লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
কাজী নজরুল ইসলামের একটা কথা মনে পড়ে। বলেছিলেন, “টাকা কামাইতে গেলে যতটা নিচে নামতে হয়, অতোটা নিচে নামার দুঃসাহস আমার নাই।” সৃষ্টিশীল মানুষগুলো এতোটাই আত্মমর্যাদার অধিকারী আর এতোটাই সংবেদনশীল হন যে, যদিও জিবন বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে, তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন, তবুও আত্মসম্মানের প্রশ্নে থাকেন অনঢ়। যারা ‘নজরুল স্মৃতিকথা’ পরেছেন, তারা নজরুল জিবনের দুঃসহ সময়ের সঙ্গে কিছুটা পরিচিত। আজ আপনাদের এমনি আর একজন ভাগ্য বিড়ম্বিত মহান কবির জিবনের গল্প শোনাবো।
নাম তাঁর মুহাম্মদ আখতার। সাগির সিদ্দিকি নামেই পরিচিত। জন্ম গ্রহণ করেন 14 আগস্ট 1928 সালে। 1974 এর 19 জুলাই তাঁর নিথর দেহটি পাওয়া যায় পাকিস্থানের লাহোরের একটি রাস্তায়। তখন তাঁর বয়স ছিল 46 বছর। দেহটির পাশেই বসে ছিল তার বহুদিনের একমাত্র সঙ্গী কুকুরটি। 1 বছর সেখানেই বসে থেকে একই জায়গাতে মৃত্যুমুখে পতিত হয় কুকুরটি। অসাধারণ সম্ভাবনাময় একজন কবির এমন পরিণতির করুণ কাহিনি টুকুই তুলে ধরছি।
উচ্চবিত্ত পরিবারে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান মুহাম্মদ আখতার। জিবনের প্রথম সময়টা অতিবাহিত হয় আম্বালা ও সাহারানপুরে। তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট কবি হাবিব হাসান। মূলত হাবিব হাসানের কাছ থেকেই কাব্যচর্চার অনুপ্রেরণা লাভ করেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি বসবাস করার জন্য অমৃতসরে চলে যান ও নিয়মিত লিখতে থাকেন কবিতা ও গজল। উর্দু কবিতা তাকে সে সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তিনি নিয়মিত যোগ দিতে থাকেন লুধিয়ানা ও গুরুদাসপুরের কবিতা আবৃত্তির সভায়।
1947 সালে যখন পাকিস্থানের জন্ম হয় তখন তাঁর বয়স 19। দেশপ্রেমের টানে তিনি অমৃতসর ছেড়ে লাহোরে এসে বসতি স্থাপন করেন। হালকা পাতলা গড়ন, প্যান্টের সাথে হলুদ সিল্কি কাপড়ের শার্ট, কোঁকড়া চুলে সুরেলা কন্ঠের কবি সাগির সিদ্দিকি গজল লিখে ও আবৃত্তি করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
সাগিরের ইচ্ছা ছিল পাকিস্থানের জাতীয় সংগীত তিনি লিখবেন। যদিও তার লেখাটি সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়নি। তারপরই তিনি লাহোরে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং পত্রিকাটি ফ্লপ করে, বন্ধ করে দিতে হয়। তখন থেকেই শুরু হয় সাগিরের অর্থকষ্টের জিবন।
সস্তা একটি হোটেলে ভাড়া থাকতেন তিনি। ম্যাগাজিনের জন্য কবিতা লিখে যাৎসামান্য যা পেতেন, তাতেই হোটেলের ভাড়া কোনোমতে হয়ে যেত। ধারাবাহিক লিখে চলেছিলেন সাগির।
লাহোরে আসার এক দশকের মধ্যে তার জিবনদর্শন অনেকখানি বদলে গিয়েছিল। লেখক জিবনের নিদারুন অর্থকষ্ট, মান-অপমান মিলিয়ে সংক্ষুব্ধ চিত্তে যখন তিনি অবলোকন করলেন চারিদিকে দুর্নীতি, মেধার অমূল্যায়ন, সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বজনপ্রীতি – তিনি হতাশ হয়ে পড়লেন। সর্বগ্রাসী এক অভিমান ভর করল তার হৃদয়-মনে। লেখক হৃদয়ের আদিগন্ত অভিমানরাশির কাছে পরাজিত হলেন তিনি। একটু প্রশান্তির তাগিদে আশ্রয় নিলেন মাদকের বিধ্বংসী কোলে!
লাহোরের একটি হাসপাতালের দারোয়ানের কাছ থেকে নিয়মিত মরফিন নিতে থাকেন তিনি। ধীরে ধীরে নিজেকে সম্পূর্ণ সোর্পদ করেন মরফিনের নিকট। ছেড়ে দেন হোটেল। নেমে আসেন পথে।
সাগির কে প্রায়ই দেখা যেত লাহোরের সার্কুলার রোড, আনারকলি বাজার, আখবার মার্কেট, আইবাক রোড, শাহ আলমি এবং দাতা দরবার এলাকায়। বিধ্বস্ত চেহারা, শতচ্ছিন্ন পোষাক, জটা চুল, পথের ধারে মোমের আলোয় কবিতা লিখছেন। কখনো আনমনা, কখনো নিমগ্ন, কখনো জিবনের হতাশাবোধে ক্লান্ত!
সাগির আরো অবসাদাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, যখন দেখা গেলো, তার লেখাগুলো বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ হচ্ছে অন্যদের নামে! কেউ কেউ একটা সিগারেটের বিনিময়ে সাগির কে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছেন এক একটি কবিতা, এবং তা প্রকাশ করছেন নিজের নামে। সাগিরের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ কামিয়ে নিচ্ছেন অর্থকড়ি! আর সাগির পড়ে আছেন ফুটপাতে! খাদ্যহীন! সহায় সম্বলহীন!
পৃথীবি পরিত্যাগ করেছিল সাগিরকে। দেয়নি তার প্রতিভার মূল্য, দেয়নি তার কাজের বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি! প্রচন্ড ক্ষোভ অভিমানে সাগির ও ছেড়ে দিলেন পৃথীবিকে। দুচোখে বোবাদৃষ্টি নিয়ে এবার হয়ে উঠলেন একদম উন্মাদ! রাতভর ফুটপাতে বসে বসে কবিতা, গজল রচনা করতেন তিনি, ভোর হতেই কাগজগুলো জড়ো করে স্তুপ বানিয়ে দিতেন আগুন ধরিয়ে! শূণ্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে পুড়তে থাকা কবিতার দিকে! কেউ তাকে জানতো উন্মাদ, কেউ জানতো ভিক্ষুক!
জিবনে একটিমাত্র বন্ধু ছিল সাগিরের। পথের একটি কুকুরকে বন্ধু বানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কুকুরটি তাকে কখনো পরিত্যাগ করেনি। মানুষজন খাবার যা কিছু দিত, দুজনে ভাগাভাগি করে খেতেন। ঘুমুতেন এক সাথেই।
মরফিনের আসক্তি, রাস্তার জিবন, দারুণ হতাশা আর জিবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চরমে পৌঁছে যায় সাগিরের। 1974 এর শীতকালের এক রাতে পথের ধারে পড়ে থাকতে দেখা যায় সাগিরের মৃতদেহ। প্রচন্ড শীতে গরম কাপড় ব্যতীত পথের ধারে শুয়েছিলেন তিনি। কেউ ছিল না আশপাশে। শুধু সাগিরের মৃতদেহের পাশে বসে থাকতে দেখা যায় তার একমাত্র বন্ধু কুকুরটিকে।
কুকুরটি কখনোই সে জায়গাটি ছেড়ে যায়নি। সেখানে বসে ছিল। 1 বছর পর সে জায়গাটিতেই মৃত্যুমুখে পতিত হয় কুকুরটি।
সাগিরের সাহিত্যকর্ম অনেকটাই বিলুপ্ত। যৎসামান্য যা আছে তার অনুবাদ তেমন করা হয়নি বাংলাতে। দুটি লাইন তুলে দিচ্ছি –
দিল মিলা অর গম শানাস মিলা
ফুল কো আগ কা লিবাস মিলা
হর শানাওয়ার ভানওয়ার মেন দুবা থা
জো সিতারা মিলা উদাস মিলা।
অনুবাদ –
দুঃখের সাথে মাখামাখি আমার হৃদয়ের
ফুল যেনো পড়েছে আগুনের পোশাক!
সাঁতারুকে নামালে ঘুর্ণিজলে, ডুবে গেলো সে –
আমার দেখা প্রতিটি তারা, দুঃখিত, নির্বাক!
রচনাকাল – 19/05/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী