প্রবন্ধ – কায়মনে তুই মানুষ হ’

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

মানুষতত্ত্বেই নিহিত প্রকৃত সত্য। মানুষ, মানুষ হয়ে উদ্ঘাটন করে সেই মহাসত্যের দ্বার। যাকে বলা হয় ‘ফাতিহাতুল কিতাব’। কামনা বাসনা বিবর্জিত মোহমুক্ত চরম নিরপেক্ষ একজন শুদ্ধ ও পবিত্র মানুষই হলো মহান আল্লাহর হাকিকত। যার মাধ্যমে উন্মোচিত হয় প্রভুর আসরার তথা রহস্য। তাই বলা হয়েছে “আল ইনসানু সিররি ওয়া আনা সিররুহি”।

সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষ’ই পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি যার মাধ্যমে মহান প্রভু যথার্থরুপে নিজেকে প্রস্ফুটিত করতে সক্ষম। আর এই মানুষের তাফসির তথা বিস্তারিত ব্যাখারুপে নির্মাণ করা হয়ছে সমগ্র জগত।

প্রভুগুরু মুর্শিদ কেবলা হযরত খাজা হিমেল শাহ আল চিশতী নিজামী – এর পবিত্র কালাম: “অখন্ড জগৎ ঘিরে যে সুর বাজে বিশ্ব বীণায়, সে সুরের ভেদ প্রকাশে মানুষ বাঁশির সিনায় সিনায়।”

মানুষ তত্ত্বে বিরাজিত যুগ যুগান্তরে বহমান যে অমৃতের ঝর্ণাধারা, তারই প্লাবণ কল্লোলে নিজেকে বিমোহিত করে সে রূপের সুধায় নিত্য আবাহন করার মধ্যেই নিহিত মানব জীবনের চূড়ান্ত বিজয় বা ‘ফাতহুম মুবিন’। সিনায় সিনায় প্রকটিত তারই নিত্যলীলা। সে লীলায় শরীক হয়ে সেই মোহন রূপের সুধায় নিমজ্জিত হয়ে চির শান্তির, চির সবুজের অমর লোকে অবস্থান করার নামই জান্নাতি জীবন বা মানবী জান্নাত

আর যারা মত্ত অসুর স্বভাবে, এজিদি ফিতরাত ধারণ করে নিত্যস্বরুপ চিন্ময় মানুষগুরুর উপাসনা ত্যাগ করে অনুমান কল্পনায় শুণ্যে অবস্থিত কোনো কাল্পনিক সত্ত্বার বৃথা ইবাদত করে চলেছে, তাদের অবস্থান মানুষ ছাড়া কোনো “মানুষ নয়” এর জগতে।

অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক জগতে জামাদাত নাবাদাত ও হায়ানাতে আবদ্ধ জীবশ্রেণী আঠারো হাজার মাখলুকাতের সৃষ্টির এক আবশ্যিক নিয়তিতে বন্দী। যেখানে আত্মিক উৎকর্ষতার পথ রুদ্ধ এবং মহান জাতপাকের চির স্বানিধ্যলাভের তকদিরও অনুপস্থিত, যদিও তারা একত্বের অধিবাসী। ত্রিমাত্রিক জগত থেকে উরুজ করে মানুষের অবস্থান চির সবুজের দেশ ইনছানিয়াতে উত্তোরিত হলেই আস্বাদন করা সম্ভব হবে মুক্তির স্বাদ।

জগতের চতুর্থ মাত্রা রুহে ইনছানির কতৃর্ত্বের স্থান, যেখানে বেলায়তে মাওলা ইমাম আলী (আ) চির সবুজের গুণে গুণান্বিত মানুষকে ইলমের তোরণ দ্বারে পৌঁছে দেন জগৎগুরুর চিরন্তন ও শাশ্বত স্বানিধ্যে। যাকে বলা শাশ্বত মেরাজ। এখানেই চিরমুক্তি। এখানেই দিব্যানন্দ। এখানেই প্রভুসত্ত্বায় আলোকিত সত্ত্বাগুলো চিরকালের জন্য স্থিত হয় পরম প্রভুর নিত্যধামে।

এখানেই ইনছানি সত্ত্বা লাভ করে মহিমাময় প্রভুর নূরময় চেহারা যা কখনো ধ্বংস হয় না। কখনো মলিন হয় না। চিরভাস্বর সেই চেহারার আদলে আপন অবয়ব গঠন করে নিত্যধামের বাসিন্দা মানুষও পরিনত হয় চিরকালের মাওলায়, ওয়াজহুল্লাহর অধিকারী হয়ে অধিষ্ঠিত হয় বাকাবিল্লাহয়।

ইনছানিয়াতের জগতে উরুজ করতে হয় একজন ইনছান কে অনুসরণ করে। মনে রাখা দরকার, মানুষের অনুসরণ করে যারা মানুষ হয়নি, তথা মহাসত্যের দ্বারোদ্ঘাটন করেনি তাদের অবস্থান ত্রিমাত্রিক জগতে আবদ্ধ তথা তারা শাস্তিপ্রাপ্ত। যে অবস্থাকে বলা হয়েছে জাহান্নাম বা শুদ্ধ হওয়ার স্থান। যতক্ষন না তারা গুরুজ্ঞান কৃপাবলে অদম্য শক্তি সাহসের দ্বারা আপনাপন দেয়াল তথা নফসানিয়াতের সুদৃঢ় প্রাচীর ভেঙে বেড়িয়ে আসছে চিরমুক্তির তথা মানুষের দেশে, ততক্ষন তারা রিপুনিচয়ের কঠোর শৃঙ্খলে বন্দী।

বন্দীদের জন্য ধর্ম নয়। মূর্খদের জন্য ধর্ম নয়। আজ সর্বত্রই ধর্মীয় বাহ্যিক বিধানাবলী পালিত হচ্ছে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই) অজ্ঞ-মূর্খদের দ্বারা। তাই ধর্ম জগতে এতো মতবিরোধ, এত অমিল, এত হানাহানি, হিংসা অহংকারের বিষবৃক্ষের বিষোদ্গারন। একজন মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষের নিকট থেকে মুক্তি পাওয়ার বিধান তথা মানুষ হওয়ার বিধান শিখতে হয়। তবেই প্রতিপালিত হয় ধর্ম। নতুবা ধর্ম কোনো কাজেই আসবে না। বরং ধর্ম আরো মুর্খদের মুর্খতাকেই বাড়িয়ে তুলবে।

সকল ধর্মের একমাত্র স্লোগান “মানুষের অনুসরন করে মানুষ হও” কে যারা অবজ্ঞা করে স্বীয় অজ্ঞানতা দ্বারা বঞ্চিত হচ্ছে পরম প্রভূর মহিমান্বিত প্রেম থেকে, আফসোস তাদের জন্য। দু হাতে আঁখি ঢেকে অথবা কূয়োর ব্যাঙ হয়ে জগতকে অস্বীকারের এক হাস্যকর পায়তাঁরা। পেঁচা স্বভাবে স্বভাবান্বিত হয়ে সূর্যকে অস্বীকার করা আর মানুষে বিরাজিত প্রভূ, তার বিকাশ পদ্ধতিসমুহ ও মানুষপূজার চিরন্তন বিধান কে অস্বীকার করা একই কথা।

প্রশান্ত মানুষ (যাকে প্রভূ ডাকছেন তার নিকট ফিরে যেতে, নিত্যধামে স্থিত হতে) হতে হলে চির প্রশান্ত পরম প্রভুকে জাগ্রত করতে হবে আপনত্বে। যার জন্য প্রয়োজন একজন জাগ্রত সত্ত্বাধারী ইনছানুল কামেল তথা পূর্ণ মানবের যথাযথ অনুসরণ ও তার প্রত্যক্ষ নির্দেশনা।

মনে রাখা উচিত, “ধর্ম কোনো বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা বা সাময়িক কার্যকলাপ নয়। ধর্ম মানব মুক্তির বিধান। যেখানে একজন মানুষকে মানুষের দেখানো পথে তিলে তিলে নিজেকে নির্মাণ করতে হয়। নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় মহান সত্ত্বার জাতপাক অঙ্গে ধারণ করার জন্য।”

প্রভুগুণে গুণান্বিত তথা প্রভুসত্ত্বার মূর্তরুপ তথা প্রভুর প্রকাশ রুপ একজন ইনছানুল কামেল তথা গুরু বা মুর্শিদ এর অনুসরণেই আসবে কাঙ্ক্ষিত জাগরণ। অসীম সত্ত্বাকে ধারণ করে সসীম দেহে যিনি প্রভুরূপ কে মানব মোহনায় নিত্য প্রকাশ করছেন তিনিই গুরু। অনুরাগ সাধনার বলে তার চরণে নিজেকে সম্পূর্নরুপে বিলীন করে দিয়ে তার পূর্ণাঙ্গ অনুসরন করলেই সার্থক হবে মানব জন্ম।

প্রভূগুরু মুর্শিদ কেবলার অমৃত বাণী – “অসীম প্রকাশে সীমার মোহনায় এ ভেদ জানিছে যারা, গুরু প্রেমে তারা ত্যাজিছে জীবন হয়েছে আত্মহারা।”

মুর্শিদের পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমেই আপনত্বে বিরাজিত প্রভু মানুষের সর্বাঙ্গে প্রস্ফুটিত হবে। তার দেখানো পথেই পতিত মানবেরা খুঁজে পাবে মনুষ্যত্বের সরল সুপথ।

প্রভূগুরু মুর্শিদ কেবলার পবিত্র বাণী – “আপন সত্ত্বায় সেই পরম সুন্দরকে যেদিন তুমি জাগিয়ে তুলতে পারবে,সেদিন তুমি ইনছান হবে।”

মানুষ এক রহস্যময় সৃষ্টি। সৃষ্টিজগতের সকল নিয়ামক উপস্থিত প্রতিটি মানব সত্ত্বায়। মানুষের বাহিরে খোঁজার, পাওয়ার কিছুই নেই। মানুষের মুক্তিও মানুষের অভ্যন্তরে। মানব সত্ত্বায় কামনা বাসনা রুপ জাগতিক মোহ-কালিমা তথা সকল রিপুনিচয়ের এক দূর্ভেদ্য দেয়াল উপস্থিত। গুরুবলে বলীয়ান হয়ে যদি ভেদ করা যায় সে কালোপর্দা, তবেই মানুষের মুক্তি। এরাদায় নিত্য বহমান নূর এবং জুলমাতের খেলায় যদি মুর্শিদ কেবলা তথা গুরুকে বা মুক্তিদাতা শক্তিকে আলিমুন সিফাত বা জ্ঞানশক্তির তথা মাওলার বেলায়েতি শক্তির সহায়তায় আপনাপন ক্রিয়াকর্মের বিচারক নিযুক্ত করা হয় এবং তারই ইচ্ছাতে যদি চরমভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় চরম সমর্পিত একটি ভক্তজীবন, সে জীবনে মুক্তি আবশ্যম্ভাবী। সেটিই জান্নাতি জীবন। সমর্পিত একটি জীবনই মুসলমানের জীবন। ধার্মিকের জীবন। মানুষে যিনি সমপির্ত নন তাকে মুসলমান বলা ধর্মের অবমাননা।

চিরমুক্তির লক্ষ্যপানে আমাদের অনন্ত যাত্রা। সেই চিরমুক্তি হাসিল হবে মানুষগুরু পূর্ণ অনুসরণ ও অনুরাগ সাধনা তথা পূজা উপাসনা দ্বারা তাকে তথা তার শ্রীরুপকে হৃদকমলে পূর্ণ প্রতিস্থাপন করার মধ্য দিয়ে। মানুষ হওয়ার মধ্য দিয়ে।

প্রভূগুরু মুর্শিদ কেবলার উদাত্ত আহ্বান – “চির মুক্তি পাবি যদি মনরে, কায়মনে তুই মানুষ হ”

মানুষ হওয়ার বার্তা বা “আপন খবর” উদ্ভাসিত হোক প্রতিটি মুক্তিপথের যাত্রীর দৃষ্টিপথে। মানুষ স্থিত হোক মানুষে। মরণ ত্যাজি উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক জীবন। জীবনেই ঘটুক জীবনের উপনয়ন। মানুষের হৃদয়ে চির ভাস্বর ও প্রদীপ্ত হয়ে জেগে থাকুক “আপন খবর।”

রচনাকাল – 03/09/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর