কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
সফর পাঁচ প্রকার – ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মোবাহ ও হারাম।
- উপলক্ষ যদি ফরজ হয় তবে এর জন্য সফর করাও ফরজ। যেমন, হজ্ব করার জন্য সফর করা ফরজ।
- উপলক্ষ যদি ওয়াজিব হয় তবে তাঁর জন্য সফর করাও ওয়াজিব। যেমন, মান্নতি হজ্জ ওয়াজিব বিধায় তার জন্য সফর করাও ওয়াজিব।
- উপলক্ষ সুন্নত হলে তার জন্য সফর করাও সুন্নত। যেমন, জিয়ারত সুন্নত। সুতরাং জিয়ারতের জন্য সফর করাও সুন্নত।
- উদ্দেশ্য যদি মোবাহ হয় তবে এর জন্য সফর করাও মোবাহ হবে। যেমন, ব্যবসা বাণিজ্য ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাক্ষাতের জন্য সফর করা।
- উপলক্ষ হারাম হলে তার জন্য সফর করাও হারাম। যেমন, চুরি করার জন্য সফর করা হারাম।
কাজেই রঁওযা বা মাজার মোবারক এবং কবর জিয়ারত যেহেতু সুন্নত সেহেতু তার জন্য সফর করাটাও সুন্নত। যারা সফরকে নাজায়েজ বা হারাম বলে তারা গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট। রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বলছেন, বাইতুল্লাহ, মসজিদে নব্বী ও বাইতুল মোকাদ্দাস এই তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনোখানে সফর করবে না, এ হাদিস কবর বা মাজার বা রঁওযা জিয়ারতের ক্ষেত্রে যারা প্রয়োগ করে তারা গোমরাহ ও নির্বোধ। এ হাদিস উক্ত তিন মসজিদের ফজিলতের শাণে বর্ণিত হয়েছে, রঁওযা শরীফ বা মাজার শরীফের উদ্দেশ্যে নয়- এ কথা বুঝা উচিত।
১৩। “জুবদাতুন নাছায়ীহ ফী মাসালিজ জাবায়ীহ” নামক কিতাবে হযরত শাহ আবদুল আজিজ দেহলবী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি ও মৌলবী আবদুল হাকিম শিয়ালকোটী বর্ণনা করেন, “ছালেহীন বুজুর্গানে দ্বীনের মাজার হতে বরকত নেয়া, ইছালে ছওয়াব (ওরশ), কোরান পাক তেলাওয়াত, শিরণী ও খানা পরিবেশনের মাধ্যমে তাঁদের ফয়েজ ও বরকত হাছিল করা ইজমা-ই উলামার মতে উত্তম”।
১৪। মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা হতে বর্ণিত আছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের খেদমতে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা আরজ করলেন, আমি কবর সমূহ জিয়ারত করলে কিভাবে সম্বোধন ও দোয়া করবো এবং কিভাবে জিয়ারত করবো? তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বললেন, এভাবে সম্বোধন ও দোয়া করবে- “হে কবরবাসী মুসলিম নর-নারীগণ! তোমাদের উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক। আমাদের পূর্বে গমনকারী ও পরে গমনকারী পরলোকগত নর-নারীকে আল্লাহ রহম করুন। ইনশাল্লাহ, আমরা অচিরেই তোমাদের সাথে মিলিত হব”।
১৫। আল্লামা আবদুর রহমান জামী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির বিখ্যাত কিতাব “শাওয়াহেদুন নবুয়ত” এর ২৭২ পৃষ্ঠায় হযরত রেজা আলী ইবনে মুহাম্মদ মুসা থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আমার রঁওযা জিয়ারত করবে, সে জান্নাতে দাখিল হবে।
১৬। ইমাম জযরী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি বলেন, যদি হুজুর সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের নিকট (রঁওযায়) দোয়া কবুল না হয় তবে আর কোথায় হবে ? উক্ত স্থানকে দোয়া কবুলের শিরোভাগে রাখা উচিত।
১৭। “মুসনাদে ইমাম আজম আবু হানিফা” কিতাবের ২৩৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে, হযরত ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি বলেন, হযরত ইমাম কাযিম আলায়হিস সালামের মাজার দু’আ কবুলের এক আশ্চর্য জায়গা।
রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারক জিয়ারতের সময় “নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের চেহারা খেয়াল করবে”-এ কথা ফতোয়ায়ে আলমগীরি ২য় খন্ডের ৫৪৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে। একথাটি সাহাবাগণের বেলায় নিশ্চয়ই প্রযোজ্য বা সম্ভব। কারণ, তাঁরা নবীজিকে দেখেছেন। না দেখলে তাঁর চেহারা খেয়াল করা যায় না। আর করলেও মনের কল্পিত ধারণা বিভিন্ন রকম হয়ে যাবে, রাছুল করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের চেহারা খেয়াল হবে না। এ অবস্থায় যার যার পীর-মুর্শিদের বরযোখ নিয়ে জিয়ারত করাই হলো উত্তমপন্থা এবং উক্ত ফতোয়ার মূল উদ্দেশ্যও হবে তা-ই। তাছাড়া সমস্ত সুফিয়ানে কেরামগণের মতে তাসাব্বুরে শায়েখ হলো উত্তম ইবাদত। এবার ওহাবী নেতা আশরাফ আলী থানভী লিখিত পুস্তক “কছদুছ ছবীল” যার অনুবাদ লালবাগ মাদ্রাসার ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ মাওলানা শামছুল হক করেছেন। থানভী সাহেব উক্ত পুস্তকে কবর জিয়ারত সম্পর্কে বলেছেন, “আবার ইহাও দরকার যে, আউলিয়াদের মাজার এবং বুজুর্গদের মাজার জিয়ারত হাছেল করবে এবং সে সময় যেনো দীলের মধ্যে অন্য কোনো চিন্তা না থাকে। তখন তাঁদের রূহের দিকে মন দিয়া তাদের রূহানিয়াতকে নিজের পীরের সুরতে কল্পনা করে তাদের ফয়েজ এবং বরকত হাছিল করবে। এ কথাটি হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মাক্কী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির পত্রাবলীতে বর্ণিত আছে এবং শায়েখ আহমদ শেরহিন্দী মুজাদ্দেদ সাহেব তাঁর “মকতুবাত” শরীফেও উল্লেখ করেছেন। কাজেই রঁওযা বা মাজার জিয়ারতের সময় যদি মাজারস্থ অলির চেহারা অপরিচিত হয় তবে স্বীয় মুর্শিদের চেহারায় ঐ মাজার মোবারক জিয়ারত করবে।
হযরত মীর্জা মাজহার জানেজাঁনান রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি যিনি হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলভীর পীর ছিলেন, তিনি একবার তাঁর আপন একজন ভক্তের মাধ্যমে হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির মাজারে সালাম পাঠালেন। যখন সেই মাজারে গিয়ে হযরত মীর্জা মাজহার জানেজাঁনান রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির পক্ষ হতে সালাম পেশ করলেন তখন মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির মাজার থেকে তাঁর মাথা মোবারক সিনা পর্যন্ত বের করলেন এবং বললেন, কোন মীর্জা? যিনি আমার পাগল ও আশেক সে মীর্জা নাকি? তোমার এবং তাঁর উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হউক (আস-সায়েক্বাহ)। আশা করি এ লেখা হতে নবী-রাছুল এবং অলি-আউলিয়াদের ভক্ত-মুরিদান এবং আশেকান তথা দ্বীন-এ-মুহাম্মদী বা ইসলামের অনুসারীগণের রঁওযা শরীফ বা মাজার শরীফ জিয়ারত করা অবশ্যই জায়েজ ও সুন্নত এবং কখনো ওয়াজিব বলেও প্রমাণিত হলো। সউদি সরকার এবং তার দোসর ওহাবীদের মনগড়া মতবাদ বাতিল বলে প্রমাণিত হলো। তবে এটাও ঠিক যে, অন্ধ-মূর্খ ও গোঁড়া ওহাবীদের বুঝাতে যাওয়া আর গাধার নাকে গোলাপ ফুল ধরা একই কথা।
মাজার তাওয়াফ করাঃ
“খাজানাতুর রিওয়ায়েতে” গ্রন্থে “মোলতাকাত” কিতাবের সূত্রে এবং “ইসলাহে বেহেশতী জেওর” কিতাবের ৭৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, “ওয়া ইনকানা কাবরু আবদিন ছলিহিন ওয়া ইউমকিনুহু আইইয়াতুফা হাওলাহ ছালাছা মাররাতিন ফাআলা জালিকা”। অর্থাৎ কবর যদি নেকবান্দার (অলি-আল্লাহর) হয় এবং কবরের চারিদিকে তাওয়াফ করা সম্ভব হয়, তা হলে তিনবার তাওয়াফ করবে। কাবে আহবার বর্ণিত হাদিছে আছে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা শরীফে দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা নেমে এসে ঘাড় দুলিয়ে রঁওযা শরীফ তাওয়াফ করতে থাকে। হাশরের দিন নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম সেই সমস্ত ফেরেশতা সমভিব্যহারেই উঠবেন রঁওযা মোবারক হতে (মাদারেজুন নবুয়ত ২য় খন্ড,৭৭ পৃঃ)।
হাজ্জাজ বিন ইউসূফ (তার গর্ভনর পদে থাকাকালীন) কিছু লোককে রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারকের চর্তুদিকে তাওয়াফ করতে দেখে মন্তব্য করে বসলো যে, “এ লোকগুলো কিছু লাকড়ী ও গলিত দেহের তাওয়াফ করছে”। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের উক্ত মন্তব্যের কারণে ফেকাহশাস্ত্রবিদ ওলামায়ে কেরামগণ তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন। এ কথা জুরকানী “শরহে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া” কিতাবে আল্লামা জুরকান “কামেল” গ্রন্থের হাওলায় উদ্ধৃত করেছেন। তার রাজত্বকাল যেহেতু আনুমানিক ৬৮-৮৬ হিজরী পর্যন্ত ছিলো, কাজেই তখন নিশ্চয়ই রাছুল করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের কোনো সাহাবা বা তাবেঈন এ তাওয়াফ করেছিলেন। না জায়েজ হলে এ রকম তাওয়াফ অবশ্যই করতেন না। বরং খারাপ মন্তব্য করাতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কাফের ফতোয়া পেলো। যদিও তাতে রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের শান, মান, মর্যাদা জড়িত এবং প্রধান বিষয়।
ওহাবী নেতা আশরাফ আলী থানভী সাহেবও তাওয়াফ বৈধ স্বীকার করেছেন। মৌলবী থানভী সাহেব জনৈক ব্যক্তির এক প্রশ্নোত্তরে তিনির রচিত “হিফজুল ঈমান” বইয়ের ৬ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন যে, আশরাফ আলী থানভীকে জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছেন যে, হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেব “কাশফে কবুর” অর্থাৎ কবরবাসীর সাথে আধ্যাত্মিক সংযোগের নিয়ম এভাবে বলেছেন, “ওয়া বাআদাহু হাফাত কুরা তাওয়াফা কুনাদ ওয়াদান তাকবীরা ফি খাওনাদ ওয়া আগাজ আজ রাসতা কুনাদ বা আদাহু তারফি ফাইয়ান রূখছাদা নিহাদ”। অর্থাৎ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী বলেছেন, “অতঃপর কবরের চতুর্দিকে সাত চক্কর তাওয়াফ শুরু করবে এমন ভাবে যেনো জিয়ারতকারীর মুখ কবরবাসীর অলির পায়ের দিকে থাকে।
উক্ত কথাটি লিখে প্রশ্নকারী থানভী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেন- ইহা বৈধ কিনা? থানভী সাহেব তার লিখিত “হিফজুল ঈমান” বইয়ের ৬ পৃষ্ঠায় প্রশ্নোত্তরে বলেন, “এ প্রকার তাওয়াফ শরিয়তের পরিভাষায় তাওয়াফ নহে- যার দ্বারা ইবাদত ও সান্নিধ্য মকসুদ হয় এবং এ ধরনের তাওয়াফই শরিয়তে নিষিদ্ধ বরং যে তাওয়াফের কথা শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেব বলেছেন সেটা হচ্ছে শাব্দিক অর্থে তাওয়াফ। অর্থাৎ মাজারের চারদিকে ঘুরে মাজারবাসী অলির সাথে আত্মিক নিছবত তথা সংযোগ স্থাপন করা হলো এ তাওয়াফের উদ্দেশ্য এবং অলির পক্ষ হতে বরকত লাভ করা তার মূখ্য উদ্দেশ্য। সুতরাং মৌলবী আশরাফ আলী থানভী সাহেবও মাজার তাওয়াফ, অলির নিছবত ও ফয়েজ বরকত লাভের উদ্দেশ্যে জায়েজ স্বীকার করেছেন।
“ইসলাহে বেহেশতী জেওর” কিতাবের ৭৪-৭৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “অলিদের মাজার তাওয়াফ করার উদ্দেশ্য হলো অলির পক্ষ হতে ফয়েজ ও বরকত লাভ করা এবং তাঁর সাথে আত্মিক নিছবত স্থাপন করা”। একথাটি “জা’আল হক” বিখ্যাত কিতাবের ১৩৯ পৃষ্ঠায়ও বর্ণিত আছে। “বেলায়েতে মোতলাকা” কিতাবের ১৮৭ পৃষ্ঠায় এবং “মোতালেবে রশীদিয়ার” ১৪৩ পৃষ্ঠায় বর্নিত আছে যে, শায়েখ আবু সাঈদ আবুল খায়ের রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির মুরীদগণের মধ্যে কেহ হজ্ব করার বাসনা করলেন, তিনি তাদেরকে বলতেন, পীরে কামেল শায়েখ আবুল ফজল রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির মাজার শরীফের মাটি জিয়ারত করো এবং তাঁর চতুর্পাশ্বে সাতবার তাওয়াফ করো। তোমার সমস্ত মকসুদ হাছেল হবে।
হযরত সাইয়্যেদানা মীর আবুল উলা ভারতের মশহুর ও সর্বমান্য মাশায়েখ বা পীর ছিলেন। প্রথম নকশবন্দীয়ায় মুরিদ হয়ে আধ্যাত্মিক রাজ্যে বিশেষ উন্নতি না হওয়ায় অত্যন্ত পেরেশান ছিলেন। একদা তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের আদেশে ও খাজা গরীবে নেওয়াজ রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির আহ্বানে আজমীর শরীফে উপস্থিত হলেন। তিনি যখন রাত্রিতে মাজার শরীফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তখন দরজা বন্ধ ছিল। কিন্তু তিনি দরজার সামনে যেতেই আপনা আপনি দরজা খুলে গেলো। তিনি ভিতরে গিয়ে মাজার শরীফ চুম্বন করে তাওয়াফ করতে লাগলেন। এ অবস্থায় তিনি খাজা গরীবে নেওয়াজকে মাজার শরীফের উপর উপবিষ্ট দেখতে পেয়ে তাজিম সেজদায় পড়ে গেলেন। হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি তাকে “সাইয়্যেদানা” খেতাবে আহ্বান করে হাঁ করতে বললেন। তিনি হাঁ করলে হযরত খাজা বাবা গরীবে নেওয়াজ রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি নিজ হাতে তাঁর মুখে একটি লাল বর্ণের বস্তু প্রদান করলেন। তিনি তা খাওয়া মাত্র তাঁর রূহানী জগত রৌশনময় হয়ে গেলো। আরো অনেক প্রমাণাদি দ্বারা ইহা স্পষ্ট হলো যে, মাজার তাওয়াফ করা মাজারস্থ অলি-আল্লাহর আত্মিক নিছবত, ফয়েজ ও বরকত লাভের উদ্দেশ্যে অবশ্যই জায়েজ। তাওয়াফ শব্দের অর্থ কোনো জিনিসের চর্তুদিকে চক্কর দেয়া বা ঘুরা।
কাবা শরীফ ব্যতীত অন্য কোনো জিনিসের ইবাদতের নিয়তে তাওয়াফ করা শরিয়ত মোতাবেক নাজায়েজ। কিন্তু পীর-আউলিয়াদের মাজার ইবাদতের নিয়ত ব্যতীত মাজারস্থ অলির আত্মিক নিছবত, ফয়েজ ও বরকত লাভের উদ্দেশ্যে তাওয়াফ করা জায়েজ ও বৈধ- এ কথাটি শরিয়তের ভাষায় বলা হলো, যদিও ইহা একটি উৎকৃষ্ট ইবাদত। এ ব্যাপারে ইয়াজিদী, ওহাবী, মওদুদী তাবলিগপন্থী ধিকৃত মৌলবীদের অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচার হতে সবার সতর্ক থাকা জরুরী। নয়তো তাদের চক্রান্তে পড়ে ঈমান হারাতে হবে। উক্ত দলিলাদি দ্বারা প্রমাণ হলো মাজার জিয়ারত, তাওয়াফ করা, জিয়ারতের জন্য নিয়ত ও সফর করা সুন্নত। কোনো স্থানে নিয়ত ছাড়া সফর করা যায় না এবং কোনো কর্মই নিয়ত ছাড়া হয় না। নিয়ত হলো মনের সংকল্প বা ইচ্ছা। কাজেই কোনো সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ একথা বলতে পারে না যে, রঁওযা বা মাজার বা কবর জিয়ারত করা সুন্নত অথচ তা জিয়ারতের জন্য সফর করা বা নিয়ত করা নাজায়েজ। নবুয়তে যাদেরকে নবী-রাছুল বলা হয়, বেলায়েতে তাদেরকেই বলা হয় অলি-আউলিয়া। কাজেই অলি-আউলিয়ার মহব্বত যাদের দীলে নেই আল্লাহর রহমত হতে তারা অবশ্যই মাহরুম হয়ে আছে। শরিয়তে সে ভেদ-রহস্য গোপনই রয়ে গেল।
রঁওযা বা মাজার স্পর্শ বা চুম্বন করাঃ
রঁওযা বা মাজার শরীফ ফয়েজ ও বরকতের উদ্দেশ্যে স্পর্শ করে শরীরে মোচন করা বা চুমু দেয়া জায়েজ এবং সুন্নতে সাহাবা। বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ “ফতুহুল বারী” ৬ষ্ঠ খ-ে ১৫ পৃষ্ঠার সূত্রে “আহকামুল মাজার” কিতাবের ৫৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের মিম্বর শরীফ ও রঁওযা মোবারক চুম্বন করার বৈধতা সম্পর্কে ইমাম আহামদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রশ্নোত্তরে বলেন, “আমি ইহাতে ক্ষতির কিছু দেখছি না।” অর্থাৎ চুম্বন করা জায়েজ। মক্কা শরীফের শাফেয়ী মাযহাবভূক্ত ওলামাদের মধ্যে অন্যতম আলেম ইবনে আবিস সানাফ থেকেও কোরানুল করিম, হাদিস শরীফের বিশেষ অংশ এবং বুজুর্গানে দ্বীনের মাজার শরীফ চুম্বন করা বৈধ বলে বিধৃত আছে। একথা বিখ্যাত কিতাব “জা’আল হক”-এর ২০৬ পৃষ্ঠায়ও বর্ণিত আছে। খতিব ইবনে জামালার সূত্রে “প্রশ্নোত্তরে আকাঈদ শিক্ষা” বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু আপন ডান হাত নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারকে স্থাপন করতেন বরকত ও ছোয়াবের উদ্দেশ্যে। “আদিল্লাতু আহলিচ্ছুন্নাহ” কিতাবে বর্ণিত আছে যে, হযরত খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমাতুজ্জাহরা আলায়হিস সালাম আপন দু’গন্ড (গাল) নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারকের উপর স্থাপন করতেন। কোনো সাহাবীই তা নিষেধ করেননি। বিখ্যাত “তুশেখ” কিতাবে আল্লামা জালাল উদ্দীন সয়ুতী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি বলেছেন, হাজরে আসওয়াদের চুম্বন থেকে কতেক আরেফীন বুজুর্গানে কিরামের মাজার শরীফ চুমু দেওয়ার বৈধতা প্রমাণ করেছেন। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের ওফাতের পর হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু শোকে মদিনা ছেড়ে সিরিয়া চলে যান এবং জেহাদে অংশ গ্রহণ করে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। তিনি একদিন স্বপ্নে নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামকে দেখলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে বলছেন, “হে বেলাল! এটা কোন ধরনের জুলুম ও জফা (অত্যাচার এবং লা-ইনছাফি)! এখনো কি আমার জিয়ারতের জন্য তোমার আসার সময় হয়নি? তুমি আমাকে ছেড়ে কিভাবে দূরে থাকতে পারলে? স্বপ্ন দেখে হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু তৎক্ষনাৎ মদিনার পানে রওয়ানা হলেন জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। তিনি মদীনায় পৌঁছার সাথে সাথে খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু মদিনায় ফিরে এসেছে। হযরত ইমাম হাছান-হুসাইন আলায়হিমাস সালামও দৌঁড়ে আসলেন। হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু সোজা রঁওযা মোবারকে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং রঁওযা মোবারকে কপাল ঘষতে লাগলেন। এ ঘটনাটি বিখ্যাত কিতাব “জজবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব” এবং ইমাম তকিউদ্দিন সুবকীর “শেফাউস্ সাকামে” কিতাবে ৩৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে। ইবনুল জাওযীর “মীসার আল গারাম” সূত্রে “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দলিল” কিতাবের ৯৪ পৃষ্ঠায় এবং তাফসীরে কানজুল ঈমান ও খাজাইনুল ইরফানের প্রথম খন্ডের ১৭৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মদ বিন হারব আল হেলালী বলেন, “আমি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা শরীফের নিকট এসে তাঁর জিয়ারত করলাম এবং তাঁর বরাবর বসে পড়লাম। এ সময় একজন গ্রাম্য লোক এসে বলতে লাগলো, ইয়া রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম! আপনি বলেছেন, আর আমরা আপনার কথা শুনেছি। আপনি আল্লাহ থেকে বুঝে নিয়েছেন, আর আমরা আপনার থেকে বুঝে নিয়েছি। আপনার উপর নাযিল হয়েছিলো,“ওয়া লাও আন্নাহুম্ ইজ্জালামু আনফুসাহুম্ জা-উকা ফাসতাগফারুল্লা-হা ওয়াস তাগফারা লাহুমুর রাছুলু। লাওয়াজাদুল্ লা-হা তাওওয়া-বার রাহিমান” (আনÑনিসা, আয়াত-৬৪)। অর্থাৎ এবং যদি কখনো তারা নিজেদের নফসের প্রতি জুলুম করে এবং তোমার নিকট ফিরে আসে (এবং) আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং রাছুলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তা হলে তারা আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল (এবং) পরম রাহিম (দয়ালু) রূপে পাবে।- এ আয়াতটি। এখন আমি নিজের উপর জুলুম করেছি, আর আপনার কাছে আসলাম ; আমার জন্য একটু ক্ষমা চান। তখন রঁওযা থেকে আওয়াজ এলো তোমাকে মাফ করে দেওয়া হয়েছে। এ হাদিসটি আবু সাঈদ আস-সামআনী ও মাওলা আলী ইবনে আবি তালিব আলায়হিস সালাম হতে বর্ণনা করেছেন। “হৃদয় তীর্থ মদীনার পথে” কিতাবের ১৫৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে, মারওয়ান ইবনে হাকাম এক ব্যক্তিকে রঁওযা শরীফের উপর মুখমন্ডল রাখতে দেখে তার ঘাড় ধরে বললো, তুমি যে কাজটি করছ, তা কেমন জানো? লোকটি বলল, খবরদার আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আমার মুখমন্ডল কোনো পাথরের উপর রাখিনি; বরং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযার মাটির উপর রেখেছি। সে আরো বললো, আমি রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম হতে শুনেছি যে, দ্বীনের জন্য তখন ক্রন্দন করা উচিত, যখন শাসন ক্ষমতা অযোগ্য লোকের হাতে চলে যায়। হাফেজ আল ইরাকী তাঁর “ফাতুহুল মোতআল” কিতাবে তাঁর সনদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম ও অন্যান্যদের রঁওযা ও মাজার চুম্বন করা জায়েজ বলেছেন। তিনি বলেন, এটা ইবনে তাইমিয়া দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ফতোয়ায়ে আলমগীরির সূত্রে “জা’আল হক” কিতাবের ২০৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, নিজের মাতা-পিতার কবরে চুমু দেয়ায় কোনো ক্ষতি নেই অর্থাৎ বৈধ।
“ফতোয়ায়ে আলমগীরি”, “খাজিনাতোল রাওয়াজা”, “মাতালেবুল মুমিনীন” গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাছুল করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে বললো যে, হে রাছুল ! আমি প্রতিজ্ঞা করছিলাম যে, বেহেশতের চৌকাঠে ও হুরীর ললাটে চুম্বন করবো। কিন্তু আমি অতি পাপী, বেহেশতে যাওয়া আমার ভাগ্যে বোধ হয় নেই। এমতাবস্থায় কি করে আমার প্রতিজ্ঞা পালন করি। উত্তরে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বললেন, তুমি তোমার মাতার ললাটে ও পিতার পায়ে চুম্বন করো তবেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা হবে। সে বলল, হুজুর সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম! তারা তো কেউ জীবিত নেই। হযরত বললেন তাদের কবরে গিয়ে চুম্বন করো। সে আবার বললো, হুজুর তাদের কবরও জানা নেই। হুজুর বললেন তাদের উদ্দেশ্যে দু’টি নকল কবর মাটিতে দাগ কেটে বানিয়ে তাতে চুম্বন করো। এ বর্ণনাটি ইমাম সাবির “কেফায়া” গ্রন্থের মাঝেও বর্ণিত আছে।