লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
আমরা স্রষ্টার প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। প্রভুর প্রেম তিয়াসা মেটাবার নিমিত্ত জন্ম আমাদের। অনন্ত প্রেমের ভান্ডার স্বরূপ স্বয়ং প্রভু আপন অস্তিত্বে নিহিত ছিলেন। প্রেম প্রকাশের তাড়নায় তিনি সমগ্র জগৎ সংসার সাজাইলেন। তৈরী করলেন তার প্রেমলীলা প্রকাশের ক্ষেত্রস্বরূপ এই মানুষকে।
মানুষের একমাত্র কর্তব্য হচ্চে সেই পরম প্রেমময়ের সাথে প্রেমলীলায় লিপ্ত থাকা। অপার প্রেমের বৃন্দাবন স্বরূপ তিনি জগতকে সাজিয়েছেন। কিন্তু আমরা জগতে এসে জগতের মায়ামোহে বিস্বরণ হয়ে আছি সে মহাপ্রেমিকের প্রেমলীলার কথা। দিব্যি ভুলে আছি তাঁকে। আমাদের সকল ধর্ম চেতনার মূল কথাই হলো প্রভুপ্রেমে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখা।
জাগতিকতা থেকে সম্পূর্ন মোহ দূরীভূত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রভুতে শুদ্ধপ্রেম অসম্ভব। যখনি হৃদয় অবমুক্ত হবে সকল জাগতিকতা থেকে, তখনি হৃদয়ে জন্ম নিবে শুদ্ধপ্রেম, ভক্তি তথা ভগবানে অনুরক্তি। ভগবানে অনুরক্তি জন্মানোর সহজ পন্থা হলো সদা সর্বদা তাকে একান্ত নিজের হৃদয়ে স্বরণ সংযোগে রাখা। যে বস্তু নিজের, সবসময়ই তাঁর প্রতি প্রেম জাগ্রত থাকে। একান্তই আশ্চর্যের কথা, যা আমার, যা চিরকাল আমার, যাতে আমার অস্তিত্ব, যা চিরন্তন – তা আমার প্রিয় হয় না, অথচ প্রিয় হয় যতসব জাগতিক নশ্বর বিষয়াদি। বিনাশী বস্তুমোহে আবদ্ধ থাকা মানেই অবিনশ্বর সত্ত্বা থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
প্রভুর সাথে আত্মিক সংযোগ ব্যতিত সকল জপ তপ, ধ্যান সাধনা, পূজা অর্চনা, ইবাদত বন্দেগী, সব বৃথা। তীর্থে তীর্থে হাজার জনম কাটালেও বিন্দুমাত্র উপকার হবে না যদি না হৃদয়ে বাঁধা হয় স্রষ্টার প্রেমের রশি। তাঁর সাথে সুদৃঢ় একাত্মতা হলে সকল স্থানে, সকল অবস্থাতেই পূজা হবে। জগতের যত তপস্যা, এসকল দ্বারা শক্তি লাভ হতে পারে, কিন্তু যিনি প্রেম লাভ করতে চায়, তাকে ভগবানের সাথে একাত্ম হতে হবে। জ্ঞান বা শক্তি সে অপূর্ব প্রেমমহিমার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। প্রেমে যে অনন্ত মহানুভুতি, জ্ঞান তার ধারে কাছেও যেতে পারে না। জ্ঞান সর্বোচ্চ মানুষ খন্ড থেকে উত্তীর্ণ হয়ে অখন্ড আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু প্রেম আপনাকে দান করবে অনন্ত আনন্দ। জ্ঞানে ভেদাভেদ হতে পারে, প্রেম আপনাকে পৌঁছে দিবে একত্বের মহিমায়।
ভক্তিই প্রেমের সরল বহিঃপ্রকাশ। প্রভুতে দুর্ণিবার আকর্ষণ অনুভূত হওয়াই ভক্তি। ভক্তি এমন এক অনুষঙ্গ যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাবে।
মানুষ স্বভাবতই মুক্তিতে আশাবাদী। জ্ঞানের মুক্তির চাইতে প্রেমের বন্ধন অনেক বেশি আনন্দের। মুক্তিতে আমরা যে আনন্দ অনুভব করি, স্বয়ং প্রেম সে আনন্দের দাতা। মুক্তি নয়, আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত প্রেমের বাঁধন। প্রেম আমাদের বেঁধে রাখবে মহাপ্রেমে। তবে প্রেমে জ্ঞানের ভূমিকাও কম নয়। জ্ঞান বিনা প্রেম মোহ ডেকে আনে আর প্রেম বিনা জ্ঞান শুধুই শূণ্যতা। ভক্তিকে আশ্রয় করে যারা সাধনা করে শুদ্ধ প্রেমের, প্রভুপ্রেমে যারা আহুতি দেয় নিজেকে, তারাই লাভ করে অনন্ত প্রেমের আনন্দ। সে সচ্চিদানন্দ সুধায় অবগাহন করে সে মহৎ মানুষটি স্থিত হয় মানবীয় স্বর্গে। লাভ করে চির প্রশান্তি। আর যারা প্রেম কে অবহেলা করে দৌঁড়াচ্ছেন অন্যান্য হাজারো মতবাদ বা বহু অনুষঙ্গ এর পেছনে, তারা অবশেষে লাভ করবে শুধুই শূণ্যতা।
যাকে লাভ করা আবশ্যিক, যে সত্ত্বা ব্যাতিত আমাদের অস্তিত্ব অকল্পনীয়, আমরা অজ্ঞানতার বশে তাঁকেই অস্বীকার করে আছি। আর যা একান্তই অলীক, অনস্তিত্ব- সেসকল জঞ্জালতার স্তুপকে আঁকড়ে আছি! কত বড় এ মূর্খতা! পরমাত্মার সাথে প্রেম আমাদের পরম মোক্ষ। যে প্রেম আমাদের অনিত্যতাকে ধুয়ে মুছে আমাদের কে উত্তীর্ণ করবে নিত্যতায়, সে প্রেমলীলা অস্বীকার করেই চলছে আমাদের দিনাতিপাত! বোধের জাগরণ ঘটুক আমাদের। সকল হৃদয়ে প্রজ্জলিত হউক প্রভুপ্রেমের অপূর্ব নূরের বাতি। সে প্রদীপের আলোয় নির্মিত হোক আমাদের ধর্মপথ। আমাদের ভক্তিপথ। জাগতিকতার নাগপাশ চ্ছিন্ন করে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক নিত্যতা। প্রেমময়তা হোক আমাদের ভূষণ।
অনুরাগ সাধনায় প্রভুপ্রেম অধিষ্ঠিত থাকুক আমাদের সর্ব অস্তিত্বে।
রচনাকাল – 20/10/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী