লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
সুফিবাদ বা তাসাউফ হলো ইসলামী আধ্যাত্মবাদ বা দ্বীন ইসলামের প্রকৃত সত্য। যে সত্য মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে চিরমুক্তির দ্বার। সুফিবাদ হলো এমন একটি দর্শন, যা শুধু ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের নয়, সকল মানুষকে দেখায় বাস্তব মুক্তির পথ। দাসত্বের নিগঢ় ভেঙ্গে বাহিরে আসার পথ।
সুফিবাদ একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। যারা জীবনে তথা ধ্যানে-চিন্তনে-মননে তথা সার্বিক জীবনকর্মের মধ্যে সুফিবাদী দর্শনের চর্চা করে তাদেরকে বলে সুফি। সুফিদর্শন একটি চেতনা যা সমুন্নত করে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ, হৃদয়ে জাগ্রত করে শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা এবং মানুষকে শেখায় প্রকৃত মানুষ হতে।
সুফিবাদ এর তথা সুফি দর্শনে আত্মা সম্পর্কিত আলোচনাটাই মূখ্য। আত্মিক পরিশুদ্ধতার মধ্য দিয়ে মহামহিম খোদাতায়ালার স্বানিধ্যে পৌঁছার পথ বা পথ সম্বন্ধীয় জ্ঞানই হলো সুফি দর্শন।
সুফিবাদের উৎপত্তি
সুফিবাদ মূলত একটি ধর্মদর্শন যা মানুষের আত্মিক মুক্তির পথ নির্দেশ করে। সুফিবাদ ধর্মের মতোই পুরনো এবং চিরকালের। সুফিবাদ বা মানবমুক্তির দর্শন সুসংবদ্ধ এবং সংহত রুপ ধারণ করে শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা) এর সময় হতে। হযরত মোহাম্মদ (সা) এর দ্বারা প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত দ্বীন ইসলাম পূর্ণাঙ্গ রুপেই সুফিবাদী দর্শন তথা তাসাউফ বা আত্মিক পরিশুদ্ধতার পথ পরিক্রমণ। যাকে ইসলামী পরিভাষায় তাযকিয়ায়ে নফস ও বলা হতো।
কিন্তু তৎকালীন মূর্খ যাযাবর আরব সমাজ হযরত মোহাম্মদ (সা) প্রচারিত এই মহান আত্মোপলব্ধি ও আত্মবিনির্মাণের পথ পরিত্যগ করে দ্বীন ইসলাম কে তাদের অজ্ঞতার দ্বারা পূণঃনির্মাণ করে নেয়। ফলে আত্মপরিচয়ের দ্বীন পর্যবসিত হয় নিছক আচারনিষ্ঠতায়। তারপর ও হযরত মোহাম্মদ (সা) এর হাতে গোনা মুষ্টিমেয় কিছু সাহাবী বা অনুসারীগণ মনে প্রাণে ধারণ করেছিলেন রাসুল প্রবর্তিত তাযকিয়ায়ে নফসের শিক্ষা। তাদের মাধ্যমেই মূলত জগতে এখনো প্রচারিত আছে সেই অমোঘ ধর্মবিধান। যে ধর্ম বা দর্শন মানুষ কে রিপুনিচয়ের শৃঙ্খল হতে মুক্ত হতে শেখায়। সেই ধর্ম বা দর্শনটিই হলো সুফিবাদ।
সুফিবাদের প্রকাশ
মুষ্টিমেয় কিছু সাহাবী যারা মনে প্রাণে অনুসরণ করতের রাসুল (সা) কে এবং তাকে জীবনের চাইতে বেশি ভালোবাসতেন, তাদের দ্বারাই প্রচারিত হয়েছে সুফিবাদ। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন রাসুল (সা) এর সবচাইতে নিকটজন মাওলা আলী ইবনে আবি তালিব (আ)। মুলত তাঁর থেকেই উৎপত্তি হয়েছে সকল সুফি তরিকার। যারা জীবন দর্শনে চিত্রায়িত করেছেন সুফিবাদ বা দ্বীন ইসলামকে।
সুফি সংজ্ঞা ও শব্দ বিশ্লেশন
সুফিবাদ কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায় নয়, এটি একটি দর্শন। জগতের সকল পবিত্র বা পরিশুদ্ধ মানবমন্ডলীকে সুফি বলা হয় এবং হৃদয় কে পরিশুদ্ধ করার পথ পদ্ধতিটিই হলো সুফিবাদ। সুফি শব্দটির উৎপত্তি আরবী সাফা শব্দ থেকে যার অর্থ পবিত্রতা। পাপহীন হয়ে যাওয়া। এটাকে তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি ও বলা হয়।
সুফি পথ পদ্ধতি
সুফিবাদ নিজেকে জানার মাধ্যমে পরম সত্ত্বাকে জানার পথ নির্দেশ করে। সুফিবাদের মূল ধারাটি হলো পবিত্র কোনো জ্ঞানী মানুষ বা পরিশুদ্ধ মানুষের নিকট নিজেকে সমর্পন করে তাঁর নির্দেশিত পথে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া। যারা সর্বান্তকরণে পরিশুদ্ধ নয়, তারা কোনোভাবেই সুফি নয়। সমর্পনের এ পদ্ধতিটিকে বলে বাইয়াত বা মোবাইয়াত। বাইয়াত গ্রহণ করে তথা শুদ্ধ মানুষের চরণে নিজেকে উৎসর্গ করলেই আপনত্বে ধীরে ধীরে ফুটে উঠবে শুদ্ধতার ছাপ।
সুফি তরিকাসমূহ
আদি কাল হতেই জগতে শুদ্ধতার চর্চার জন্য নানান পথ পদ্ধতি ব্যাবহৃত হয়ে আসছে। তার মধ্য একমাত্র সত্য এবং শ্রেষ্ঠতম পদ্ধতিটিই হলো জ্ঞানী নিকট নিজেকে উৎসর্গ করে জ্ঞানী হওয়া। এটাই সুফিবাদের মূল ভিত্তি। ইসলামী দর্শন বা আত্মমুক্তির দর্শন রাসুল (সা) এর সময়কাল হতেই যুগে যুগে ভোগবাদীদের দ্বারা প্রবল নির্যাতিত ও অত্যাচারিত হলেও প্রকৃত দ্বীনের মোহাম্মদীর শিক্ষা রয়ে গেছে কিছু সুফি তরিকার মধ্যে।
যারা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই মানুষকে দ্বীনে মোহাম্মদীর মূল আদর্শ শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। তারাই পীর মাশায়েখ। তাদের প্রবর্তিত ধারাক্রমগুলোকেই তরিকত বা তরিকা বলে। রাসুল (সা) হতে মুল ধর্মচেতনা ও ধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য বা শিক্ষা প্রাপ্ত হন মাওলা আবি তালিব (আ)। তাই রাসুল (সা) তাঁকে জ্ঞান নগরীর দ্বার বলে অভিহিত করেছেন। মাওলা আলী (আ) এর ছয়জন প্রধান শিষ্য হতে জগতে প্রচারিত সকল সূফি তরিকাসমূহের উৎপত্তি। তাদের মধ্যে প্রধানতম মাওলা হাসান বসরী আল আনসরী (রা) হতে বিশ্বপরিব্যাপ্ত তরিকাদ্বয় চিশতীয়া এবং কাদরীয়া প্রচারিত হয়।
সুফি দর্শন
সুফিবাদ হলো সহজাত মানবধর্ম। যা মানুষকে মানুষ হতে শেখায়। মানুষ স্বভাবতই পশুত্বের গুণ খাছিয়তে আবদ্ধ। স্বভাবসুলভ অপটুতায় সে নিয়ত লিপ্ত হয় মোহ কালিমায়। আপনার সৌন্দর্যকে ধুলিস্যাৎ করে নির্দিধায়। সুফিবাদ মানুষকে শেখায় কি করে আপনত্বে বিরাজিত কু-স্বভাবগুলো পরিহার করে চর্চা করা যায় শুদ্ধতার। সুফিবাদ মানুষকে শেখায় কি করে নফসানিয়াত তথা পশুত্বের দেয়াল ভেঙ্গে স্থিত হওয়া মনুষ্যত্বের অমর লোকে। সুফিবাদ মানুষকে শেখায় কি করে পবিত্র মানুষে আত্মসমর্পন করে সে পবিত্র মানুষটির পবিত্র গুণগুলোকে আপন অন্তকরণে ধারণ করে স্থিত হতে হয় আলোকিত জগতে। আলোকিত জগতে উত্তরণের পথপদ্ধতিটিই হলো সুফিবাদ বা সুফিদর্শন।
শিক্ষা
সুফিবাদ একটি অসাম্প্রদায়িক উদার ও মহৎ জীবন ব্যাবস্থা। যেখান মূখ্য আলোচ্য বিষয় হলো নিজেকে মহৎ মানুষে পরিণত করা। মানব সত্ত্বাকে মহিমান্বিত পরম সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত করে তাঁর গুণে গুণান্বিত হয়ে প্রভূময় হয়ে যাওয়া। প্রভুময় মানুষটি সদা মুক্ত ও সদাশান্ত। প্রভূময় হওয়ার পদ্ধতিটি হলো প্রভূপ্রাপ্ত ব্যাক্তিগণের অনুরুপ হয়ে যাওয়া বা তাঁদের অনুকরণ অনুসরণের দ্বারা নিজেকে তাঁদের গুণে গুণান্বিত করা। যাকে বাইয়াত বা সমর্পন বলে। বাইয়াতের মাধ্যমেই মানুষ শুরু করে তার পরিশুদ্ধিতার পথে পথচলা।
পরিশেষ
জগতের একমাত্র বাস্তবমুক্তির কার্যকর দর্শন হলো সুফিদর্শন। যা কোনো নিছক আচার আনুষ্ঠানিকতা বা কোনো ধর্ম জাতির গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। ইহা সার্বজনীন। জগতের যে কোনো পবিত্র মানুষটিই সুফি। তাঁর দেখানো পথটিই সুফিবাদ। যার মানুষকে উন্নীত করবে প্রকৃত মনুষ্যত্বে।
রচনাকাল -12/08/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী