব বা মুত্তালিবের দাস – এ নাম ছাড়া অন্য কোনো নামে অভিহিত নন। এ হাশেম বংশেই নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের জন্ম। আর আব্দে শামছের বংশে জন্ম হয় হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ও আবু সুফিয়ান।
মুত্তালিব ৫২০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইয়ামেনের কাজওয়ানে ওফাত লাভ করেন এবং তদীয় ভ্রাতৃস্পুত্র হযরত খাজা আবদুল মুত্তালিব মক্কা নগরীর শাসনভার যথার্থ প্রধান হিসাবে তার উত্তরাধিকারী লাভ করেন। মক্কার মধ্যে তিনি মুকুটহীন বাদশাহ বলে অভিহিত ছিলেন এবং মানবীয় সার্বিক উত্তম গুণাবলীতে তিনি ভূষিত ছিলেন। তার ললাটদেশে সর্বদা নূরে মোহাম্মদী চন্দ্রালোকের ন্যায় চমকিত। তাই বাদশাহ আবরাহার হাতী ‘মাহমুদ’ হযরত খাজা আবদুল মুত্তালিবকে দেখে মাথা নত করে সম্মান করেছিল এবং সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরে আবাবিল পাখি দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল।
তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন জমজম কূপ উদ্ধার করতে এবং স্বপ্নে তার নির্দশনও দেখানো হলো। কিন্তু তা খনন করতে গিয়ে অন্যান্য গোত্রের দ্বারা বাঁধার সম্মখীন হলেন। তাছাড়া তাঁর লোকজন কম থাকাতে তাঁর শক্তি-সামর্থ্যও কম বিধায় লোক বলেরও প্রয়োজন ছিল। এদিকে হযরত আবদুল মুত্তালিবের বয়স বৃদ্ধি প্রাপ্ত হলেও কোনো সন্তান-সন্ততি না হওয়াতে এবং জমজম কূপ আবিষ্কার করার মানসে এক প্রতিজ্ঞা করলেন যে, যদি তার দশটি পুত্র সন্তান হয় তবে একটি ইব্রাহীমের ন্যায় আমিও কোরবানী করবো। আল্লাহপাক তাকে দশ পুত্র দান করলেন এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো একজন পুত্রকে কোরবান দিতে মনস্থ করলেন। পুত্রদিগের মধ্যে ভাগ্য পরীক্ষায় সর্বকনিষ্ঠ পুত্র হযরত আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালামের নাম উঠলো এবং হযরত আবদুল মুত্তালিব তাকেই বেশী স্নেহ করতেন। কর্তব্যের খাতিরে তাকেই কোরবানী করতে স্থির করলেন। তাতে লোকেরা এ কার্য হতে নিবৃত হতে বার বার উপদেশ দিল। শেষে আবদুল মুত্তালিব ‘শিয়া’ নামক এক ভবিষ্যদ্বক্তার পরামর্শে হযরত আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালামের বিনিময়ে দশটি উট নির্ধারণ করে ভাগ্য নির্ণয় করলো। এভাবে দশবার ভাগ্য নির্ণয় করে শেষে একশতটি উটের বিনিময়ে হযরত আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালাম কোরবানী হতে রক্ষা পেলেন। সেই হতে আরবে প্রাণের বিনিময়ে একশতটি উট নির্ধারিত হলো। তাই রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলছেন, “আমি দুই কোরবানীর ছেলে।” আল্লামা জালালউদ্দিন সিয়ুতীর ‘খাসায়েসুল কুবরার’ বর্ণনা হতে জানা যায় হযরত খাজা আবদুল মুত্তালিব একদিন হেরেমে নিদ্রিত থাকাবস্থায় স্বপ্নে তাকে একজন এসে জমজম কূপ খনন করার জন্য নির্দেশ দিলেন। তিনি জাগ্রত হয়ে প্রার্থনা করলেন যেন জমজম কূপের চিহ্ন বা নিদর্শন তাকে জানানো হয়। সে মতে তিনি আবারও স্বপ্নে শুনতে পেলেন তাকে বলা হচ্ছে, জমজম সেই স্থানে খনন করো, যেখানে গোবর ও রক্ত পড়ে রয়েছে, সাদা পাখাবিশিষ্ট কাক চঞ্চু মারছে-পিপীলিকার গর্তের কাছে। খাজা আবদুল মুত্তালিব তার সন্ধান করতে গিয়ে দেখলেন সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে ‘খারুরা’ নামক স্থানে একটি গরু জবাই করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। গরুটি কসাইয়ের হাত হতে ছুটে দৌড়িয়ে জমজমের স্থানে এসে মাটিতে পড়ে গেল এবং সেখানেই গরুটি জবাই করা হলো। একটি সাদা পাখাবিশিষ্ট কাক এসে পিপীলিকার গর্তের কাছে আবর্জনায় বসে চঞ্চু পারছে মানে ঠোকরাচ্ছে। খাজা আবদুল মুত্তালিব এ নির্দশন দেখে সেখানেই খনন কার্য শুরু করলেন। কোরাইশরা এসে তাকে বাধা দিয়েছিল, তিনি তাতে বিরত না হয়ে খনন কার্য চালিয়ে গেলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় দেখা যায় কূপ খনন করার পরও পানি না উঠায় তিনি মানত করেছিলেন যে, যদি এ কূপে পানি উঠে , তবে তিনি নিজের একটি পুত্রকে বলীদান করবেন। এরপর খনন শুরু করলে পানি বের হয়ে আসলো এবং তিনি কূপের চতুর্দিকে একটি দেয়াল তৈরী করে দিলেন। এভাবেই জমজম কূপ পুনরুদ্ধার করা হয়। বিভিন্ন কিতাবে এ ঘটনার আরো কিছু বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যাক, খাজা আবদুল মুত্তালিব আমরের কন্যা ফাতেমাকে বিবাহ করেন, এর ঘরে হযরত খাজা আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালাম জন্ম গ্রহণ করেন এবং তার পেশানীতে নূরে মোহাম্মদী পূর্ণিমার চন্দ্র সদৃশ চমকাত। হযরত খাজা আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালাম যখন বিশ বৎসর বয়সে পৌঁছিল রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের উর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ বনি ‘জোহরা গোত্রের’ ওহাবের কন্যা হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মাত্র তিনদিন শ্বশুরালয়ে থেকে হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালামকে সঙ্গে নিয়ে নিজ গৃহে চলে আসেন। এর কিছুদিন পরেই বাণিজ্য উদ্দেশ্যে সিরিয়া (শাম দেশে) যাত্রা করেন। সিরিয়া হতে প্রত্যাবর্তনকালে হযরত খাজা আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালাম মদীনায় কয়েকদিন বিশ্রামরতো অবস্থায় তার কঠিন পীড়া (জ্বর) হলো। এ সংবাদ পেয়ে পিতা খাজা আবদুল মুত্তালিব হযরত খাজা আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালামকে আনার জন্য তার জ্যোষ্ঠপুত্র হারিসকে মদীনায় পাঠালেন। কিন্তু হারিস নিয়ে এলো হযরত খাজা আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালামের ওফাত সংবাদ। তখন তার বয়স ২৫ বৎসর ছিল। অধিকাংশ বর্ণনা মতে পিতার ওফাতের ছয় মাস পরে রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেন। দিনটি ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার সোবহে সাদেকের সময়। ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার এবং সোবহে সাদেক-এ তিনটি কথা একটি চিরন্তন-শাশ্বতকালের কথা। আল্লাহর হাবিব এ তারিখেই এ ধরাধামে এসেছেন এবং ১২ তারিখেই ওফাত লাভ করছেন। ইলমে এলাহীর অধিকারীগণ তা বর্তমানেই জানেন-দেখেন। কারণ, তিনি ১২ই রবিউল আউয়াল মাসে এসেছেন এবং ১২ই রবিউল আউয়াল মাসেই আছেন। অর্থাৎ তিনি যেমন ছিলেন তেমনই আছেন তথা ওফাত লাভ করছেন। এ বিষয়ে যারা মতভেদ সৃষ্টি করেছেন তারা হাবিবে খোদা মোহাম্মদ রাছুল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের হাকিকত সম্পর্কে বেখবর। হাবিবে খোদার জীবন কাহিনীর (আগমন এবং প্রত্যাগমনের) যে ইতিহাস হাকিকতের সাথে সামঞ্জস্য নয়, তা অবশ্যই পরিবর্তনযোগ্য এবং তা হাকিকতের অনুসরণযোগ্য। হযরত মাকহুল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেছেন নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলছেন, “তোমরা সোমবারে রোজা ছাড়বে না। কেননা, আমি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছি, সোমবারে আমার কাছে ওহী প্রেরণ করা হয়েছে, সোমবারে হিজরত করেছি এবং সোমবারেই আমার ওফাত লাভ হবে।” অন্য বর্ণনায় যা অতিরিক্ত রয়েছে তা হলো, ‘সোমবারে মদীনায় পৌঁছেন, সোমবারে মক্কা জয় করেন’। রাছুলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের জন্মের সময়কার বিভিন্ন ঘটনা ‘তারিখ ও সিরাত’ গ্রন্থগুলোতে বিস্তর বর্ণনা করা হয়েছে।
বায়হাকী, তিবরানী, আবু নায়ীম খলিফা ইবনে সাওদাহ্ হতে বর্ণনা করেন, আমি মোহাম্মদ ইবনে আদী ইবনে রবীয়াকে প্রশ্ন করলাম, মূর্খতা যুগে তোমার পিতা তোমার নাম মোহাম্মদ রাখলো কেনো ? সে বললো, আমি আমার পিতাকে এ প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, আমরা বনী তামীমের চার ব্যক্তি সিরিয়ায় সফরে রওয়ানা হই- আমি, সুফিয়ান ইবনে মাজাশে, ইয়াজিদ ইবনে ওমর এবং উসাতা ইবনে মালেক। সিরিয়া পৌছে আমরা একটি ছোট জলাশয়ের পাড়ে অবস্থান করলাম। সেখানে একটি বৃক্ষ ছিল। একজন সন্নাসী এসে বললো, তোমরা কে ? আমরা বললাম, আমরা আরবের মুযার গোত্রের লোক। সে বললো, তোমাদের মধ্যে অতি শীঘ্রই একজন নবী আত্মপ্রকাশ করবেন। তাড়াতাড়ি যাও এবং তাঁর কাছ থেকে হেদায়েত হাছিল করো। কেননা, তিনি সর্বশেষ নবী। আমরা বললাম তাঁর নাম কি ? সে বললো, তাঁর নাম হলো মোহাম্মদ। আমরা সফর থেকে গৃহে ফিরে এলে সকলেরই পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করলো এবং সকলেই নিজ নিজ পুত্রের নাম মোহাম্মদ রেখেছিলাম।