লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
বিশ্বের বৃহৎ ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা –
জগতের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মানুষ। জগতের চালিকা শক্তি এই মানুষ। সমস্ত বিশ্ব ভ্রমান্ড চরমভাবে মানুষ সাপেক্ষ তথা মানুষ কেন্দ্রিক। মানুষ তার মানবতা ধর্ম বা মানবতা মাহাত্ম্যের দ্বারা যুগ যুগান্তর ধরে পরিচালনা করে আসছে পৃথীবিকে।
তবে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মানুষেরও পদস্খলনও কম হয়নি! যুগে যুগেই মানুষ তার আপন মাহাত্ম্য ভুলে গিয়ে নিজেকে শামিল করেছে অজ্ঞতায়, অন্ধকারে। যখনই মানুষ ভুলে গেছে তার স্বমহিমা, তখনই মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকূপ থেকে উত্তরণের জন্য ধরনীতে আবির্ভূত হয়েছে কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ। যারা আপনাপন জ্ঞানশক্তির দ্বারা পথ প্রদর্শন করেছেন অজ্ঞমূর্খ মানব জাতিকে। প্রবর্তন করেছেন বিভিন্ন ধর্ম। নিয়ে এসেছেন ঐশী প্রেরণার আলোক ধারা তথা ধর্মগ্রন্থ।
ধর্ম
মানুষের সামগ্রিক জীবন নির্দেশনাই মূলত ধর্ম। যুগে যুগে মানুষের সার্বিক শুদ্ধতার জন্য জ্ঞানীগণ প্রবর্তন করেছেন নানান বিধান। সাম্য, মৈত্রী, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির বাণী নিয়ে যুগে যুগে মানুষকে পথ দেখিয়েছে ধর্ম। আবার শতাব্দ সহস্রাব্দ ধরে ধর্মের কারণেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি রক্তারক্তি। তবে জগতে এমন মানুষের সংখ্যাও প্রচুর, যারা কোনো ধর্মবিধান পালন করে না।
বিভিন্ন ধর্মসমূহ
পৃথীবির যাবতীয় ধর্মের উৎপত্তি স্থান মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতবর্ষ। পৃথীবির সকল ধর্মগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন –
- ইব্রাহিমীয় ধর্মসমূহ
- ভারতীয় ধর্মসমূহ
- পার্সি ধর্মসমূহ
- পূর্ব এশীয় ধর্মসমূহ
- এবং অন্যান্য প্রাচীন ধর্ম
ইব্রাহিমীয় ধর্মসমূহ
ইসলাম ধর্ম – ইসলাম হলো একেশ্বরবাদী ধর্ম যেখানে স্রষ্টায় তথা স্রষ্টা মনোনীত একজন পবিত্র ও পরিশুদ্ধ মানুষে পূর্ণ সমর্পনের মাধ্যমে নিজেকে শুদ্ধতায় স্থিত করতে হয়। কুরআন হলো ইসলাম ধর্মের ধর্মগ্রন্থ যেখানে জীবনের সকল বিষয়ের শুদ্ধতম পাঠ সংযোজিত। হযরত মুহাম্মদ (সা) ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ও শেষ নবী বলে স্বীকৃত।
আব্রাহিমীয় ধর্মসমূহের মধ্যে ইসলাম অন্যতম। বর্তমান পৃথীবিতে ইসলাম ধর্ম পালন কারী মানুষের সংখ্যা ১৯০ কোটি এবং ধর্মটি পৃথীবির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইসলাম ধর্ম পালন কারীর সংখ্যা। বিশ্বের সবচাইতে ক্রমবর্ধমান ধর্মের তালিকাতে ইসলাম ধর্ম শীর্ষে।
খ্রিস্ট ধর্ম – আব্রাহামীয় অন্যতম একেশ্বরবাদী ধর্ম হলো খ্রিস্ট ধর্ম। যিশু খ্রিস্টের কর্মশিক্ষাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে ধর্মটি। তাদের ধর্মগ্রন্থ হলো বাইবেল বা নিউ টেস্টামেন্ট। তারা বিশ্বাস যীশু খ্রীস্ট হলো ঈশ্বরের পুত্র। ইসা মসীহ বা যীশু কে ইসলাম ধর্ম ও নবী ও রাসুল বলে স্বীকৃতি দেয়। খ্রীস্টধর্মের অনুসারীগণ খ্রিস্টান নামে পরিচিত।
২১০ কোটির মতো অনুসারী রয়েছে খ্রীস্ট ধর্মের। এটিই পৃথীবির সবচাইতে বড় ধর্ম।
ইহুদী ধর্ম – ওল্ড টেস্টামেন্ট বা তাওরাত কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা অত্যন্ত প্রাচীন একটি ধর্ম হলো ইহুদী ধর্ম। ইব্রাহিমীয় ধর্মের মধ্যে এটি অনেক পুরনো। মোজেস বা মুসা হলো ধর্মটির প্রবর্তক। এই ধর্মটি সেমেটিক ধর্ম বলেও অভিহিত হয়। ইহুদীধর্মের অনুসারীগণ সংখ্যায় ১৪০ লক্ষ।
মান্দাই ধর্ম – মান্দাই ধর্ম অনেক প্রাচীন একটা ধর্ম। আলো এবং অন্ধকারের উপাসনা করে তারা। তারা বিশ্বাস করে আত্মা অবিনশ্বর ও চিরন্তন। ষাট থেকে সত্তর হাজারের মতো অনুসারী রয়েছে ধর্মটির।
ভারতীয় ধর্মসমূহ
হিন্দু ধর্ম – ১০০ কোটির ও বেশি অনুসারী নিয়ে হিন্দুধর্ম পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম হলো হিন্দু ধর্ম। এটিই ভারতীয় অঞ্চলের বৃহত্তর ধর্মবিশ্বাস ও সংষ্কার। বহু ঐতিহ্য ও লৌকিক প্রথার সমন্বয়ে হিন্দু ধর্ম বহুধাবিভক্ত একটি ধর্ম। বহু শাস্ত্র গ্রন্থ রয়েছে তাদের। উল্লেখযোগ্য হলো – বেদ, রামায়ন, মহাভারত, গীতা, উপনিষদ ও অন্যান্য। হিন্দু ধর্মকে সুপ্রাচীন ধর্ম মনে করা হয়ে থাকে।
বৌদ্ধ ধর্ম – আত্মপোলব্ধি ও ধ্যানসাধনার মাধ্যমে পরমসত্ত্বা প্রাপ্তির এক অন্যতম ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম। গৌতম বুদ্ধ বোধিবৃক্ষ তথা জ্ঞানবৃক্ষের তলায় দীর্ঘকাল ধ্যান সাধনার ফলশ্রুতিতে প্রাপ্ত আত্মপোলব্ধির মহান শিক্ষা মানুষের দ্বারে দ্বারে প্রচার করেছেন। তার প্রচারিত ও প্রবর্তিত ধর্মকেই বৌদ্ধ ধর্ম বলে। চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার সহ নানান রাষ্ঠে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাস করে।
শাক্ত ধর্ম – শক্তির উপাস্যদের শাক্ত বলা হয়। পরমব্রহ্ম দেবী তথা শক্তিরুপিনী মাতৃশক্তির উপাসনার ধর্মটিই শাক্ত ধর্ম।
শিখ ধর্ম – গুরু নানক জী প্রবর্তিত ধর্ম হলো শিখ ধর্ম। গুরু ভজনা ও গুরু উপসনাই শিখ ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য ও পালনীয়। সকল ধর্মের সার অংশ কে গ্রহণ করে গুরু নানকজী এবং অন্যান্য শিখ ধর্মনেতাগণ পরিশিলিত গুরুবাদের যে চর্চা করেন তাই শিখ ধর্ম নামে পরিচিত।
জৈন ধর্ম – সর্বজীবে শান্তি ও অহিসংসার বিধান নিয়ে আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমণ ও জগৎজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ধর্মবোধটি জৈন ধর্ম নামে পরিচিত।
পারস্যের ধর্মসমূহ
জরথুস্ত্রবাদ – বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্ব ও ধর্মপন্ডিত জরথুস্ত্র কর্তৃক প্রাচীন পারস্যে প্রবর্তিত হয় জরথুস্ত্রবাদ। প্রাচীন ইরানের সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের জাতীয় ধর্ম ছিল এটি।
বাহাই ধর্ম – বাহাউল্লাহ কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্ম হলো বাহাই ধর্ম। মানবজাতির আত্মিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা কল্পে ধর্মটি পথচলা শুরু করে। ইরানি ধর্মটির অনুসারী সংখ্যা ৬০ লক্ষ।
পূর্ব এশিয়ার ধর্ম সমূহ
তাওবাদ – প্রাচীন চীনা দার্শনিক লাওৎসে তাওবাদ প্রচার করেন। লাওৎসে একজন পুরোদস্তুর আধ্যাত্মিক চেতনার মানুষ বা চরম পর্যায়ের প্রকৃতিবাদী ছিলেন।
শিন্তো ধর্ম – জাপানের আচারনিষ্ঠ ধর্ম হলো শিন্তোধর্ম। জাপানের ৮০ শতাংশ মানুষ শিন্তো রীতিনীতি পালন করে। শিন্তো ধর্মবিশ্বাসে আধ্যাত্মিকতার প্রবল প্রভাব রয়েছে।
কনফুসিয় ধর্ম – নৈতিক ও দার্শনিক চেতনাসমৃদ্ধ ধর্মবিশ্বাস হলো কনফুসিয়বাদ। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস প্রবর্তন করেন ধর্মটির। এটি মূলত চৈনীক সভ্যতার তথা চীনা সমাজব্যাবস্থার এক সুসংহত জীবনপ্রণালী।
অন্যান্য ধর্মসমূহ
প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম – প্রাচীনকাল মিশরে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় রীতিনীতি প্রচলিত ছিল।
আর্য ধর্ম – আর্যজাতি পারস্য থেকে ভারতে এসে তাদের নিজস্ব চিন্তা চেতনার দ্বারা আপন ধর্মীয় বলয় তৈরী করে নিয়েছিলেন।
প্রাচীন গ্রীক ধর্ম – গ্রিস দেশে প্রাচীন কাল থেকে নানান জনপ্রিয় ধর্মবিশ্বাস, মিথ, উপাখ্যান প্রচলিত ছিল।
এছাড়া ইনকা ধর্ম, সামারিতান ধর্ম সহ যুগে যুগে পৃথীবিতে প্রচলন হয়েছে নানান ধর্মের।
পরিশেষ
বিশ্ব মানবতার মুক্তির পথ পদ্ধতিকেই ধর্ম বলা হয়। যে বিধানাবলী মানুষের আত্মশক্তি জাগ্রত করবে তাই হবে তার ধর্ম দর্শন। সুতরাং ধর্ম যেনো আমাদেরকে কোনো মাদকতায় আচ্ছন্ন না করে মনুষ্যত্ব অর্জনে সহায়তা করে।
রচনাকাল – 11/08/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী