লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
গ্রীক পুরানের আইগেউস ও আইথ্রার একমাত্র পুত্র বীর থিসিয়াস। যিনি মিনোটর নামের ভয়ংকর রাক্ষসকে বধ করে তার নিকট বন্দী এথেন্সের বহু যুবককে উদ্ধার করেন। যে জাহাজে করে তিনি এই বিজয় অভিযান পারফরর্মড করেন, গ্রীক রাজা সে জাহাজটিকে প্রিজারভেশন করার আদেশ দেন মহান স্মৃতিটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এথেন্সের ঘাটে যেন চিরকাল টিকে থাকে থিসিয়াসের জাহাজটি।
চিরকাল তো দূরের কথা, কিছুকাল পর থেকেই শুরু হলো বিপত্তি। ধীরে ধীরে ডিকম্পোজ হতে শুরু করলো জাহাজটি। রাজার আদেশে পচে যাওয়া তক্তাগুলো সাথে সাথে ট্রান্সফার করা হতে থাকলো নতুন ও মজবুত কাঠ দিয়ে।
এথেন্সের এক চতুর মিস্ত্রি, যে জাহাজ হতে ফেলে দেয়া পুরনো কাঠগুলো সংগ্রহ করে নিজের বাড়িতে সেই কাঠের একটি নৌকা তৈরী করে ফেললেন। যেদিন, থিসিয়াসের জাহাজ হতে ফেলে দেয়ে হলো সর্বশেষ কাঠটি, সেদিনি সেই চতুর মিস্ত্রি দাবি করে বসলেন, “ঘাটে নেই থিসিয়াসের নৌকা, মূল নৌকাটি রয়েছে তার উঠানে।”
শুরু হলো যুগ যুগ ধরে চলমান একটি বিতর্ক। মূল নৌকাটি কোথায়? ঘাটে? নাকি মিস্ত্রির উঠানে?
কেউ কেউ বললেন, মিস্ত্রির উঠানের নৌকাটিই মূল থিসিয়াসের নৌকা। কারণ, লিটারেলি সেখানেই রয়েছে থিসিয়াসের মূল কাঠগুলো বা বস্তুগত উপাদানগুলো।
কেউ কেউ বললো, ঘাটের নৌকাটিই মূল নৌকা। যেখানে ম্যাটেরিয়াল বডি এবসেন্ট থাকলেও রয়েছে থিসিয়াসের বিজয় অভিযানের সকল স্মৃতি। কাঠ পরিবর্তিত হলেও এখানেই রয়েছে দীর্ঘ সময়ের অনুভূতি, উপলদ্ধি সহ থিসিয়াসের অভিযানের অবস্তুগত সকল উপাদান, যা সঠিকভাবেই সে সময়গুলোর প্রতিনিধিত্ব করে।
বস্তুগত এবং ভাবগত, দুভাবেই জিবন উপস্থিত হয় আমাদের বোধির কেন্দ্রে। দেহজিবন নিয়ত ক্ষয়ে যায়, পচে যায়, বদলে যায়। পরিবর্তনের আড়ালে তবু টিকে থাকে এক অনন্ত গতি। দেহজিবনের আড়ালে অবস্থান করে দেহাতীত নিত্যতার এক সুবিশাল ব্যাপ্তি। যে জিবনটিও নিয়ত পরিবর্তন হয়, যেখানেও রচিত হতে থাকে অসীম মোশনের এক কগনিটিভ বৃত্ত। মূলত সে জিবনটিই আমাদের মূল জিবন।
ফিসসোফিক্যাল প্যারাডক্সটি আমাদের জিবন দর্শনের সাথে খুবি কমপটিবল। আমরা কেউ কেউ মনে করি, আমাদের ফিজিক্যাল ইনটিটি টিই মূলত “আমি”। অস্তিত্বকে দেহ তথা বস্তু কনটিনজেন্ট করে ফেলি। মূলত যেখান থেকেই জন্ম নেয় আমাদের সকল হতাশা, গ্লানি, জরা-ব্যাধি সমেত সকল বিকার। ইটারনাল জিবনে লিমিটেশনের যন্ত্রনা সাফার করি। অস্তিত্বের ইন্টেলেকশন যেখানে হওয়ার কথা ছিল “শাশ্বত”, সেখানে আমরা হয়ে উঠি মিনিমল। কারণ, দেহসাপেক্ষ জিবন কখনোই পূর্ণ জিবন নয়। জিবনের একটি ইনস্ট্রুমেন্ট মাত্র, যা নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, সংযোজিত বিয়োজিত হচ্ছে তথা যেখানে প্রতি মুহূর্তে পারমুটেশন ও কম্বিনেশন ঘটছে।
আমাদের জিবন মূলত লিমিটলেস ডিভাইন সেন্টিমেন্টের জগৎ। যেখানে নিয়ত পরিবর্তনশীল ম্যাটারের ওপর অস্তিত্বশীল অনন্ত পারসেপশনের সীমাহীন জগৎ। স্থবির বস্তুজাগতিকাতার উর্দ্ধে যেখানে রয়েছে ইনফিনিট কনশিয়াসনেস। সে জগতের অপার আনন্দ অনুভব করার মতো এবজরপশন পাওয়ার তৈরী করা সম্ভব হলে এখানেই আমরা অনুভব করবো চিরকালীন স্বর্গীয় সুখ। এখানেই জিবনের সফলতা।
দেহকেন্দ্রিকতা কখনোই জিবন নয়। জিবন সীমাহীন অনুভব-উপলদ্ধির জগত। যেখানে সীমায় অসীম চৈতন্য বিরাজ করে।
রচনাকাল – 18/04/2023
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী