পত্রিকা – শানে আহলে বাইয়্যেত (পর্ব ০১)

কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী

আল্লাহপাক অনাদি অনন্ত অসীম অব্যয়। তিনি আউয়াল, আখের, জাহের ও বাতেন চার আকসামেই বিরাজমান। তিনি সর্ব সৃষ্টিতে পরিব্যপ্ত হয়েও এক অদ্বিতীয়। সর্ব কিছুর অস্তিত্ব/রূপ/নকশা/শেকেল তাঁর হতে এবং তাঁরই মুখাপেক্ষী, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নয়। অসীম হতে সীমের মধ্যে নিত্য লীলায় ক্রিয়াশীল। তিনি রূপে এসেও রূপাতীত, বর্ণনাতীত (লাইছা কা মিছলিহী সাইয়্যুন) এবং মানবাত্মা-পরমাত্মার সম্মিলনে অহেদাল অজুদে তিনি তাঁর রূপ/শেকেল প্রকাশ করছেন (তাঁর সাদৃশ্য নেই তবে সদৃশ আছে)। জ্ঞানীগণ তাঁর ভেদ-রহস্য জানেন এবং খোদাকে চিনেন, দেখেন। নিঃশব্দ, নিস্তদ্ধ জগত হতে স্বীয় রূপ দরশন করণার্থে স্বীয় এশকে নিজেই ফানা হয়ে নিজেই নিজের মাশুক সাজেন।

‘আশেক-মাশুক শুধু একটি হিজাবের ব্যবধান,
একই নূরের প্রকাশ ও বিকাশ।’

প্রকাশ ও বিকাশের ধারাটি গঞ্জমুখফিতে অব্যক্ত-অপ্রকাশ-অদৃশ্য ছিল। আপন পরিচয় নিতে তাতে জোশ-হরকতের সৃষ্টি হলো। সাফা হতে বাতাসের প্রকাশ হলো এবং সাফা-বাতাসের সংঘর্ষে (ইয়াখরুজু মিনহুমার জোশে) আতশের জহুর হলো। সেখানে শহুদের তরঙ্গের জোশে বান উঠে আবের ছুরত হয়ে গেল। সেই আব/পানি বাগে এরেমে আশ্রয় নিল। এবার আহাদ হুবাব হয়ে গঞ্জমুখফি হতে নয়টি স্তর (নয় বাতুন) অতিক্রম করে শেষে আজসাম অজুদ পাইল। ছিল আহাদ মুখফি, শেষে পাইল আজসাম অজুদ। জ্ঞানী (আলেমগণ) যারা তারা চিনতে পেল এই তো সেই গঞ্জমুখফি নূর। সেই এই হয়ে রজ্জব নাম ধারণ করেছে। আহামদে এসে স্বীয় নিত্য লীলায় রতো হয়েছেন। আহাদ নামটি আলাদা করে ঐ আহামদে ‘মীম’ রূপ ধারণ করে। ঐ ‘মীমের’ মধ্যে পাঞ্জাতনের রূপ-শেকেল নিয়ে পঞ্চশক্তি বিরাজ করছে। ‘তাই পাঞ্জাতনের পঞ্চশক্তি এ সৃষ্টির সৃজনের মূল নিয়ামক।’ এ পাঞ্জাতনের সম্মিলনেই শাজরাতুল ইয়াকীন নাম ধরে। ঐ শাজারাতুল ইয়াকীন গাছে এরফানী আয়নায় স্বীয় রূপ দরশন করেন। তাই তিনি মানবীয় স্তরে প্রয়োগহীন নূর প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজেই নিজের রূপ দরশন করে/ইচ্ছা পূরণ করে ‘খাতামান্ নাবীয়্যিন’ ঘোষণা করলেন।

তিনিই হাইউন, তিনিই সামিউল-আলিম, সামিউন-বাসির। তিনিই আজ্জাতু কুল্লুহু আলিমুন, আজ্জাতু কুল্লুহু মুরিদুন, আজ্জাতু কুল্লহু কাদিরুন। তিনিই জাত ও সেফাতের আদিবস্থা জাত আহদিয়াত। হাইউন সেফাত হতে জাত সাফা, বাতাস, আতশ, আব এবং খাকের প্রকাশ ও বিকাশ পেয়েছে। ইহা সৃষ্টির আদি প্রকাশ। সাফা হতে বাতাস, বাতাস হতে আতশ, আতশ হতে আব/পানি এবং পানি হতে খাক বা মাটির প্রকাশ পেয়েছে। তিনিই আল-লা-হু। সমস্তই নফী, হু ব্যতিত। হু-ই সাফা, হু-ই বাতাস, হু-ই আতশ, হু-ই আব, হু-ই খাক। এ খাক-ই সেই আদি নূরের প্রকাশ। সুতরাং লাইছা ফিদ্দুরাইনে ইল্লাহু। অথবা ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহু, ‘হু’-ই’ নাযিল/প্রকাশ ও বিকাশ হয়েছে বিধায় এ ‘হু’-ই হুয়ায জাহিরু। ‘হু’ সৃষ্টি লীলায় স্বরূপ দর্শনার্থে/স্বীয় ইচ্ছা পূরণ করার বাসনায় ‘ফি লাইলাতুল মোবারাকাতে/শবে বরাতে/বিজ্ঞানময় ভাগ্য বন্টনের রাতে স্থিত। এখান থেকে বস্তু সত্তা আত্মাসহ ‘লাইলাতুল কদরে এসে ‘হু’-এর প্রকাশ ঘটে। এখানেই পবিত্র রমজান মাস-যেখানে রমজানের সিয়াম সাধনায় খোদাকে লাভ করা যায়। হাদিস বলছে, “যারা রমজান পাবে তারা যেন সিয়াম সাধনা করে।” এ মাটিই সমস্ত কিছুর মূল/পাত্র। পাঁচ পাত্রে একই রুহ পাঁচ রুহ নামে প্রকাশিত আছে এবং সৃষ্টি লীলায় মাতোয়ারা আছে।

‘এ সৃষ্টি জগত আত্মার ভ্রমণের স্থান। তিন জমাত অতিক্রম করে ইনছানিয়াতে উত্তরণ ঘটিয়ে মানবাত্মা মুক্তি লাভ করছে।’ মৃত্যু নামক ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে প্রমোশন-ডিমোশন হচ্ছে তথা মৃত্যুঞ্জয়ী নয়তো আস্ফালা সাফেলিন হচ্ছে। ৫+২৫+৩+৭ = ৪০ ই হলো সৃষ্টির নিয়ামক। এ চল্লিশ কদম দ্বারা সৃষ্টির হাশর হচ্ছে, মৃত জিন্দা হচ্ছে। তার মধ্যে পাঁচই হলো মূল। হাশরের পর নশর না হলে আবার তিন জমাতে ঘুরতে হবে বা সিজ্জিনে বাস করতে হবে। মানবাত্মায় মৃত্যুঞ্জয়ী – ইল্লিনে বাসস্থান, নয়তো বাকি তিন জমাতের সিরাত অনুসারে ছুরত পেয়ে সিজ্জিনে অবস্থান করে কর্মফল ভোগ করতে হবে। যে সিরাতে দেহপাত হবে ঐ সিরাতে এবং ঐ জমাতেই তার বাসস্থান সাব্যস্ত হবে। পুণরুত্থান হবে চল্লিশ কদমের উপর। তার মধ্যে মাওলা আলীর বেলায়তী শক্তি সিররীর গুণ ক্রিয়ায় সৃষ্টিলীলা পরিচালিত/পরিবাহিত হচ্ছে। শোহ্হত, মেহের এবং গোস্বাÑ সাফার গুণ খাছিয়ত দ্বারা সৃষ্টি – অস্তিত্ব এবং ধ্বংস- এ তিন কার্য সাধিত হচ্ছে। এ সৃষ্টিতে বস্তু-গুণ ছাড়া আর কিছুই নেই। ‘বস্তু-গুণের সমষ্টিতে সৃষ্টির প্রকাশ ও বিকাশ হয়ে চলছে, তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ হলো মুহাম্মদ।’ এখানেই সৃষ্টির বিবর্তন ধারা সমাপ্ত Ñ আল্লাহর ইচ্ছা পূরণের ক্ষেত্র। এ পাঁচ বস্তুতে পাক পাঞ্জাতন এবং তা হতে আদম অজুদ গঠন করে আরশ মোয়াল্লায় রেখে দিলেন আল্লাহপাক। আল্লাহর সিরাত হতে ছুরত পেয়ে অবিকল সৃষ্টি আদম। আদম ছুরতই ওয়াজহুল্লাহ। ইয়াকিন এবং অন্তর্চক্ষু দ্বারা তা দেখা যায়।

‘যখন আদমকে সৃষ্টি করলেন এবং তাতে রুহ ফুকে দিলেন, তখন আদম চেতন হলো। আদম আলাইহিস্ সালাম চেতন হয়ে বা চেতন পেয়ে আরশে মোয়াল্লার দিকে তাকিয়ে ঐ পাঁচটি নূর দরশন করে বললেন, হে আল্লাহপাক, ঐ পাঁচজন কারা ? তাদের কি আমার থেকে সৃষ্টি করেছেন নাকি আমার আগেই তাদেরকে সৃষ্টির করেছেন? আল্লাহপাক বললেন, হে আদম ! আমি যদি তাদেরকে সৃষ্টি না করতাম (লাওলাকা নবীতে পাঁচের সমাবেশ ঘটেছে-ঐক্যতায় স্থিত আছে) তবে তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না। হযরত আদম আলাইহিস সালাম তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। আল্লাহপাক বললেন, হে আদম ! ইনারা হলেন মুহাম্মদ, আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন। প্রথমজন আমার হাবিব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম এবং সে হলো তোমার বংশধারায় নবীদের শেষ নবী, মোহরযুক্ত নবী। আর বাকি চারজন হলো তাঁর আহলে বাইয়্যেত (নির্দিষ্ট ঘরের অধিবাসী)।’

এ পাক পাঞ্জাতন দিয়ে একটি খাঁচা তৈরী করে ঐ খাঁচাতে আদমকে রাখলেন। ওয়াহেদ হতে আহাদের প্রকাশ। আহাদের মধ্যে মীম যুক্ত হয়ে হলো ‘আহামদ’ এবং আহামদে ছানী মীম যুক্ত হয়ে হলো মুহাম্মদ। মুহাম্মদের আদি রূপ আহামদ, আহামদের আদি রূপ আহাদ এবং আহাদের আদি পরিচয় ওয়াহেদ আল্লাহ (সুরা এখলাছ)। বেলায়েতে খফির ঘর মুহাম্মদ। সে মুহাম্মদী ঘরের চারজন হল আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন আলাইহিমুস্ সালাম। বেলায়তী পাক পাঞ্জাতন মূলতঃ দু’পাওয়ালা মানুষ নয়, ওরা হলো আদি নূরের প্রকাশ ও বিকাশ। পঞ্চ নূরের প্রতীকে আছে নবুয়তী বাশারী পাক পাঞ্জাতন। এক নূর পাঁচ স্তরে প্রকাশ ও বিকাশ (তানাজ্জুলাত-ই-খামছা) লাভ করছে। বেলায়তী জগত হতে আসমানী জগতে প্রকাশ, শেষে নবুয়তে এসে দুনিয়ার মানুষ আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন নূরের প্রতীকে প্রকাশ। এর মধ্যে মদিনাতুন্নবীতে এক মহাশক্তি গুপ্ত-সুপ্ত হয়ে আছে। সেই মহাশক্তির প্রকাশ নবুয়তে দুনিয়ার মানুষ মাওলা আলী বিধায় মাওলা আলী হলেন শক্তির প্রতীক। এ পঞ্চ শক্তি আদি নুরের প্রকাশ ও বিকাশ এবং তার হরকত-কুদরতে বিশ্বের সমস্ত কার্যই সাধিত হচ্ছে। এখান থেকে প্রত্যেকেই যার যার আসমানী গুণ প্রকাশ করছেন। আল্লাহপাক বলেন, আমি তাদেরকে পাক করে সৃষ্টি করেছি বিধায় তাদেরকে বলা হয় পাক পাঞ্জাতন। নূরের প্রতীকে দুনিয়ার মানুষ আহলে বাইয়্যেত সম্পর্কে সুরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক নিজেই বলছেন, “ইন্নামা ইউরিদুল্লাহু লিইউয্হিবা আনকুর্মু রিজ্বসা আহ্লাল্ বাইতি ওয়া ইউত্বাহ্হিরাকুম তাত্বহিরা।” অর্থাৎ (হে) আহলাল বাইয়্যেতি (আহল আল বাইয়্যেতি – নির্দিষ্ট ঘরের অধিবাসী) নিশ্চয়ই আল্লাহপাক তোমাদের হতে অপবিত্রতা/কলুষ-কালিমা (রাজাস) অপসারণ (ইয্হাব) করে ফেলতে এবং তোমাদেরকে বিশোধন বা পবিত্রকরণ (তহুর) করতে ইচ্ছা (ইরাদা) করেন, একটি শুদ্ধি (তাত্হির) কর্ম দ্বারা । “আয়াতে তাত্হির’ মোতাবেক রাছুলের আহলে বাইয়্যেত হলেন মাওলা আলী, ফাতেমা, ইমাম হাসান ও হুসাইন এবং তাদেরকে আল্লাহপাক নিজেই আহলাল বাইয়্যেত (খফির ঘর মুহাম্মদ-সে ঘরের অধিবাসী বলছেন-যাদের উপর মুহাম্মদী সত্তার ভিত্তি) বলে ঘোষণা করেছেন। এ কথা সৃষ্টির আদিতেই লওহ মাহফুজে চিরবর্তমানস্বরূপ লিখিত। হাকিকতে ডুব দিয়ে দেখলে দেখা যাবে তাদের কারো শান-মান-মর্যাদা কারো থেকে বিন্দু মাত্র কম নয়। একই নূরের প্রকাশ ও বিকাশ ভিন্ন ভিন্ন নামে, ছোট বড় সাব্যস্ত করা বাতুলতা বৈ নয় । ‘আলামিন’-জগতসমূহ, জগতসমূহের অস্তিত্ব পাক পাঞ্জাতন হতে। এ আয়াত মোতাবেক নবীর আহলে বাইয়্যেতকে পাক সাব্যস্ত করা হয়েছে। আহলে বাইয়্যেতের বিষয়ে মেশকাতের ১১তম (বঙ্গানুবাদ) হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস হতে বর্ণিত, রাছুল সা. বলেন, “আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন আ. হলো আমার আহলে বাইয়্যেত।”

“ছিরাতুল আইম্মা সাজাবানী” কিতাবের ১১৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে, রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম বলছেন, “আল হাসান ওয়াল হুসাইন কুররাতুল আইনানী।” অর্থাৎ হাসান এবং হুসাইন হলো আমার চোখের শীতলতা। হাসান ও হুসাইন হতে আহসান হয়ে দু’য়ের সমষ্টিতে মুহাম্মদী ছুরত প্রকাশ করছে (তিরমিযি, মেশকাত-৫৯১০) এবং ইনারাই হলেন ‘ইবনে রাছুল’ তথা রাছুলের পুত্র (তিরমিযি সূত্রে মেশকাতের-৫৯০৫)। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম ইমাম হাসান ও হুসাইন আলাইহিমাস সালামকে জান্নাতের প্রধান/সরদার/নেতা/সাইয়্যেদ বলে জানাচ্ছেন এবং ইনারাই হলেন মুহাম্মদী নূরী বাগানের দু’টি সুগন্ধময় ফুল (তিরমিযি, বঙ্গানুবাদ মেশকাত-৫৯০৩-৪),Ñ যাদের মাধ্যমে ‘সিবগা’ প্রকাশ ও বিকাশ হচ্ছে।

রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালামের প্রিয় বস্তু হলো, নারী, ছালাত এবং সুগন্ধি। কি সুন্দর বিজ্ঞানময় কালাম রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম প্রকাশ করছেন। প্রত্যেকটি মুক্তিকামী মানুষের পথ ইহা। এ সম্পর্কে বিস্তারিত হাদিস এবং তার ইতিহাসটি যদি কারো জানার ইচ্ছা থাকে তবে “বেঁহুশের চৈতন্য দান” কিতাবটি পড়ে দেখতে পারেন, আপনার জীবনের একটি বৃহৎ ভুল আশা করি ভেঙ্গে যাবে। যারা আহলে বাইয়্যেত বলতে নবীর স্ত্রীগণকে বুঝাতে চায় ওরা কোরানের হাকিকত/মুহাকামাত বুঝেনি, তাই এ ধরনের লেজেগুবুরে দশা, ধর্মশাস্ত্রের আক্ষরিক ব্যাখ্যা-বয়ানের কুফল ইহা। কোরানের আয়াত দলিলস্বরূপ তুলে ধরে ঠিকই কিন্তু রূপকের (তাশাবাহার) অর্থ করে তথা আক্ষরিক অর্থ তথা সরাসরি যা আছে তাই বুঝিয়ে থাকে। চিরন্তন-শাশ্বতকালের আহলে বাইয়্যেতকে ওরা চিনেনি, চিনেনি বেলায়তী, আসমানী এবং নবুয়তী জগতে তাদের পরিচয় কি। চিনেনি পঞ্চ নূরের প্রতীকে প্রকাশ দুনিয়ার মানুষ মুহাম্মদ-আলী-ফাতেমা-হাসান ও হুসাইনকে। হযরত রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম একদিন হযরত উম্মে ছালমা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহার ঘরে গিয়ে বললেন, ছালমা ! আমার কালো ইয়ামনি চাদরটি নিয়ে এসো। তিনি চাদর নিয়ে আসলেন এবং রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালামকে দিলেন। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম সে চাদরটি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ডাকলেন, আইনাল আলী ! মাওলা আলী আলাইহিস সালাম এসে বললেন, লাব্বাইক ইয়া রাছুলুল্লাহ। তাকে তিনি চাদরের ভিতরে প্রবেশ করালেন। এভাবে তিনি ফাতেমা, হাসান এবং হুসাইনকে ঐ চাদরের ভিতর ঢুকিয়ে নিলেন। এমন সময় হযরত উম্মে ছালমা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা বললেন, ইয়া রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম ! আমি কি এর ভিতরে আসতে পারি ? রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম বললেন, না, তুমি সত্যের উপরই আছ। তখন রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম বললেন, হে আল্লাহ ! এরাই হলো আমার আহলে বাইয়্যেত। তখন আল্লাহপাক আয়াত নাযিল করলেন, “কুল লা আছআলুকুম আলাইহি আজরান ইল্লা মাওয়াদ্দাতা ফিল কুরবা (সুরা শুরা. ২৩)। অর্থাৎ (হে নবী) ! আপনি বলুন, আমি আমার আহ্বানের (নবুয়ত প্রচারের) জন্য উজরত (বিনিময়/পারিশ্রমিক) হিসেবে তোমাদের (উম্মতের) নিকট কোনো কিছু চাই না, শুধু আমার আহলে বাইয়্যেতের/নিকটবর্তীগণের ভালোবাসা ব্যতিত। এ আয়াতকে বলা হয় ‘আয়াতে মাওয়াদ্দাতা’ বা ভালোবাসার আয়াত। এ আয়াত নাযিল হবার পর সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে রাছুল ! আপনার নিকটবর্তীজন কারা ? যাদের প্রতি মহব্বত রাখা আমাদের জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে ! রাছুল সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম বললেন, আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইনই হলো আমার আহলে বাইয়্যেত। সিররি, রুহী, ক্বালবী এবং জলি বেলায়েতের জগত হতে নবুয়তের জগতে নাম ধরলেন আলী, ফাতেমা, হাসান এবং হুসাইন। মুহাম্মদী নূরের চারটি প্রবাহিত রূপ হলেন তাঁর আহলে বাইয়্যেত। ঘরের অধিবাসী তথা হিজাবে মুহাম্মদীর মধ্যে চার নূরের অবস্থান তথা নবুয়তী কালো চাদরের ভিতর চারজন। নবুয়তী এ চাদরটি শাশ্বতকালের চাদর (ইয়ামনী কালো চাদরের প্রতীকে আছে)-এর মধ্যে রয়েছে শাশ্বতকালের আহলে বাইয়্যেত। আল্লাহপাক তাঁর হাবিবে খোদা মুহাম্মদ রাছুলের নূর মোবারক সৃষ্টি করে আরশে রেখে দিলেন। যখন আদমকে সৃষ্টি করা হলো তখন ঐ নূর আদমের পেশানীতে স্থাপন করা হলো। আদম হতে পাক মুমিন-মুমিনাতের মাধ্যমে হযরত আবদুল মুত্তালিব আলাইহিস সালামের নিকট পৌঁছে যায়। বাদশাহ আবরাহা যখন কাবা ঘর ভেঙ্গে ফেলতে আসে তখন হযরত আবদুল মুত্তালিব আলাইহিস্ সালাম কয়েকজন লোক নিয়ে সরির পর্বতে উঠেন এবং সেখান থেকে কাবা ঘরের দিকে দৃষ্টি দিলেন, সাথে সাথে তাঁর পেশানী হতে একটি নূর বের হয়ে কাবা ঘরের উপর গিয়ে পড়লো। তখন হযরত আবদুল মুত্তালিব আলাইহিস্ সালাম সবাইকে বললেন, চলো আমরা চলে যাই ; এ কাবা ঘর কেহ ভাঙ্গতে পারবে না, আল্লাহর ঘর আল্লাহই রক্ষা করবেন। এরপর বাদশাহ আবরাহা কাবাঘর ভাঙতে গিয়ে স্বসৈন্যে আবাবিল পাখির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। সুরা ফিলে তার বর্ণনা রয়েছে। কোরানের প্রত্যেকটি ঘটনা/কিস্সা চিরন্তন-শাশ্বতকালের, অখন্ড কালের ঘটনা। যেহেতু এ সমস্ত ঘটনা চিরন্তন-শাশ্বতকালের ঘটনাবলী, তাই কোরানকে ‘কাসাসুল কোরান’ বলা হয়।

কিস্সা কোরানের ভেদ বর্তমান এবং সে চিরবর্তমানকে যারা চিনে না, জানে না তারা কোরানের জ্ঞানে জ্ঞানী নয়। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম বলেন, আমার আগমনের বংশধারায় কখনো অপবিত্রতার ছোয়া নেই, পবিত্র মুমিন- মুমিনাতের মিলনের মাধ্যমে আমার আগমন। সুতরাং বলা যায় হাবিবে খোদার নূর বহনকারী সবাই দ্বীনে হানিফের অন্তর্ভূক্ত বিধায় তাদের নামের সাথে ‘হযরত’ এবং ‘আলাইহিস্ সালাম’ ব্যবহার করাই সঙ্গত। খাঁটি সুন্নী আলেমগণ হযরত আবদুল মুত্তালিব এবং হযরত আবু তালিবের নামের শেষে ‘রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। অপর কারণটি হলো আল্লাহপাক নিশ্চয়ই তাঁর হাবিবের নূর মোবারক কোনো কাফের বা অপবিত্র নর-নারীর মধ্যে স্থানান্তরিত করেননি, রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালামের বর্ণনা হতেও তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। হযরত আবদুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম হতে সেই নূর দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ হযরত আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালামের নিকট আর অপর ভাগ হযরত আবু তালিব আলাইহিস সালামের নিকট চলে যায়। হযরত আবদুল্লাহ আলাইহিস্ সালাম হতে হাবিবে খোদা মুহাম্মদ রাছুল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম এবং হযরত আবু তালিব আলাইহিস সালাম হতে নূরের দ্বিতীয় ভাগ হযরত মাওলা আলী আলাইহিস্ সালাম আগমন ঘটে এ ধরাধামে। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম স্বীয় পরিশুদ্ধ (খান্নাছমুক্ত) নফসের স্বরূপ দেখবার বাসনার্থে হযরত ফাতেমার আগমন। আলী-ফাতেমার সম্মিলনে হাসান ও হুসাইনের আগমন ঘটেছে। বেলায়তী জগত হতে পাক পাঞ্জাতন নবুয়তে এসে রূপ সাগরের নিত্য লীলায় রতো আছে। এ হুসাইনই হলেন সমস্ত কিছুর মূল/অস্তিত্বের ধারক-বাহক। হুসাইন হতেই কালেমা, যাকাত, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব প্রচার হচ্ছে। তাই রাছুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম বললেন, “আনা ওয়া আলীউন নূরীন্ মিন ওয়াহিদ।” অর্থাৎ আমি এবং আলী এক নূরের দুই খন্ড। হাকিকতের জগতে ইহাই চিরসত্য। আদি নুরের দ্বিতীয় প্রকাশটিই হলেন মাওলা আলী আলাইহিস সালাম। নূরের দু’ভাগ হলো কেনো ? কারণ, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম নবুয়ত প্রচার করার সময় কাফেরগণ সবাই তাকে ধিক্কার দিবে, বিদ্রুপ করবে, অস্বীকার করবে তখন পাক পাঞ্জাতনের সদস্য-নূরের দ্বিতীয় প্রকাশ একমাত্র মাওলা আলী তাঁর সত্যতার সাক্ষী দিবে, তার সাহায্যকারী হবে। তাই একই নূর হতে বিভক্ত হয়ে নবূয়তের সাক্ষীস্বরূপ মাওলা আলী আলাইহিস্ সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কালেমা শাহাদাতের ভেদ জানলে একথা স্পষ্ট হয়ে যাবে। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত মাওলা আলী (ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাতা-পৃষ্ঠা-৬২, মেশকাত, বাবে আহলে বাইয়্যেত অধ্যায়) এবং মেয়েদের মধ্যে হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহা হলেন রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালামের নবুয়তের স্বীকৃতদানকারী তথা মুসলমান।

যারা বলছে ছেলেদের মধ্যে আলী আলাইহিস সালাম প্রথম মুসলমান আর বয়স্কদের মধ্যে হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু প্রথম মুসলমান ওরা গোমরাহ, মতলববাজ। ইসলাম গ্রহণের মধ্যে যুবক-বৃদ্ধ নেই। এগুলো যারা বলে তাদের উদ্দেশ্য হলো যে কোনো প্রকারেই হোক আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে প্রথম কাতারে রাখতেই হবে। তারই পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক নবীর নূরের অংশ, আহলে বাইয়্যেতের প্রধান, নবীর পরেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, মেছালে হারুন, আল্লাহ ও তাঁর রাছুলের নির্বাচিত খলিফাকে/ওয়াছি/মাওলাকে অস্বীকার করে স্বীয় মতলব/স্বার্থানুকূলে খলিফা নির্বাচিত করা হয়েছিল। ৭২ ফেরকার সূচনাকারীগণ তা মেনে নিয়েছিল, এখনো মেনে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয় ভবিষ্যতে যাতে কেহ তার প্রতিবাদ করতে সাহস না পায় সেজন্য কাফের/ মুনাফেক/মুরতাদ ইত্যাদি ফতোয়ার কুৎসিত কাদাগুলোও প্রস্তুত রেখেছে, প্রয়োজন হলেই রক্তচক্ষুর কসরত দেখিয়ে ফতোয়ার ডিগবাজি খেলে বানর নৃত্য প্রদর্শন শুরু করে দিবে। তাদের দ্বারাই ইসলামে ৭৩ ফেরকার সূত্রপাত ঘটেছিল। দেখুন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম নবুয়ত পাবার পর যখন মক্কার লোকদেরকে (আবু লাহাব-আবু জাহেলসহ) দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালেন। খাবার শেষে রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছালাম সবাইকে বললেন, আমি যদি বলি ঐ পাহাড়ের পিছনে শত্রু আছে আমাদেরকে আক্রমণ করবে; আপনারা কি বিশ্বাস করবেন ? সবাই বললো, হ্যাঁ, বিশ্বাস করবো। কারণ, তুমি সত্যবাদি, কখনো মিথ্যা বলোনি। তখন আল্লাহর রাছুল বললেন, তাহলে আপনার সবাই শুনুন এবং বলুন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ – এ তাওহিদ কালেমাকে স্বীকার করে নিন। এবং দেব-দেবী অসার তারা কারো কোনো উপকার বা অপকার করতে পারে না, সে পাথরের মূর্তি পুজা ছেড়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করুন। তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, মুক্তিদাতা। আপনারা আল্লাহপাকের এ তাওহিদ কালেমা স্বীকার করে নিন। তাতে কেহ-ই সাড়া দিল না।

আপন খবর