জীবনী – ডায়োজিনিস দ্যা সিনিক – ক্ষ্যাপাটে দার্শনিক

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

লন্ঠন হাতে মানুষ খুঁজে ফিরি! তাও দিনের বেলা! দুনিয়া বিমুখীতার শ্রেষ্ঠতম উপমা হলেন দার্শনিক ডায়োজিনিস।

ডায়োজিনিস একবার মহাবীর আলেকজান্ডার কে জিজ্ঞেস করলেন, বাপু, তোমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আলেকজান্ডার বললেন, সমস্ত গ্রীস নিজের আয়ত্তে আনা।
তারপর?
সমস্ত এশিয়া মাইনর নিজের আয়ত্তে আনা।
তারপর?
সমস্ত পৃথিবী নিজের আয়ত্তে আনা।
নাছোড়বান্দা ডায়োজিনিস লেগে থাকেন, “তারপর?”
তারপর আর কী! বাড়িতে বসে বসে বিশ্রাম নেবো!
ডায়োজিনিস তখন মিটিমিটি হাসেন,
বললেন, হে হে, সে কাজটি এখন করলেই তো পারো!

ডায়োজিনিস! প্রথাবিরোধী পাগল দার্শনিক!

বাস করতেন রাস্তার ধারে বড় একটা টবে! সাথে ছিল শুধু একটা লন্ঠন, একটা লাথি, পানপাত্র। একদিন দেখলেন, একটা ছেলে আঁজল ভরে সরোবর থেকে পানি পান করছে। ছুড়ে ফেলে দিলেন পানপাত্র।
বললেন, স্রষ্টার কারো কাছে হাত পাততে হয় না। যারা স্রষ্টার কাছাকাছি তারাও প্রয়োজনের উর্ধ্বে।

তার সমসাময়িক এক দার্শনিক অ্যারিস্টিপাস রাজ দরবারে তোষামোদবলে হয়ে উঠেছিল প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক। এ্যারিস্টিপাস একদিন ডায়োজিনিস কে শুধু শাক ভাত খেতে দেখে বললেন, যদি রাজাকে তোষামোদ করা শিখতে তাহলে শুধু শাকভাত খেয়ে থাকতে হতো না। “তুমি যদি শাকভাত খাওয়া শিখতে তাহলে রাজাকে তোষামোদ করে চলতে হতো না।” – ডায়োজিনিসের জবাব!

মহামতি দার্শনিক প্লেটো মানুষের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, মানুষ হলো পালকবিহীন দ্বিপদ প্রাণী! ডায়োজিনিস একটা মুরগীর পালক ছাড়িয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন প্লেটোর কাছে। লিখে দিয়েছিলেন – “তোমার সংজ্ঞায়িত মানুষ!”

কাওকে পরোয়া না করার সুনাম ছিল ডায়োজিনিসের। বিশ্ববিজয়ী বীর আলেকজান্ডার তাকে বললেন, আমার নিকট থেকে আপনি কি চান?
“আমি রোদ পোহাচ্ছি। আপনি সূর্যকে আড়াল করে দাড়িয়েছেন। আমি চাই আপনি সরে দাড়ান!”

এহেন ব্যক্তিত্বের ফলশ্রুতিতে আলেকজান্ডার বলেছিলেন, “আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম তবে ডায়োজিনিস হতে চাইতাম!”

নিজ শহর সিনোপ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ডায়োজিনিস। কিন্তু এর জন্য কখনও আক্ষেপ করেননি তিনি। বলেছিলেন, “নির্বাসনই আমাকে দার্শনিক বানিয়েছে।”

তাকে দাস হিসেবে বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হয়েছিলো। কথিত আছে তখন তিনি বলেছিলেন, “আমাকে এমন কারো কাছে বিক্রি করো যার মনিবের প্রয়োজন।”

একবার দেখা গেল, তিনি এক মূর্তির সামনে দাড়িয়ে সেটির কাছ থেকে ভিক্ষা চাইছেন। লোকে জিজ্ঞেস করলো, “কী ব্যাপার?” ডায়োজিনিস বললেন, প্রত্যাখ্যাত হবার অনুশীলন করছি।

ডায়োজিনিসকে প্রায়শই কুকুর বলে ডাকা হতো। এমন ডাকনাম অবশ্য তিনি পছন্দ করতেন! তিনি বলতেন, “অন্য কুকুররা তাদের শত্রুদের কামড়ায় আর আমি আমার বন্ধুদের কামড়াই, তাদের রক্ষা করতে।”

ডায়োজিনিসের বাবা সিনোপ শহরে মুদ্রা তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। ডায়োজিনিস সেসব মুদ্রার খোদাই নষ্ট করতেন। সিনিক আন্দোলনে এটি একটি প্রতীকি রূপ পেয়েছিলো। সিনিকেরা মুদ্রা নষ্ট করার মাধ্যমে সামাজিক প্রথাকে আক্রমণ করেন।

একবার দিনের বেলা তিনি লণ্ঠন হাতে বাজারে উপস্থিত হলেন। দিনের বেলা বুড়োর হাতে জ্বালানো লণ্ঠন দেখে সবাই বেশ আমোদ পেলো। তারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই ভরদুপুরে লণ্ঠন হাতে কোথায় চললেন?”
ডায়োজিনিস বললেন, “আমি আসলে মানুষ খুঁজছি। গ্রীসের কোথায় মানুষ পাওয়া যাবে, কেউ বলতে পারবে?”

স্বদেশী গ্রিকদের তিনি কেন এতো বেশি ঘৃণা করতেন যে, তাদের মানুষ বলেই গণ্য করতেন না? কারণ তিনি ভাবতেন, তারা দরিদ্রতাকে আপন করে নেয়নি। তাই তারা দারিদ্র্যের সাথে জড়িয়ে থাকা স্বনির্ভরতা এবং নির্মল স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে পারে না; তারা অপূর্ণ থেকে যাবে আমৃত্যু!

সামাজিক প্রথাকে তিনি আরো অনেকভাবে আক্রমণ করতে উদ্যত হন। একবার এক থিয়েটার শেষে সবাই যখন বের হয়ে যাচ্ছিলো, তখন দেখা গেলো ডায়োজিনিস প্রবেশ করছেন। কেউ বললো, “এখন এসেছেন কেন? থিয়েটার তো শেষ!” ডায়োজিনিস বললেন, “তোমাদের প্রথাকে আক্রমণ করতে এসেছি।” এই বলে তিনি শূন্য থিয়েটারের ভেতরে গিয়ে বসে রইলেন!

ডায়োজিনিস একবার দর্শনের নানা বিষয় কিছু মানুষের সামনে আলোচনা করছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন, মানুষেরা ধীরে ধীরে কেটে পড়ছে এবং নিজেদের কাজে মনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। তিনি হঠাৎ তার আলোচনা থামিয়ে নাচতে আরম্ভ করলেন। অমনি আবার সবাই তাকে ঘিরে ধরলো। তিনি নাচ থামিয়ে বললেন, “বুরবকের দল! ভালো কথায় আগ্রহ নেই, ভাঁড়ামিতে ঠিকই আগ্রহ!”

দর্শনের এক ছাত্র একবার ডায়োজিনিসের কাছে এসে বললো, “দর্শনবিদ্যা আমার কাছে খুব কঠিন মনে হয়।” শুনে ডায়োজিনিস বললেন, “ভালোভাবে বাঁচতে চাও না যখন, বেঁচে আছো কেন?”

ডায়োজিনিসকে জিজ্ঞেস করা হলো, বিয়ের জন্য সঠিক বয়স কোনটি? ডায়োজিনিস বললেন, “একজন যুবকের জন্য সেসময় এখনও আসেনি, আর বুড়োর জন্য সময়টি পেরিয়ে গেছে!”

মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, “আমার মৃত্যু হলে তোমরা আমার শরীরটাকে শহর থেকে দূরে ফেলে রেখে এসো, জন্তু জানোয়াররা যেন তা খেতে পায়।”

ডায়োজিনিসের বাণী –
1. একজন জ্ঞানীকে আবিষ্কার করতে আরেকজন জ্ঞানীর প্রয়োজন হয়।
2. তারই সবচেয়ে বেশি আছে, যে অল্পে তুষ্ট।
3. কুকুর এবং দার্শনিকেরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে থাকে, কিন্তু সবচেয়ে কম প্রতিদান পায়।
4. রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে তার যুবসমাজের শিক্ষা।
5. ছাত্র খারাপ আচরণ করলে তার শিক্ষককে চাবকানো হবে না কেন?
6. ঈশ্বর হবার সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো তার কারো কাছে হাত পাতা লাগে না। যারা ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি, তাদের প্রয়োজন তাই খুব সামান্য।
7. একজন ধনীর বাড়িতে থুতু ফেলবার কোনো জায়গাই থাকে না, তার চেহারা ছাড়া!

ডায়োজিনিসের জীবনী সম্বন্ধে আমাদের বেশি কিছু জানা নেই। তবে তিনি জন্মেছিলেন সিনোপে, কৃষ্ণ সাগরের তীরে অবস্থিত শহরটিতে। রাফায়েলের স্কুল অফ এথেন্সে আমরা তাকে দেখি ছন্নছাড়াভাবে সিঁড়ির উপর বসে থাকতে।

ডায়োজিনিস বা অন্য সিনিক চিন্তকেরা মূলত মানুষের জীবনের দুটি সমস্যার সমাধানের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তা হলো –
১. Ataraxia এবং ২. Apatheia।
গ্রীক ভাষায় Ataraxia অর্থ সব ধরনের উদ্বেগ এবং চিন্তা থেকে মুক্তি, এক শক্তিশালী স্থিরতা।
অন্য দিকে Apatheia অর্থ মনের সেই অবস্থা, যাকে তীব্রতম আবেগও বিচলিত করতে পারে না।
সে অবস্থা নির্বিকার নয়, বরং চিন্তাশক্তির স্থিরতায় বিরাজমান প্রশান্তি। সিনিকগণ বলতেন, আমাদের শুধুমাত্র অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে প্রকৃতির নিয়মে বাঁচা উচিৎ। এমনকি তারা গাছ থেকে ফল না পেড়ে সামান্য পরিমাণ ডাল খেয়ে বেঁচে থাকতেন। পরণের সামান্য কাপড় আর লাঠি বা চামড়ার থলে ছাড়া তাদের ভিন্ন কোনো সম্পদ থাকতো না। তারা বাস করতেন প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা কোনো আবাসে, তাদের মালিকানায় কোনো আরামদায়ক আবাসও ছিলো না। তারা বলতেন, এমন জীবনধারণই চরম প্রশান্তি এনে দিতে পারে।

জীবন আলোকিত হোক, নির্মোহ হোক, জীবনে প্রকটিত হোক পরমার্থিক চেতনা !
ডায়োজিনিস দীপশিখা হয়ে থাকুক আমাদের জীবনপথে…..

রচনাকাল – 17/07/2019
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর