লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
ধর্ম হলো মানবমুক্তির শাশ্বত বিধান। মানুষ নফসানিয়াতের দেয়ালের ভেতর আবদ্ধ। গুরুপথের পথিক হয়ে তথা প্রভুগুণে গুণান্বিত মানুষের আজ্ঞাবহ হয়ে, তাঁর পরিপূর্ণ অনুকরণ-অনুসরণ দ্বারা মানুষ কে মানুষ হতে হয়। অর্জন করতে হয় খোদায়ী গুণাবলি। খোদায়ী গুণাবলি অর্জনের সমস্ত পথ-প্রক্রিয়াকে ধর্ম বলে। যা অজ্ঞানীকে জ্ঞানীতে এবং জ্ঞানীকে মুক্ত মানুষে পরিণত করে। মানুষের ভেতর প্রেমগুণের জাগরণ ঘটিয়ে মানুষকে স্থিত করে মানবী জান্নাতে।
আফসোসের বিষয়, স্বার্থান্বেষী মানুষেরা ধর্মের উষালগ্ন থেকে শুরু করে ধর্মকে ব্যবহার করেই আসছে। ধর্মের মূল তাৎপর্য বুঝতে না পেরে, ধর্মের শাশ্বত মুক্তি বিধান কে উপেক্ষা করে তারা ধর্ম কে বানিয়ে নিয়েছে তাদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। বস্তুবাদি প্রবণতায় তারা ধর্মকে জাগতিক উন্নতির মোক্ষম উপায় হিসেবে ব্যাবহার করছে। ভয়ংকর ব্যাপারটি হলো, এরাই ধর্মসমাজের সিংহভাগ আর সাধারণ্যে এরাই প্রকৃত ধার্মিক বলে পরিচিত। ধর্মীয় নেতৃত্বে তারাই আসীন। ফলে দ্রুত গতিতে সমাজ ছেয়ে গেছে এসব ভন্ড ব্যবসায়ী ধার্মিক শ্রেণীতে। মূলত, এসব স্বার্থান্বেষী ভন্ড ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণীর হাতেই আজ সমাজ এবং ধর্ম কুক্ষিগত।
ধর্মের প্রতিটি চিরন্তন বিধানাবলীকে তারা বানিয়ে নিছে অর্থ উপার্জনের এক একটি মাধ্যম। ধর্মীয় অক্ষরবাদ তথা মৌলবাদ সম্প্রদায়, যারা ধর্মের নামে নিজেরা একটি আলাদা শ্রেণী তৈরী করে নিয়েছে বিভিন্ন জাকজমকপূর্ণ নাম বা খেতাব ধারণ করে। ধর্ম জগতের মধ্যে তৈরী হয়েছে একটা সুবিধাভোগী ধার্মিক শ্রেণী। সংখ্যাধিক্যের কারণে তারাই ধর্ম জগতে অধিকার করে নিয়েছে নেতার আসন। এবং প্রকাশ্যে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ধর্ম ব্যাবসা।
আমি স্পষ্টতই মুসলিম নামধারী আলেম সম্প্রদায়ের কথা বলছি। কথিত একটা উদ্ভট মনগড়া তথা তাদের নিজেদের হাতে তৈরী করা কিম্ভূতকিমাকার ধর্মকে উপজীব্য করে তারা সেজে বসেছে সেই ধর্মের সর্বেসর্বা। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, দ্বীনে মোহাম্মদী তথা শান্তি সমর্পনের ধর্ম ইসলাম হলো মানব মুক্তির ধর্ম। এক কথায় যদি বলি, খোদায়ী স্বভাব অর্জনের নাম ইসলাম, যা অর্জিত হবে একজন পরিপূর্ণ পবিত্র মানুষের প্রত্যক্ষ অনুসরণের মধ্য দিয়ে। এটাই ধর্ম। সকল নবী রাসুল, অলি আবদাল, পীর মাশায়েখ, ফকির কুতুবগণ তথা জগতের সকল মুক্ত-পুরুষগণ এ ধর্ম টাকেই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
কিন্তু সমস্যা টা হয়েছে, চিরকালের ধর্ম বিরোধী একটা চক্র, যা যুগে যুগে সকল ধর্মকে বিরোধিতা করেছে, তাদের নিয়ে। দ্বীনে মোহাম্মদীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, ধর্মের উষালগ্ন থেকেই ধর্মশত্রুরাই মূলত পরিচালনা করেছে ধর্মকে। নেতৃত্ব দিয়েছে ধর্ম সমাজের। ইচ্ছামতো রদবদল করেছে ধর্মের। নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে পরিচালিত করেছে ধর্মের চিরন্তন স্রোতকে।
দুরভিসন্ধিমূলক রাষ্ট্রীয় খেলাফত চক্র, পরবর্তীতে মুনাফেক মুয়াবিয়া এজিদের নেতৃত্বাধীন ভন্ড ধার্মিক সম্প্রদায়, পরবর্তীয় উমাইয়া আব্বাসী রাষ্ট্রযন্ত্র এবং মূলত ধার্মিক বেশধারী বা নামধারী সম্প্রদায়ের হাতেই চালিত হয়েছে বাহ্যিক ধর্মব্যাবস্থা। ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হয়েছে। ধর্ম আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছে। মুষ্টিমেয় জ্ঞানী তথা পবিত্র মানুষ (আহলে বাইয়াত পন্থী) তাদের সাথে ধর্ম নির্বাসিত হয়েছে দরবার খানকা বা বনজঙ্গলে। আর বস্তুবাদি অন্ধ ধার্মিক শ্রেণী তাদের নিজ হাতে বানানো একটা উদ্ভট ধর্মকে জোরেশোরে প্রচার করে গেছে আসল ধর্ম বলে। সেই অন্ধ ধার্মিক শ্রেণীর ভেতরে স্বাভাবিক ভাবেই তেরী হয়েছ হাজার হাজার দল, উপদল, ফেরকা, মাজহাব বা সম্প্রদায়।
প্রচার প্রসার অত্যন্ত জৌলুসের সাথে হওয়ায় সেই মুয়াবিয়া এজিদ প্রবর্তিত ধর্মটিই পরিচিত হয়েছে আসল ধর্ম নামে। সমাজে তাই আজোবধি প্রচারিত হচ্ছে। সিংহভাগ মানুষেরা সেই অন্ধ-ধর্মেরই অনুসারী। সমাজ-রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে আছে সেই এজিদি ধর্ম। সাধারণ মানুষ সে এজিদ বিষকেই মধূজ্ঞানে পান করছে।
প্রকৃত দ্বীনে মোহাম্মদী তথা মানব ধর্ম ইসলাম যুগে যুগে পরিচালিত হয়েছে জ্ঞানীগণের দ্বারা। যারা নিঃস্বার্থ ভাবে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। মানুষকে সিরাতাল মুস্তাকিমের সন্ধান দিয়েছে। তারা নিজেদের জিবন সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেছেন ধর্মের জন্য। অলী আউলিয়া গাউস কুতুব পীর মাশায়েখ ফকির দরবেশ দ্বারাই প্রচারিত হয়েছে দ্বীনে মোহাম্মদী তথা মানব ধর্ম তথা ইসলাম।
অপরদিকে মুয়াবিয়া এজিদ প্রবর্তিত মেকী ধর্ম তথা রাষ্ট্রধর্ম বা রাষ্ট্রীয় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। তাদের নীলনকশা অনুযায়ী তাদের অভ্যন্তরেই গড়ে উঠেছে একটা যাজক তথা পুরোহিত ধার্মিক শ্রেণী। যারা পুরোদস্তুর আজগুবি প্রাণী! মাদ্রাসা নামক একটা উদ্ভট শিক্ষা ব্যাবস্থা কায়েম করে সেখান থেকে ঝাকমারি কিছু খেতাব উপাধি ঘাড়ে বহন করে এরা সমাজে লিপ্ত হয় মানুষকে এজিদি মতবাদ শেখানোর কাজে। এজিদি মতবাদের মূল কথা যেহেতু বস্তুবাদ, তাই তারাও ওহী কালামের পরোয়া না করে, তাদের গুরুঠাকুর, দাদাঠাকুরদের শেখানো উপায়ে ধর্মের নামে মূলত স্বার্থ উদ্ধার করতে ব্যস্ত।
মুয়াবিয়া এজিদ প্রবর্তিত ধর্মব্যাবস্থায় এজিদপন্থীদের মূল লক্ষ্য হলো ধর্মব্যাবসা। এতবড় একটি অকর্মা অক্ষম বুদ্ধিশূণ্য পেঁচা স্বভাবের বামুন শ্রেণীকে তথা জড় প্রাণীগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্মব্যাবসার বিকল্প নাই। দারুণ কাজ হয়েছে তাতে! হাজার রকম ব্যবসা উদ্ভূত হয়েছে ধর্মসমাজে।
আমরা মূলত বলতে চাচ্ছি, ধর্ম ব্যবসা যারাই করবে তারাই মূলত এজিদপন্থী, মোনাফেক শ্রেণী। পবিত্র কোরআনে বহুবার স্পষ্টত ধর্মব্যবসা তথা ধর্মের বিনিময় গ্রহণ কে নিষেধ করা সত্ত্বেও মুয়াবিয়ার অনুগামীরা এটিই করে যাচ্ছে। ফলত; ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, যারা এসব ভন্ডদের চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে। এককথায়, ধর্মের কোনোরূপ বিনিয়ম গ্রহণ নিষেধ। ধর্মব্যবসা যে বা যারাই করবে, তারা ভন্ড।
পবিত্র কোরআন থেকে এতদসংক্রান্ত কিছু বাণী উল্লেখ করে প্রবন্ধটি শেষ করছি।
- অনুসরণ করো তাদের, যারা কোনো বিনিময় প্রত্যাশা করে না। সুরা ইয়াসিন 21
- বলুন, আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না। সুরা সাবা 47
- তুচ্ছমূলে যারা আল্লাহর কালাম বিক্রি করে না, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে পারিশ্রমিক রয়েছে। সুরা আল ইমরান 199
- আমি তোমাদের কাছে কোনো রকম বিনিয়ম কামনা করি না, আমার বিনিময় রয়েছে আল্লাহর দায়িত্বে। সুরা ইউনুস 72
- হে আমার জাতি, আমি তোমাদের কাছে কোন অর্থ চাই না। সুরা হুদ 29
- আমি তোমাদের কাছে কোনো মজুরী চাইনা, আমার মজুরী আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে। সুরা হুদ 51
- আপনি তাদের কাছে কোনো বিনিময় প্রত্যাশা করবেন না। এটাতো উপদেশ ব্যতীত নয়। সুরা ইউসুফ 104
- তুমি কি তাদের কাছে প্রতিদান চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদান সর্বোত্তম। সুরা মুমিনুন 72
- আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না। সুরা শুয়ারা 109
- আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না। আমার প্রতিদান তো পালনকর্তা দিবেন। সুরা শুয়ারা 127
- আর আমি কোনো প্রতিদান চাই না। সুরা শুয়ারা 145
- আমি এ জন্য কোনো প্রতিদান চাই না। প্রতিদান তো জগতসমূহরে রবের নিকট। সুরা শুয়ারা 164
- আমি তোমাদের কাছে প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো প্রভু দিবেন। সুরা শুয়ারা 180
- আমি সত্য সঠিক পথের দিকে ডাকার জন্য কোনো প্রতিদান চাই না। আর আমি লৌকিততাকারীও নই। সুরা ছোয়াদ 86
- হে নবী বলুন, আমি ধর্ম প্রচারের বিনিময়ে আমার আত্মীয়দের প্রতি পূর্ণ ভালোবাা ব্যতিত আর কিছুই চাই না। সুরা শুয়ারা 23
রচনাকাল – 29/12/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী