সালমা আক্তার চিশতী
জেরার মসজিদ হলো ষড়যন্ত্রের মসজিদ – যা বনী গানেম গোত্রের মুনাফিকদের দ্বারা তৈরী করা হয়েছিল। রাছুল (সাঃ) সেই মসজিদ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। কোরান মাজিদের সূরা আত তওবা এর ১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে – “মা কানা লীল মুশ্রিকীনা আন্ ইয়ামুরূ মাসাজিদাল্লাহি শাহিদীনা আলা আন্ফুসিহীম বিল কুফরি। উলাইকা হাবিতাত আমালুহুম, ওয়া ফীন্নারিও হুম খালিদূনা।” অর্থাৎ মুশরেকরা নিজেরা নিজেদের উপর কুফরীর সাক্ষ্য দেওয়া অবস্থায় আল্লাহর মসজিদ নির্মাণ করিবার অধিকার কিভাবে লাভ করিবে ? উহাদের আমলসমূহ তো বরবাদ হইয়া গিয়াছে। এবং তাহারা অনন্তকাল আগুনের মধ্যে অবস্থান করিবে।
মুনাফিকরা তাকওয়ার মসজিদের মাঝে নামাজ আদায় করতে পারে না। ঈমানদার যারা তারা নামাজ আদায় করে তাকওয়ার মসজিদের মাঝে। মানব আত্মার ঘরকে মসজিদ বলে। মানবাত্মা জাগ্রত করাটা অনেক সাধনার বিষয়। সাধন ভজনের মূল হলো মানবাত্মার জাগরণ ঘটানো। যত সব জীব-জন্তু রয়েছে, সেই সব জীব-জন্তুর আশ্রয়-স্থল হলো এই জেরার মসজিদ। মানুষের মনের মাঝে যত পাপের জন্ম হয় তার উৎপত্তি হলো পশু আত্মার অন্ধকার দ্বারা। অন্ধকার কাটানোটা দুঃসাহসের পরিচয় দেওয়া। অন্ধকারময় দীলের কারণে সুরত পরিবর্তন হয় (সুরা রহমান)। কারণ, মানব মনের অন্ধকার দ্বারা মানব অজুদের পরিবর্তন মানে খোদা হতে বিচ্ছিন্নতা ঘটানো। মানবাত্মাকে পরিছন্ন রাখতে পারাটাই হলো নামাজ। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সতের সুন্নতের একটি সুন্নত হলোÑ ‘নামাজে আমার চক্ষু শীতল হয়।’ মসজিদ যদি পাক পবিত্র না থাকে তবে আর কি নামাজ আদায় হবে ? নামাজ আদায় করার স্থানটি পবিত্র থাকতে হবে।
মানুষের মনের গহিনের মাঝে আগুনের গুণ খাছিয়ত গুলোর অবস্থান। এই আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মনের পশুত্ব ভাব দূর করতে হবে, এই দূর করাটা সহজ সাধ্য বিষয় নয়। অনুরাগ সাধনার বলে তা অবশ্যই সম্ভব। অসাধ্যকে সাধন করাটা হলো তরিকতের মূল। কারণ, সাধনা করার ফলাফল নির্ভর করে নিজ কর্মফলের উপর। প্রবাদ বাক্য রয়েছে ‘জন্ম হোক যথা-তথা, কর্ম হোক ভাল।’ তাই কর্ম দিয়ে মনুষের মূল মর্ম প্রকাশ পায়। এই কর্ম হলো দুই প্রকারের। একটি হলো দুনিয়ামুখী কর্ম, অন্যটি হলো আখেরাতমুখী কর্ম। দুনিয়ামুখী লোক এই জেরার মসজিদের মাঝে নামাজ আদায় করে আর যারা আখেরাতমুখী মানুষ তারা নামাজ আদায় করবে তাকওয়ার মসজিদে।
তাকওয়া হলো খোদা-ভীরুতার মাধ্যমে সমস্ত নিষিদ্ধ কর্ম থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বা সরিয়ে রাখা। মোহমুক্ত হয়ে পরকালে বা চৈতন্যের জগতে কায়েম থাকাই হলো সালাত/নামাজ। খোদাভীরুতার লক্ষ্য হলো ঐ দিকে। কোরান মাজিদের সূরা আত তওবা এর ১৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে “ইননামা ইয়ামুরূ মাসাজিদাল্লাহি মান আমানা বিল্লাহি ওয়াল ইয়াওমিল আখিরি ওয়া আকামাস সালাতা ওয়া আতাজ্জাকাতা ওয়া লামম ইয়াখশা ইল্লাল্লাহা।” অর্থাৎ আল্লাহর মস্জিদ তো সেই ব্যক্তিই নির্মাণ করিবে, যে আল্লাহ্র উপর এবং ইয়াওমুল আখেরাতের উপর ঈমান আনিবে এবং যে সালাত কায়েম করিবে এবং যে যাকাত আদায় করিবে এবং আল্লাহকে ব্যতিত অন্য কাহাকেও ভয় করিবে না।
আল্লাহর তৈরি মসজিদের মাঝে আদম এবং আওলাদে আদমগণ নামাজ আদায় করে থাকে Ñ যাকে বাইতুল মামুর (নূরে নূরান্বিত গৃহ) বলে। আমাদের তথাকথিত মুসলিম সমাজে আল্লাহর তৈরি মসজিদ সম্পর্কে বেখবর। যারা এই মসজিদের খবর রাখে তারা সব সময়ই আযান শুনতে থাকে। কারণ, মসজিদ ও আযান এক সূতায় গাথা। আযান হলো তাকওয়ার মসজিদে যাওয়ার আহ্বান। বিশ^াসীগণ আযান সর্ব অবস্থায় শুনতে থাকে। কারণ, তাদের সামিউন জাগ্রত। তারা চৈতন্যতার জগতে আরোহন করে তাকওয়ার মসজিদের দিকে ধাবিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন “জীবন্ত ঈশ^র তোমাদের সঙ্গে রহিয়াছেন, তথাপি তোমরা মসজিদ, মন্দির, গীর্জা নির্মাণ করিতেছ, আর সর্বপ্রকার কাল্পনিক মিথ্যা বস্তুতে বিশ^াস করিতেছ।” এই দিক দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রকৃত মসজিদ পরিশুদ্ধ মানবীয় দীলে তার অবস্থান। এ মসজিদে আল্লাহই অবস্থান করেন। আলেম মোল্লারা এই তাকওয়ার মসজিদের ধারে কাছেও যেতে পারবে না। কারণ, অচেতন আর চেতন মানুষ আকাশ জমিন তফাত। তাদের তকদিরে রয়েছে জেরার মসজিদ। আমার মুর্শিদ কেবলা – কাবা কাজী বেনজীর হকে চিশতী নিজামী (কুঃ সিঃ আঃ) বলেন, “জাহিরী মসজিদ তথা ইট-পাথরের মসজিদের মৌলবী এবং নামাজী যদি বেমুরিদান হয় তবে ঐ মসজিদও জেরার মসজিদ হয়ে যায়।” যদিও তার হাকিকত রয়েছে নিজ দেহে। যেমনÑ আমরা মালা গাঁথি এই মালার যদি সূতার মাঝে গিট্টু দেওয়া না হয় তবে আর মালা গাঁথা হবে না তেমনি হাল হয় জেরার মসজিদওয়ালাদের। জেরার মসজিদে অবস্থান করা অবস্থায় তাকওয়ার মসজিদ তৈরী করা সম্ভব নয়। আর তাকওয়ার মসজিদ তৈরী না হলে নিজ মনকে ঐক্যতায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়।
রাছুল বলেন, “তোমাদের মধ্যে ঐক্যতা সৃষ্টি করা নামাজ-রোজা-সদ্কার চেয়ে উত্তম।” ঐক্যতা সৃষ্টি করা মানে রুহে ইনছানিতে কায়েম হওয়া। তাই যারা জেরার মসজিদে বাস করছে তাদের মধ্যে ঐক্যতার জগতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। যারা ঐক্যতার জগতে কায়েম হতে পারেনি তারা জাহান্নামী হয়ে যাবে। কারণ, তাদের দীলের মাঝে মোহর মারা, কানে মোহর মারা, চোখের মোহর মারা। হাশরের দিন তাদের সুরত বদল হয়ে জানোয়ার রূপে হাশরে উঠবে। কারণ, তাদের মধ্যে আনোয়ার নেই। তাদের সাধ্য নেই আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুলের ভেদ রহস্য জানার।
মসজিদ সম্পর্কে জানতে হলে দিব্য দৃষ্টিওয়ালা মহা মানবের কাছে গিয়ে আনুগত্য/বায়াত গ্রহণ করতে হবে। তাঁর দয়ার পরশ দ্বারা যদি দীলের অন্ধকার যদি কেটে যায় তবে এই দেহটা নূরের আলোতে আলোকিত হবে তথা জানোয়ার আনোয়ার হবে। এই নূরটাই হলো আল্লাহু আলীমুন। আল্লাহু আলীমুনের জন্য মানুষ সৃষ্টির সেরা হয়েছে। সৃষ্টির সেরা হওয়াটা সহজ বিষয় অবশ্যই নয়। কারণ, সৃষ্টির সেরা হতে গেলে মানবাত্মার জাগরণ ঘটাতে হবে। মানুষ একটা পর্যায়ে হায়ানী আত্মার মাঝে বাস করে। জেরার মসজিদের মাঝে কায়েম থাকা আর পশু আত্মার গুণ- খাসিয়ত দীলে ধারণ করা একই বিষয়। যারা পুন্যবাণ হবে তাদের স্থান তাকওয়ার মসজিদে, তারা তাকওয়া নিজ মানব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করবে। চেতন-অচেতন হওয়ার সাথেই এই দুই মসজিদের অবস্থান। ষড়যন্ত্রকারী (নফস আম্মারার) গুণÑখাছিয়তের লোক এই মানব সমাজে অনেক রয়েছে তদের থেকে নিজেকে বাঁচাতে হলে একজন ইনসানুল কামেলের নিকট বায়াত গ্রহণ করেও তাঁর আশ্রয়ে মানব মনের অন্ধকার কোঠাগুলোকে আলোকিত করতে হবে।
প্রত্যেকটা বিষয় জানা অর্থাৎ অন্ধকারগুলো কাটার হাতিয়ার তৈরি করা। হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (রাঃ) বলছেন “হিংসুকদের ভৎর্স্যনায় চিন্তিত হয়ো না, কষ্ট ও যন্ত্রণা দিয়েই আশেক তথা প্রেমিকের হৃদয় প্রতিপালিত হয়।” মানুষ পারে সর্ব কিছুর উর্ধ্বে নিজেকে নিয়ে যেতে। কারণ, মানুষের যেই জ্ঞান শক্তি রয়েছে তা অন্য কোন কিছুর মাঝে নেই। আত্মার উন্নতি তখনই ঘটে যখন মানব হৃদয় নির্ভেজাল হয়। জানার মঝেই সর্ব কিছুর মর্ম ভেদ রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। যারা নবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে/করছে তারা সব হলো হায়ানী আত্মার অধিকারী পশুর ন্যায়। তাদের অবস্থান হবে সিজ্জিনে। তাদের ধ্বংস নিশ্চিত। তারা স্বভাব অনুসারে সুুরত ধারণ করবে। কারণ, যখন অপকর্ম (পশুরেত্ব আচরণ) করা হয় তখন আর আখেরে কি হবে তা ভাবা হয় না। হায়ানী আত্মার কর্ম করতে গিয়ে মানব মন হয়ে উঠে পশুর আত্মার অধিকারী। যারা রাছুলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে তারা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে। ইনছানি আত্মা দ্বারা তাকওয়ার মসজিদ তৈরী করা হয়েছে। যারা অচেতন তারা তা বুঝতে পারে না তাদের বুঝ হলো হায়ানী আত্মার ঘরে। এই হায়ানী আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে পারার মাঝেই রয়েছে একজন ইনসানের ইনছানিয়াত অর্জন করা।
ইনছানিয়াত মনে ধারণ করলে জেরার মসজিদ কেটে তাকওয়ার মসজিদ তৈরী হবে। একজন মানুষ আহামদী ছুরতে নামাজ আদায় করবে। নামাজ আদায় করার জন্য মূল হলো অজু করা, সেই অজু দ্বারা আবেহায়াত প্রাপ্ত হতে হবে। তাকওয়া ছাড়া নামাজ আদায় করা কখনো আল্লাহপাক কবুুল করবে না। সেজন্য জেরার মসজিদে রাছুলপাক (সা.)- কে দাঁড়াতে নিষেধ করা হয়েছে।