জীবনী – বিখ্যাত অলী খাজা হাবীব আজমী (র) এর জীবনী

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

ইরানের আজম নামক স্থানে জন্ম হযরত খাজা হাবীব আজমী (র) এর। বাস করতেন বসরা শহরে। সেখানে ছিল তাঁর সুদের ব্যবসা। পরবর্তীতে সুদ ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে হযরত খাজা হাসান বসরী (রা) এর নিকট মুরীদ হন হযরত খাজা হাবীব আজমী (র)। খাজা হাসান বসরী (রা) এর ভক্ত মুরীদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খাজা হাবীব আজমী (র)। কঠোর সংযম সাধনা ও দৃঢ় মনোবলের কারণে অল্প সময়েই নিজেকে উন্নীত করেন তিনি যুগশ্রেষ্ঠ আউলিয়ায়। 

খাজা হাবীব আজমী (র) এর উপাসনা

সংসার থেকে পুরোপুরি নিষ্ক্রান্ত হয়ে নির্বিঘ্নে ইবাদত বন্দেগী করার জন্য খাজা হাবীব আজমী (র) ফোরাত নদীর তীরে নির্জনে একটি কুটির নির্মাণ করেন। বেশিরভাগ সময় তিনি ইলমে তরিকত, ইলমে মারিফতের তালিম নিতেন হযরত খাজা হাসান বসরী (রা) এর নিকট থেকে। বাদবাকী সময়টুকু তিনি নির্জনে তাঁর কুটিরে করতেন ধ্যান সাধনা। দিনের পর দিন পার হয়ে যেতো। তার সাধনার পথে সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীও। স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও দিন কাটাতেন প্রভুর সাধনায়। কখনো অনাহারে, কখনো অর্ধ্বাহারে চলতো তাঁদের দিনরাত।

একবার কয়েকদিন যাবত অনাহারে থাকার পর একদম কাঁতর হয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রী। ঘরে খাবার বলতে কিছুই ছিল না। অনাহারে একদম দুর্বল হয়েন পড়েন তিনি। স্বামী কে জানালেন তাঁর কাঁতরতার কথা। খাজা হাবীব আজমী (র) বললেন, আমি আমার মালিকের মজুর খাটি। অপেক্ষা করো। আমি হয়তো দ্রুতই রোজগার করে কিছু আনতে পারবো। বলেই তিনি মগ্ন হলেন উপাসনায়। সাধনায়। পার হয়ে যায় দিন রাত। কয়েক দিন। ওদিকে স্ত্রী অনাহারে। হঠাৎ বাড়ির ‍উঠোনে পদধ্বনী। খাজা হাবীব আজমী (র) এর স্ত্রী দেখলেন, চারজন সুদর্শন তরুণ হরেক রকম সুস্বাদু সব খাবার আর দিরহাম ভর্তি থলে নিজে হাজির। তাঁরা বললো, ‘আপনার স্বামীর মনিব তাঁর কাজের মজুরী পাঠিয়েছে। তিনি এলে বলবেন, তাঁর কাজে যত উন্নতি হবে, তাঁর মজুরীর ও ততো বাড়বে।’

অনাহারী স্ত্রীর জন্য অন্নসংস্থান করতে না পেরে অনন্যোপায় স্বামী খাজা হাবীব আজমী (র) চিন্তিত মুখে বাড়ি প্রবেশ করে দেখতে পেলেন, আটা, মাংস, মধু, ঘি সহ হরেক রকমের খাবারে বাড়ি ভর্তি। তাছাড়া দিরহামের থলে। স্ত্রীর মুখে শুনলেন সব। আপ্লুত হলেন। প্রভুর উদ্দেশ্যে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। বুঝতে পারলেন, স্বয়ং প্রভু ফেরেশতা মারফত খাবার পাঠিয়েছেন তাদের জন্য।

হযরত খাজা হাবীব আজমী (র) এর অলৌকিকতা

প্রগাঢ় ধ্যান সাধনা ও কঠোর উপাসনার মাধ্যমে হযরত হাবীব আজমী (র) হয়ে উঠেছিলেন মারিফতের এক মহাসমুদ্র। তার থেকে মাঝে মাঝেই প্রকাশ পেতো নানা অলৌকিক ঘটনাবলী। তাঁর দোয়া সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জুর হতো। একবার এক মহিলা তাঁর দরবারে আর্জি জানান যে, তার ছেলে দীর্ঘদিন হলো হারিয়ে গেছে। তিনি তার ছেলেকে ফেরত চান। হযরত খাজা হাবীব আজমী (র) এর দোয়ার বরকতে অতি দ্রুত মহিলাটির ছেলে ফিরে আসে।

বসরা শহরে একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়। সবাই অনাহারে দিনযাপন করছিল। তখন হযরত খাজা হাবীব আজমী বণিকদের নিকট থেকে শস্য ও আহার্য সামগ্রী কিনে গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। তিনি তাঁর বালিশের নিচে রক্ষিত একটি থলে থেকে মূল্য পরিশোধ করতেন। মূল্য পরিশোধ করার পর তাঁর টাকার থলে আবার পূর্বের মতো হয়ে যেতো।

হযরত খাজা হাবীব আজমী (র) এর প্রার্থনা ও অনুরাগ

খাজা হাবীব আজমী (র) আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলতেন, “হে প্রভু, আপনাকে লাভ করে যে খুশি হতে পারে নি, সে যেনো অন্য কিছু লাভ করেও ‍খুশি হয় না। আপনার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, অন্যের প্রতি যেনো তার আকর্ষণ না থাকে।”

কেউ একজন খাজা হাবীব আজমী (র) কে প্রশ্ন করলেন, প্রভুর সন্তুষ্টি কি করে লাভ করা যায়? তাঁর উত্তর, “হৃদয়কে একাগ্র ও অকপট হতে হবে।” কালামুল্লাহর পাঠ শুনলেই তিনি কান্না করতেন। বলতেন, আমি আজমী হলেও আমার হৃদয় আরবীয়।

ইলমে তরিকতের ঝান্ডাবাহক

বেলায়েতের কান্ডারী মাওলা আলী ইবনে আবি তালিব (আ) হতে রাসুলুল্লাহ (সা) এর গুপ্ত জ্ঞান তথা ইলমে মারিফতের ফল্গুধারা প্রবাহিত। যা জ্ঞান নগরীর তোরণ মাওলা আলী (আ) হতে সরাসরি লাভ করেন হযরত খাজা হাসান বসরী আল আনসারী (রা)। খাজা হাসান বসরী হতে সে জ্ঞানের অমীয় সুধা লাভ করেন হযরত খাজা হাবীব আজমী (র)। জগতে সমধিক প্রচলিত ও পরিচিত তরিকাদ্বয় ‘চিশতীয়া ও কাদরিয়া’ এর প্রচলন হযরত মাওলা আলী (আ) হতে খাজা হাসান বসরী (রা) এর মাধ্যমে।

খাজা হাসান বসরী (রা) হতে খাজা হাবীব আজমী (র) মধ্য দিয়ে যে গুপ্তজ্ঞানের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয় তা পরবর্তীতে ‘কাদরিয়া’ তরিকা নামধারন করে জগৎব্যাপী প্রচলিত আছে। তরিকত জগতের চৌদ্দ খান্দানের মধ্যে নয়টি খান্দান এর উৎপত্তি হয় হযরত খাজা হাবীব আজমী (র) হতে। দ্বীনে মোহাম্মদীর ইলমে মারিফত তথা প্রভুজ্ঞানের জগতে খাজা হাবীব আজমী (র) নামটি চিরভাস্বর থাকবে চিরকাল।

রচনাকাল – 15/05/2022
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর