লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
আধ্যাত্মিক লেখালেখির প্লাটফর্ম আপন খবর এ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক বিভিন্ন আর্টিকেল। তারই ধারাবাহিকতায় এবারে পাঠকদের জন্য থাকছে ধর্ম কি ও ধর্মের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত।
ধর্ম – ধর্ম শব্দটি এসেছে মূলত সংস্কৃত ধৃ শব্দ হতে। ধৃ অর্থ হচ্ছে ধারণ। মানুষ তার সামষ্টিক জীবনে যতগুলো বৈশিষ্টকে ধারণ করে তার সবগুলোকে একত্রে ধর্ম বলা হয়। মানুষের ধর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বিশ্বাস, পরম্পরাগত শিক্ষা, আচরণ বা ব্যাবহার ইত্যাদি। মানুষের ধর্মের কথা বলতে হলে বলা যায়, মানবিক গুণসমূহকে সংরক্ষন করা এবং আরো উচ্চতর গুণসমূহ অর্জন করার প্রচেষ্টাকেই ধর্ম বলে।
ধর্মের পরিধি – ধর্ম বা Religion শব্দটি পৃথীবির সর্বোচ্চ পরিচিতি ও ব্যাবহৃত একটি শব্দ। সবসময়ই ধর্ম শব্দটিকে একটি পবিত্র জীবনাদর্শ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ধর্ম সমূহ ধর্মের বিধানাবলীকে এমন ভাবে উপস্থাপন করে যে, ধর্মজগতে প্রবেশ করতে হলে ব্যক্তিকে প্রবলভাবে আচারনিষ্ঠ হতে হয় এবং নির্ধারিত কিছু মৌলিক বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়।
বৈশিষ্ট – কোনো প্রাণী বা বস্তুর বৈশিষ্টকেই ধর্ম বলে। জগতের সকল কিছুর কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট থাকে। সকল শ্রেণীর প্রাণীর মধ্যে কিছু আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট রয়েছে। জগতে সবচাইতে উন্নত মস্তিকের অধিকারী জীব হলো মানুষ। তাই মানুষের ধর্ম বা বৈশিষ্ট গুলোও উন্নত তথা মানবিক এবং সুন্দর। জগতে মানুষ বাদে অন্যান্য সকল জীবের ধর্ম বা বৈশিষ্ট গুলো হয়ে থাকে শুধূ ভৌতিক বা বস্তুগত বা গঠনগত বৈশিষ্ট। কিন্তু শুধু মানুষের মধ্যে রয়েছে মানবিক ধর্ম বা বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট।
বিশ্বাস, দয়া, প্রেম, ভালোবাসা, বিচার বিবেচনা সহ অসংখ্য সমুজ্জল গুণের অধিকারী হলো এই মানুষ। তাই জগতে একমাত্র মানব সমাজ পরিচালিত হচ্ছে তার মানবিক গুণ বা গুণসমূহের সংরক্ষণের নিমিত্তে গঠিত নানা ধর্ম বা ধর্মব্যাবস্থার দ্বারা। যদিও সকল মানুষ সমানুপাতে তার নিজস্ব ধর্ম কে ব্যাবহার করছে না।
যে ব্যক্তি বা যারা মানুষ্য দেহ ধারণ করে মনুষ্য সুলভ স্বভাব বা গুণ আত্মীকরণ করে স্থিত আছে মানব বৈশিষ্টে, তারাই পালন করছে মানুষের ধর্ম। আর যারা মানব দেহ লাভ করেও পালন করছে পশুধর্ম বা পশুবৈশিষ্টকে- পরিনামে তারা পশুত্বকেই গ্রহণ করে নিচ্ছে।
ইন্দ্রিয়ানুভুতি মানুষকে দিয়েছে এক অনন্য মর্যাদা। বিবেক প্রাচুর্য মানুষের জন্য স্রষ্টার সবচাইতে বড় উপহার। যার দ্বারা মানুষ স্থিত হয় স্ব স্ব ধর্মে।
ধর্মের উৎপত্তি – পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জগতে মানবেতিহাসের লিখিত বয়স ৫০০০ বছর। ঐতিহাসিক গণ এবং নৃতাত্ত্বিকগণ গবেষণায় পেয়েছেন, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই তথা সভ্যতার বহু পূর্বলগ্ন হতেই মানব সমাজ নানান বিশ্বাস বা সংস্কারের দ্বারা চালিত হয়ে আসছে। তখন থেকেই এমন এমন কিছু আচার অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে যেটা সরাসরি মানুষের বিশ্বাস এবং অতিপ্রাকৃত তত্ত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
ধর্মের ইতিহাস – সভ্যতার উষালগ্ন হতেই মানব সমাজ কালের বিবর্তনে গড়ে তুলেছে নানান ধর্ম। সংস্কার, বিশ্বাস আর আচার নিষ্ঠতার মাধ্যমে দিন দিন পরিচালিত হয়ে আসছে ধর্ম গুলো। প্রতিটি ধর্মেরই রয়েছে নিজস্ব কিছু মৌলিক বিশ্বাস ও আচরণ।
যুগে যুগে সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছে ধর্ম। উন্নত হয়েছে আচরণ বিধি। প্রতিটি ধর্মেই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর প্রধান বিশ্বাস হলো স্রষ্টায় বিশ্বাস। মূলত স্রষ্টায় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই টিকে থাকে ধর্ম।
ধর্মসমূহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব – মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই শুরু হয়েছে ধর্মের পথচলা। কালে কালে বিকশিত হয়েছে বহু ধর্ম। একেক ভূখন্ডে বা একেক সভ্যতায় বিকশিত হয়েছে একেক ধর্ম। ধর্মসমূহের শ্রেণীবিভাজন করলে এমন দাঁড়ায়…
- ইব্রাহামীয় ধর্ম তথা – ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, বাহাই ধর্ম, দ্রুজ ধর্ম।
- ভারতীয় ধর্ম তথা – সনাতন ধর্ম, জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, শিখ ধর্ম।
- পূর্ব এশিয় ধর্ম তথা – তাও ধর্ম, কনফুসীয় ধর্ম।
- পার্সী ধর্ম – জরথুষ্ট্রবাদ ইত্যাদি।
- অন্যান্য
সকল ধর্ম নিজস্ব বিশ্বাস সমূহ কে সংরক্ষণ করে। ইব্রাহামীয় ধর্ম বলে, জগতের সকল মানুষ আদম ও হাওয়া Adam & Eve থেকে জন্ম নিয়েছে।
ধর্ম বিশ্বাস – প্রতিটি ধর্মই বিশ্বাসের খুঁটিতে দাড়িয়ে থাকে। সেখানে ধার্মিককে স্রষ্টার অস্তিত্ব, ভালো মন্দ সহ অনেক বিয়ষাদির ওপর নির্ভর করে গড়ে তুলতে হয় তার সংস্কার। সেই সংস্কার রাশিই তাকে মানবতার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, মনুষ্যত্বের মুক্তির পথ দেখায়।
ধর্মতত্ত্ব – মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। যখন মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বকে হারিয়ে ফেলে এবং আপন অস্তিত্বে ধারণ করে নোংরামী তথা পশু প্রবৃত্তিকে, তখনই প্রয়োজনীয় অনুভূত হয় কোনো না কোনো ধর্মের। যে ধর্ম বিশ্বাস তথা আচার আনুষ্ঠানিকতা এবং বিশ্বাস সেই আপন হারানো মানুষটিকে আবার তার স্বধর্মে তথা মানবতায় স্থিত করবে।
ধর্মগ্রন্থ – প্রতিটি ধর্মেরই আছে তাদের নিজস্ব বিধানাবলীর সংকলন বা সংস্কার সমূহের ব্যাখ্যা গ্রন্থ যাকে ধর্মগ্রন্থ বলা হয়। ধর্মগ্রন্থ গুলো ঐশী আলোকের দ্বারা লেখা হয়। যার দ্বারা মানব সমাজ লাভ করে সত্য সুন্দরের শাশ্বত দেশনা। ধর্মগ্রন্থে মানব সমাজকে পথ বাতলে দেয়া হয়, যে পথে মানুষ লাভ করবে সঠিক স্বভাবের সুমহান আদর্শ।
পরিসমাপ্তি – পরিশেষে বলা যায়, ধর্ম হলো মানুষের মানবিক স্বভাব সংরক্ষণের প্রচেষ্টা। মানুষ তার মনুষ্যত্বের জাগরণের মাধ্যমে উন্নীত হবে উচ্চ থেকে উচ্চে – এটাই নিয়ম। তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে মানুষ কখনো কখনো নেমে যায় পশুর চাইতে নিচে। ধর্ম মানুষকে পথ দেখায় কিভাবে স্বভাব তথা সামগ্রিক আচরণ সুন্দর করার মধ্য দিয়ে মানুষ ফের উন্নীত হতে পারে মনুষ্যত্বে। অতএব, মানব জীবনে ধর্ম অপরিহার্য এবং মানবতার জন্য সবচাইতে প্রয়োজনীয় আদর্শ বটে।
ভ্রান্তি নিরসন – ধর্মের ছদ্মাবরণে বাস করা অপধার্মিকগণ যারা ধর্ম কে পুঁজি করে দিয়ে যাচ্ছে নানা মানবতা বিধ্বংসী অপসংস্কার, তারা অবশ্যই মানবতার শত্রু, ধর্মের শত্রু। তাদের থেকে সাবধান।
রচনাকাল – 10/08/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী