প্রবন্ধ – যেমন করে এলাম ভবে! “তানাজ্জালাতে ছেত্তা”

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

অনন্ত-অসীম এ ভ্রমান্ড (the universe) সাজানোর আদি কার্যকারণ কি? এক কথায় উত্তর দিবো রূপের ক্ষুধা (Appetite of form)। আল্লাহপাক রূপ গুণ ইচ্ছা সহযোগে সকল আদী-অনাদী কারণসমূহকে একত্রিত করে, সকল মাত্রা (Dimension) কে একটি বিন্দুতে সন্নিহিত করে অপ্রকাশ/অদৃশ্য অবস্থায় নিরাকার রূপে বেমেছাল-বেনজীর হয়ে গুপ্ত ছিলেন। যেখানে গুপ্ত ছিলেন সেটাকে আমরা গঞ্জমখফি (hidden treasure) বলে থাকি। নূর-ই-আহাদী তথা এককত্বের সুপ্ত রূপরাশির ভেতরে তথা স্রষ্টার অপ্রকাশিত জাত জগতে যখন প্রেমপূর্ণ রূপের অসীম তৃষ্ণা জাগ্রত হলো, তখনি তিনি তার গুপ্ত ধনভান্ডার থেকে বেড়িয়ে এলেন। স্ব-বিচ্ছিন্ন একত্ব (unity) থেকে বেড়িয়ে তিনি অ-বিচ্ছিন্ন বহুত্বে (the multitude) নিজেকে প্রকাশিত করলেন। আদি এরাদায় (Original will) সওয়ার হয়ে আপন কর্তৃত্বকে নিয়োজিত করলেন অনন্ত স্বীকৃতির পথে। সেই থেকে শুরু হলো রূপের পানে শক্তির নিরবধী বয়ে চলা। সর্বব্যপ্ত এক অসীম রূপের ক্ষুধা খোদাকে চালিত করেছে পথ থেকে পথান্তরে, অনু-পরমানু থেকে মহাবিশ্ব-অতিবিশ্বে, হৃদয়ের প্রেমানুভূতির এক অতিসুক্ষ (Super-subtle) কম্পন থেকে বস্তুতত্ত্বের সীমাহীন বিশালতায়।

আল্লাহপাক সকল সৃজনের আড়ালে অতি যত্নে বহুকালের লালিত স্বপ্নে ধীরে ধীরে তৈরী করেছেন এমন এক রূপের আর্শী, যে আর্শীতে আল্লাহপাক আপন সুরত-মাহাত্ম্য দর্শন করে নিবৃত্ত করতে পারবেন তাঁর অন্তরস্থিত অসীম রূপের ক্ষুধাকে। (প্রকাশিত হওয়ার ক্ষুধা)। যে আর্শীটি হলো ইনসানে কামিল বা মানবরূপ (Al-Insan al-Kamil)। গুপ্ত ধনাগার থেকে নূরের পূর্ণ প্রকাশ তথা রূপের পূর্ণ রূপায়ন (মানবসুরত বা আদমসুরত) পর্যন্ত স্রষ্টাকে পাড়ি দিতে হয়েছে সূদীর্ঘ পথ।

স্রষ্টার এই পথ পরিক্রমণ কে আমরা বলবো স্রষ্টার নজুলিয়াত বা খোদার অবরোহন বা রূপের পানে শক্তির নির্গমন (Disembarkation)। এই অবতরণ প্রক্রিয়া বুঝতে পারলেই আমরা অনন্ত শক্তির (Eternal power) অজুদে (Exstence) জহুর হওয়ার মূল প্রক্রিয়া (Fact) বোধগম্য করতে পারবো।

অনাদী শক্তিবিন্দু বা গঞ্জমখফি বা অপ্রকাশ অদৃশ্য থেকে পূর্ণরূপ মানবদেহ পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে খোদাকে পাড়ি দিতে হয়েছে ছয়টি বিশেষ স্তর। স্তর ছয়টিকে সুফি পরিভাষায় “তানাজ্জালাত ই ছেত্তা” বলা হয়।

১ম স্তর

আলম-ই-হাহুত (Realm of He-ness) : আহাদিয়াত। আদিমত্বের অপ্রকাশ পরম সত্ত্বা। স্বয়ং খোদার একজাত যা অনধিগম্য ও অতুলনীয়। হাহুত শব্দটি প্রকাশ হবার পূর্বেকার সারাংশকে বোঝায়। প্রাক-অস্তিত্ব ও সৃষ্টির পূর্বাবস্থা এটি (Realm of pre-existence and a level of non creation)। এখানে খোদা আপন পর্দায় আপনি লুকায়িত। অব্যক্ত, অচিন্ত্য সত্ত্বা (Entity) মহাবিন্দুতে আসীন যার কোনো ব্যাখ্যা নেই, উপমা নেই। স্থান কাল তথা আপেক্ষিকতার বাইরে পরম চৈতন্যের (Consciousness) ধ্যানাবস্থা এটি। এখানেই সকল শক্তি গুপ্ত অবস্থায় সুপ্ত থাকে এবং এখান থেকে স্বতোৎসারিত হয়ে নিয়ত প্রবাহিত হচ্ছে জগৎসমূহ। এ স্তরকে আহাদিয়াত বা এককত্ব বলে।

২য় স্তর

আলম-ই-ইয়াহুত (Realm of First Manifestation) : ওয়াহদাত। ইয়াহুত হচ্ছে প্রথম প্রকাশের স্তর। পরম চৈতন্যস্বরূপ “হু” তার অনন্ত অখন্ড ইচ্ছাশক্তিতে পৃথক হয়ে যখন নিজেকে নূর মোহাম্মদ রূপে প্রকাশ করলেন, সে অবস্থাকে বলা হয় আলম-ই-ইয়াহুত। নূর মোহাম্মদই হলো পরম সত্ত্বার হুবাহু প্রকাশ। এটি মূল সত্ত্বা (Original entity) থেকে বিচ্ছিন্নও নয়। ঐশ্বরিক পথ পরিক্রমণের এটিই প্রথম ধাপ। খোদায়ী গুণের ধারক ও বাহক নূর মোহাম্মদী এখান থেকেই সৃজনের যাত্রা (The Journey of Creation) শুরু করেন। এ স্তরকে ওয়াহদাত বা তিনিত্ব বলে।

৩য় স্তর

আলই-ই-লাহুত (Realm of Absolute Unity) : ওয়াহেদিয়াত। প্রভুর পরম ঐক্যতার ক্ষেত্র এটি। খোদার সমষ্টিগত সংক্ষিপ্ত গুণসমূহের ভান্ডার লাহুত। নূর মোহাম্মদের অনন্ত নূরের দরিয়া থেকে এখানে রুহ (The devine soul) প্রকাশিত হয়। এখানেই খোদার গুণাবলি প্রকাশিত হয় অর্থাৎ এটি অনুভূত জগৎ। সৃষ্টি প্রক্রিয়া প্রকাশ এখান থেকেই হয়ে থাকে। এ স্তরকে ওয়াহেদিয়াত বা আমিত্ব বলে।
দ্রষ্টব্য : উপরোক্ত ৩ টি স্তরকে খোদার খাসজগত বা গুণাতীত গুণের জগত বা অসৃষ্টির (No creation) জগত সাব্যস্ত করা হয়। ৩ “হু” সম্বলিত ৩ টি জগত (হা’হু’ত, ইয়া’হু’ত, লা’হু’ত) খোদার সত্ত্বাকে ধারণ করে এবং এখান থেকেই জগতসমূহ নিয়ত প্রলম্বিত (bloomed) ও বিকশিত হচ্ছে। উপরোক্ত ৩ টি স্তর মূল জাত উলুহিয়াতের স্তর তথা খোদার খাসমহল।

৪র্থ স্তর

আলম-ই-জবরুত (Realm of Intelligence) : জবরুত শব্দের অর্থ সেতু যা দুটো জিনিসকে যুক্ত করে। উপরোক্ত ৩ স্তরকে তথা উলুহিয়াতকে রবুবিয়াত বা প্রকাশ জগতের সঙ্গে যুক্ত করে আলমে জবরুত (Realm of power)। এখানে খোদায়ী গুণরাশি বিস্তৃত ও পৃথক পৃথক ভাবে প্রকাশিত হয়। প্রথম ৩ স্তরের খোদায়ী জাত ও সিফাত তথা বস্তুশক্তি (Material power) ও গুণশক্তি (Quality) এখানে মূর্ত হয়ে ওঠে বিস্তারিত ভাবে। এ শক্তিজগত থেকেই দেহজগত পানে যাত্রা শুরু করে ‘ওয়াজেবল অজুদ’ বা সুক্ষ দেহ।

৫ম স্তর

আলম-ই-মালাকুত (Realm of Soul) : the world of archetype images (not necessarily in the visual sense)। বুদ্ধিমত্তা তথা ফেরেশতার (the angels) জগত এটি। এ জগতেই আত্মা সক্রিয় হয়। তথা মানবিক গুণবালীর জাগরণ এ স্তরে ঘটে থাকে। আত্মাসমূহের সমাবেশস্থল হলো মালাকুত (আলমে আরওয়াহ ও আলমে মেছাল)। এ জগতে বস্তুনিচয়ের অশরীরী প্রতিভাস বিম্বিত (reflection) হয় এবং মালাকুতের অবভাস ছায়াস্বরূপ পতিত হয়েই বস্তুজগৎ গঠন করে।
দ্রষ্টব্য : ৪র্থ ও ৫ম স্তর কে রবুবিয়াত জগৎ বলা হয়। উলুহিয়াত জগতের শক্তি রবুবিয়াত জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যে অবভাস তৈরী করে তাই দেহজগত তথা বস্তুজগতে দৃশ্যমান হয়।

৬ষ্ঠ স্তর

আলম-ই-নাসুত (Realm of Physical bodies) : বস্তুজগত। মালাকুত জগতের তথা শক্তিজগতের যে কাঠামো তৈরী হয় তার অবভাস বস্তুর ওপর পতিত হয়ে যে রূপ/শেকেল/নকশা তৈরী করে দৃশ্যমান করে তোলে তাই আলমে নাসুত। নাসুত জগৎটিই বাস্তব জগতের ভিত্তি। অধরা সত্ত্বা (Non living) আল্লাহ স্বয়ং হাড় মাংসের আবরণে লুকিয়ে এখানেই কুদসি, ইনসানি, হায়ানী, নাবাতী, জামাদী শক্তি প্রকাশ করে।
দ্রষ্টব্য : ৬ষ্ঠ স্তরটিকে আবুদিয়াত জগৎ বলা হয়। এ জগত রূহ-ই-নূরাণী তথা নূর দেহের প্রকাশিত রূপ। রূপ ধারণের আবশ্যিক মন্থনে এখানে নানা প্রবৃত্তির (tendency) জন্ম হয়।

তানাজ্জলাতে ছেত্তাকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। অজুদে জাতের জহুরকে ছয়টি মর্তবায় উল্লেখ করা হয়। যথা :
১.সেফাতে এজমালি, ২.সেফাতে তফসিলি, ৩.আলমে আরওয়াহ, ৪.আলমে মেছাল, ৫.আলমে আজছাম, ৬.আলমে ইনছান

অনাদী অনন্ত বেমেছাল সাঁই তাঁর অবিনাশী ইচ্ছাশক্তিতে ছয়টি আইয়াম (aeon) তথা স্তরে নজুলিয়াতের ধারায় ক্রমাগত নাযিল হচ্ছেন বস্তুজগতে, তার অন্তর্নিহিত গুণের ফোঁয়াড়া জারি করার মানসে। এখানে সৃজনের আবশ্যিক গতি প্রকৃতিতে আমরা মানবকূল সদাপ্রাপ্ত আত্মা হারিয়ে পরিচয়হীন জিবনকে বহন করে চলেছি। স্রষ্টার অরুজ-নজুল তথা আগম-নিগমের তত্ত্বজ্ঞান অর্জন করে যেন আমরা আপন অস্তিত্বকে স্রষ্টার চিরকালীন অস্তিত্বে সমর্পন করে লাভ করতে পারি চিরকল্যাণ। প্রভু আমাদের সহায় হোক।

রচনাকাল – 20/10/2022
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
সম্পাদক – আপন খবর
চেয়ার‌ম্যান – আপন ফাউন্ডেশন

আপন খবর