প্রবন্ধ – শাশ্বত চেতনার স্ফুরণ; মানবীয় অস্তিত্বের পরিণতি

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আমাদের অবশ্যম্ভাবী পরমগতি প্রভু সমীপে উপস্থিত হওয়া। স্রষ্টা তাঁর প্রেম বাসনায় অতি যত্নে আমাদের সৃজন করেছেন, আবার তাঁর বাসনান্তে আমাদের ফিরিয়ে নিবেন তাঁর অন্তহীন প্রেমের আবহে। তাঁর কাছেই ফিরে যাবো আমরা সবাই। ব্যাবধান শুধু এটুকু যে, কেউ আগে যাবো আর কেউ পরে। কিন্তু তাঁঁর সমীপবর্তী হতেই হবে আমাদের। তবে কেনো তাঁর থেকে দূরে থাকার এতো বৃথা আয়োজন? যদি ফিরতেই হবে তাঁর দ্বারে, তবে সে মহিমান্বিত “ফেরা”র জন্য প্রস্তুত হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?

প্রভু আমাদেরকে বারবার আহ্বান করছেন তাঁর নিকট ফিরে যেতে। তাঁর কাছ থেকেই এসেছি আমরা। এখানে (ধরাতে) এসে ক্ষণিকের মিথ্যা মায়ায় জড়িয়ে ভুলে আছি সেই আমার আদি নিবাসকে। ভুলে আছি সেই পরমাত্মীয় কে, যার নিকট থেকেই এসেছি আমি। জাগতিকতার মোহপাশে বদ্ধ হয়ে আছি আমি। হৃদয় আজ রুদ্ধ! শুনতে পাচ্ছি না পরমপ্রভু সেই প্রেমময় ডাক। মায়া মোহের জঞ্জালতায় ছেঁয়ে আছে চিত্তের তটভূমি। হৃদয়কে শুদ্ধ করা গেলেই শুনতে পারা যাবে সেই মহিমাময়ের প্রেমময় ডাক। শুদ্ধ হৃদয়ে তাঁর দিকে এগোলেই তিনি প্রেমভরে আমাদেরকে গ্রহণ করবেন।

সেইতো প্রকৃত ধার্মিক, যিনি এ মায়া সংসারের সমস্ত বাধ্যবাধকতা ত্যাগ করে আপন হৃদয়কে সমর্পিত করেছেন ঈশ্বর চরণে। জগতের সকল ভোগ বিলাস, মায়া মোহ তথা সকল রিপুনিচয়ের পাশবিকতা পরিহার করে যিনি আপন অস্তিত্বকে সঁপে দিয়েছেন প্রভুর চরণকমলে, তিনিই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।

প্রতিটি মানবীয় অস্তিত্বে, অস্তিত্বের আদি কারণ হয়ে স্বয়ং পরমাত্মা সদা বিরাজ করেন। সাধক হৃদয় যখন সকল কামনা বাসনা পরিহার করে সে পরমাত্মার শরণ নেয়, তখনই তাঁর সর্বব্যাপী মূর্ত হয়ে উঠে স্বয়ং পরমসত্ত্বা। তখনই তিনিই পরিণত হন স্বয়ং পরমে। তখন আর তাঁর সংসার যাতনা থাকে না।

সংসার সবসময়ই আমাদের তার মোহজালে বেধে রাখে। আমাদের কে সে বন্ধন দেয় পারমার্থিক চেতনা। এ পারমার্থিক চেতনাই আমাদের প্রভু সমীপবর্তী হওয়ার প্রেরণা দেয়। হৃদয়ে যখনি উৎপন্ন হয় সাংসারিক কামনা বাসনা, তখনই ঢাকা পড়ে যায় আত্মায় প্রজ্জলিত পরমের সূর্য। জাগতিকতার মেঘে যখন পরমাত্মা ঢাকা পড়ে তখনই মানুষ হারিয়ে ফেলে হিতাহিত জ্ঞান। জ্ঞানশূণ্য হয়ে তখন সে প্রতিনিয়ত অধর্মের যাতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। মানুষটি নিমজ্জিত হয় ভয়ংকর অন্ধকারে। অজ্ঞানতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে সে প্রতিনিয়ত জুলুম করতে থাকে আপন আত্মার ওপর। তাই এ মানুষকে সবসময় জুলুমকারী রুপে সাব্যাস্ত করা হয়। আপন আত্মা খুইয়ে এই বোধহীন মানুষগুলো জারজ তথা পরিচয়জ্ঞানহীন অবস্থায় নিন্মদেশে অবস্থান করতে থাকে। মৃত্যুর অধীন হয়ে তারা ধ্বংসের করাল গ্রাসে পতিত হয় প্রতিনিয়িত।

“এই ধ্বংসের অতলে নিমজ্জিত মানুষগুলোকেই প্রভু ডেকে ডেকে ফিরছেন শ্বাশত মুক্তির ধামে ফিরে আসার জন্য। নিত্য আনন্দের দেশে ফিরে আসার জন্য। প্রভু সমীপবর্তী হওয়ার জন্য।”

সংসারের পথে চলতে চলতে আমরা অনিত্য জ্ঞানে তথা অনিত্য বস্তুমোহে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আমাদের সাথী হয় সংসারের ক্ষণস্থায়ী মোহ। আমরা বিচ্যুত হই নিত্য পরমাত্মা থেকে। ফলে অনিত্যের বন্দীদশায় লীন হয় আমাদের মানবীয় মহত্ত্ব। আমরা বাস করি খন্ডিত চেতনায়। ধ্বংস তথা কেয়ামতের করাল ছোবলের মধ্যে। যদি আমরা সংসারে থেকে সংসারাসক্ত না হয়ে পরমাত্মার পথে চলতাম, তবেই সে মহিমাময় নিত্য পরমাত্মাই হতো আমাদের সাথী। আমরা স্থিত হতাম তাঁর নিত্যলোকে, গোলোকধামে।

সংসারাসক্তির এ রুচি যেদিন আমাদের হৃদয় মন তথা অন্তকরণ হতে বিদায় নিবে সেদিনই আমাদের ভিতর বাহিরে জেগে উঠবে প্রভুপ্রেমের এক অনন্ত প্রেরণা। সেদিনই আমরা মানুষ হবো। প্রভু প্রেমের প্রেমিক হবো। সেদিনই আমরা শুনতে পাবো প্রভুর আকুল আহ্বান।

সংসার তো বাকীর খেলা। এখানে উত্থান পতন দুটোই বাকী। ছেলে ভোলানো এক মিথ্যা কারসাজীর রংবাজার হলো এ জগত সংসার। এখানে আবদ্ধ হলে প্রাপ্তি তো দূরের কথা, সব হারানো ব্যতিত আর কিছুই হয় না। আর পরমাত্মার জগত সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে পৌঁছতে পারলে পতন তো হবেই না, বরং চিরকালে তথা চিরজীবনে উত্থান সাথে সাথেই হবে।

জয় হউক মানবের নিত্য চেতনার।

রচনাকাল – 20/10/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর