পত্রিকা – আসরারে পাঞ্জাতন ১২তম সংখ্যা

হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী

ইবনে সা’দ সায়ীদ ইবনে মুসাইয়িব থেকে বর্ণনা করেন যে, আরবরা অতীন্দ্রিয়বাদী ও কিতাবধারীদের মুখ থেকে ‘মোহাম্মদ’ নামের একজন নবীর আগমন সম্পর্কে প্রায়ই শুনতো। যে-ই একথা শুনতো সে-ই নবুয়তের আকাঙ্খায় স্বীয় পুত্রের নাম ‘মোহাম্মদ’ রাখতো (খাসায়েসুল কুবরা-১ম খন্ড, ৪৬পৃষ্ঠা)।

হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, যখন রাছুলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম ভুমিষ্ঠ হলেন তখন চারজন স্ত্রীলোক আসমান হতে অবতীর্ণ হলো। তিনি তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা বললো, ‘আমি হলাম হযরত হাওয়া – তার হাতে ছিল একটি স্বর্ণের কড়াই, দ্বিতীয়জন বললো, আমি ইব্রাহীম নবী স্ত্রী সারাহ – তাঁর হাতে ছিল হাউজে কাওসারের পানি ভরা একটি রূপার পাত্র, তৃতীয়জন বললো, আমি হাজেরা (ইব্রাহীম নবীর দ্বিতীয় স্ত্রী)- তাঁর হাতে ছিল বেহেশতের আতর এবং চতুর্থজন বললো, আমি হলাম মাযাহেমের কন্যা আছিয়া (ফেরাউনের স্ত্রী)- তাঁর হাতে ছিল সবুজ রেশমের একটি রুমাল। তারা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামকে গোসল করিয়ে আমার কোলে দিলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহপাকের দরবারে সেজদায় পড়লেন এবং উঠে আসমানের দিকে হাত তুলে দোয়া করলেন, “হে আমার আল্লাহ, আমার উম্মতকে ক্ষমা করে দাও।” জবাব আসলো, ‘হে মোহাম্মদ, তোমার খাতিরে তাদেরকে ক্ষমা করে দিব। তবে যারা শিরক করবে, তাকে ক্ষমা করা হবে না। তারপর আল্লাহপাক ফেরেশতাগণকে বললেন, দেখো আমার হাবিব কতো হিম্মতওয়ালা, কতো উদারচেতা, জন্মের প্রাক্কালে তিনি তাঁর উম্মতকে ভুলেননি। তিনি কেয়ামতের দিনও তাঁর উম্মতকে ভুলবেন না।

হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম হতে আরো বর্ণিত আছে যে, শিশু মোহাম্মদ আমা হতে আলাদা হলেন এবং তাঁর সাথে বের হয়ে গেলো একটি নূর। তা আলোকিত করে ফেললো পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত সব কিছুই। অনন্তর তিনি পতিত হলেন উভয় হাতের উপর ভর করে জমীনের উপর। তিনি গ্রহণ করলেন এক মুষ্টি মাটি, তা আবদ্ধ করলেন মুষ্টিতে আর উত্তোলন করলেন মস্তক আসমানের দিকে। অন্য বর্ণনায় ইহাও রয়েছে যে, ‘তিনি এক হাত মাটিতে এবং এক হাত আসমানের দিকে তুলে ধরলেন।’ এর মানে তিনি জমীন হতে আসমানে ভ্রমনের ঈশারা দিলেন।

হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালাম হতে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম জন্মগ্রহণ করেন তখন আমি দেখতে পেলাম এক বিশাল জ্যোতির্ময় মেঘ। তাতে শব্দ হচ্ছে অশ্বের হ্রেষাধ্বনি, পাখির পাখার আওয়াজ। এক আওয়াজকারী আর মানুষের কথা বলার শব্দ। তা এসে শিশু মোহাম্মদকে আচ্ছাদিত করে ফেলল। তারপর আমি শুনতে পেলাম একজন বলছেন, ‘মোহাম্মদকে সমগ্র আলম ঘুরিয়ে আনো এবং তাঁকে স্থাপন করো মানব, দানব ও ফেরেশতাকূলের সামনে, যারা দৃষ্টির অগোচরে রয়েছে আর যাবতীয় বিহঙ্গ ও পশুকূলের সামনে (যেন প্রত্যেকেই তাকে উত্তমভাবে চিনে নেয়)।

ঐ আওয়াজকারী বলছে, এবং তাকে দান করো আদমের চরিত্র, শীশের মারেফাত, নূহের বীরত্ব, ইব্রাহীমের প্রগাঢ় অনুরাগ, ঈসমাইলের ভাষা, ইসহাকের সন্তুষ্টি, সালেহের বিশুদ্ধভাষিতা, লুতের হিকমত, ইয়াকুবের খোশ-খবর, মুসার কঠোরতা, আয়ুবের সবর, ইউনুসের পায়রুবী (বন্দেগী), ইউশার জিহাদ, ইউসুফের সৌন্দর্য, দাউদের মধুর কন্ঠ, দানিয়ালের প্রেম, ইলিয়াছের স্নেহ ও মহত্ব, ইয়াহইয়ার ইসমত (পাপহীনতা), ঈসার বৈরাগ্য এবং তাকে নবীগণের চরিত্রের সমুদ্রে অবগাহণ করাও।

হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালাম আরো বলছেন, যখন আমার দৃষ্টি হতে মেঘখন্ডকে অপসারিত করা হলো, তখন দেখলাম শিশু মোহাম্মদকে একখন্ড সবুজ রেশমী কাপড়ে উত্তমরূপে জড়িয়ে দেয়া হলো। তা হতে ঝর্ণার মতো পানি ঝরঝর করে পড়ছে এবং তাকে দেখলাম পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো উজ্জ্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। তাঁর শরীর হতে মৃগনাভির ঘ্রাণ প্রকাশ পাচ্ছে। আমি দেখতে পেলাম তিন ব্যক্তি, একজনের হাতে রূপার পাত্র, দ্বিতীয়জনের হাতে সবুজ বর্ণের জমরুদ পাথরের তসতরী এবং তৃতীয়জনের হাতে সাদা রেশমী কাপড়। তৃতীয় ব্যক্তি একটি আংটি বের করলেন এবং তাকে সাতবার গোসল করিয়ে তাঁর উভয় সিনার মধ্যবর্তী স্থানে ঐ আংটি দ্বারা একটি মোহর অঙ্কিত করে দিলেন (ইহাই মোহর-ই-নবুয়ত)।

সুতরাং হাবিবে খোদা মোহাম্মদ রাছুল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম হলেন জামে কামালতে সিফাত ও জাত। আল্লাহপাকের নিরানব্বই নামের মোজহার, লা-মাকানের এমকান, তিনি ইয়াছিন, তিনি নূর ও নুরের মোজাহার। এ হিজাব ধারণ করে জাতে পাকের জালোয়াই বর্তমান, যারা চক্ষুষ্মান তারা খোদাকে এ হিজাবের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছেন।

এরপর শিশু মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের জন্মের পরের দিন তাঁর দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব নাম রাখলেন ‘মোহাম্মদ’। অদৃশ্য জগত হতে তাকে এ নামই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোরাইশগণ তাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কেনো সন্তানের নাম ‘মোহাম্মদ’ রেখেছ ? কোনো বা পূর্বপুরুষদের কারো নামানুসারে এর নামকরণ করলে না ? এ নাম তো তোমার কওমে কারো নেই। তিনি বললেন, আশা এই, সে প্রশংসিত হবে জমীনে এবং আসমানে।

আবার কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল। যুরকানী শরীফে বর্নিত আছে, হযরত আমিনা আলাইহিস সালাম বলেন, “এক রাতে আমি ঘুমঘোরে দেখলাম, কে একজন তাকে বলছে, তোমার গর্ভে অবস্থান করছেন সাইয়্যেদুল আলামীন ও মানবকুলের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। যখন তাঁকে প্রসব করবে তখন তাঁর নাম রাখবে ‘মোহাম্মদ’।” তাওরাতে তাঁর নাম ‘হামিদ’ এবং ইঞ্জীলে তাঁর নাম ‘আহামদ’। এ ‘মোহাম্মদ’ নামই আল্লাহর নির্দেশে চারশত বৎসর পর্যন্ত কলম লিখেছে আরশ মোয়াল্লার উপর। এক বর্ণনায় এসেছে কলম ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ চারশত বৎসর পর্যন্ত লিখে থেমে গেল। আল্লাহপাক বললেন, এরপর লিখ ‘মোহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ’। কলম আরজ করলো, হে আল্লাহপাক ‘তুমি বে-মেছাল, তোমার সমকক্ষ কেউ নেই ; তোমার নামের সাথে যে সম্মানিত নামটি বিরাজ করছে, তা কার নাম ? আল্লাহপাক বললেন, ইহা আমার হাবিব মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের নাম। অতঃপর কলম ভয়ে কেঁপে উঠে বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং চারশত বৎসর পর্যন্ত লিখলো ‘মোহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ।’ সকল সৃষ্টির আদিতে তাঁকে আল্লাহপাক এমন নূর হতে সৃষ্টি করেছেন, যার পূর্বে কোনো কিছু আল্লাহপাক সৃষ্টি করেননি। সৃষ্টির অস্তিত্ব হিসেবে তাঁরই ছিল প্রথম প্রকাশ। এজন্যই ইহা সর্ব পুরাতন-কদিম। প্রথম সৃষ্টি হিসেবে তাঁর পূর্বে কিছু নেই। এ নূর হতেই সমস্ত সৃষ্টির সৃজন হচ্ছে, ইহাই আদি নূর তথা জাত-ই- কদিম। আল্লাহপাকের নূরের প্রবাহিত ও বিকশিত নূর হলো ‘মোহাম্মদ’। এ দিকে লক্ষ্য করে রাছুল তাঁর পরিচয় দিলেন, ‘আনা মিন নূরীল্লাহ্’-আমি আল্লাহর নূর হতে।

সিরাত গ্রন্থগুলোতে রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের জন্মগ্রহণের সময়ে যে সমস্ত ঘটনাবলী প্রকাশ পেয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে- যা উল্লেখ করলে এক বিশাল গ্রন্থ হয়ে যাবে বিধায় থেমে যেতে হলো। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের জন্মের পর তিনি তাঁর মাতা হযরত আমিনা আলাইহাস্ সালামের দুধ পান করেন সাতদিন এবং আবু লাহাবের দাসী ‘সোয়েবাহ’ আট দিন দুগ্ধ পান করিয়ে ছিলেন। তারপর তায়েফ শহরের বনী হাওয়াযেন গোত্রের হযরত হালিমা সাদিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর দুগ্ধ পান করেছিলেন এবং হযরত হালিমা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা ধন্য হলেন নবীজির সংষ্পর্শ পেয়ে। তবে তারা ‘বনী ছাদ’ বলেই বিখ্যাত ছিলেন তাঁর স্বামীর নাম ছিল হারিস। হযরত হালিমা ধৈর্যশীল, বুদ্ধিমতি ও অনেক সুন্দরী ছিলেন এবং দয়া মায়ায় বিখ্যাত ছিলেন। হযরত হালিমা শিশু মোহাম্মদকে মক্কায় নিয়ে আসার পথে তাকে একটি গাছের নীচে বসিয়ে পায়খানা করার জন্য দূরে চলে গেলেন, তার একটু দূরেই ছিল কিছু লোক। তারা নবীজিকে হত্যা করার জন্য তার সন্ধানে বের হয়েছিল। এ সময় জিবরাইল এসে শিশু মোহাম্মদকে শত্রুদের হাত হতে রক্ষার করার জন্য শূন্যে তুলে নিলেন এবং আড়াই দিন পর্যন্ত রেখেছিলেন। হযরত হালিমা এসে মোহাম্মদকে অনেক খোঁজাখুজি করেও না পেয়ে অনেক পেরেশান হয়ে মক্কায় গিয়ে খাজা আবদুল মুত্তালিবকে এ সংবাদ জানালেন। খাজা আবদুল মুত্তালিব শুনে কাঁদতে শুরু করলেন এবং খোলা তলোয়ার নিয়ে নিকটে এক পাহাড়ে উঠে সমস্ত কোরাইশীগণকে চিৎকার করে ডেকে একত্রে জড়ো করে ঘটনা খুলে বললেন। ঘটনা শুনে সবাই প্রতিজ্ঞা করলো যতোক্ষণ মোহাম্মদকে পাওয়া না যাবে ততোক্ষণ তারা কোনো খানা-পানি গ্রহণ করবে না। তারপর একশত কোরাইশী সঙ্গে নিয়ে কাবা ঘরে গিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় নাতীকে ফিরে পাবার জন্য। এ সময় গায়েব হতে আওয়াজ এলো, ‘হে মুত্তালিব! তুমি ব্যাকুল হইও না, আল্লাহর হাবিবকে কেহ হত্যা করতে বা লোপ করতে পারবে না। তুমি তাকে ‘তেহামা’ ময়দানে খোঁজ করো।’ এ শব্দ শুনে সবাই তেহামা ময়দানে গিয়ে দেখতে পেল শিশু মোহাম্মদ একটি গাছের নীচে আনন্দে খেলা করছে।

আপন খবর