লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
ধর্ম মানেই অটল নিষ্ঠা ভক্তি। যুগে যুগে ধর্ম প্রতিপালিত হয়েছে ভক্তদের দ্বারা। ভক্তরাই ভক্তিচিত্তে ধারণ করে ভগবানকে। যার হৃদয়ে নেই অচলা ভক্তি, সে তো ধর্ম পথের জঞ্জাল ব্যতিত অন্য কিছু নয়। ভক্তি-বিশ্বাস-প্রেম, এ তিনের সমন্বয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্ম। বৃথা পান্ডিত্যের অহংকার তথা ঔদ্ধত্য নিয়ে যারা ধর্ম বুঝতে চান বা ধর্ম করতে চান, তারা বৃথাই লাফাচ্ছেন। ধর্ম আত্ম নিবেদনের বিষয়। একান্ত চিত্তে ভগবান তথা মানুষ গুরুর চরণকমলে নিজেকে উৎসর্গ করে তার চরণের ধুলি হয়ে যাওয়ার মধ্যেই নিহিতি ধর্মের সকল মর্ম।
যদিও প্রেম আর জ্ঞান সম্পুরক, তবুও ভক্তিমার্গে প্রেমটাই মূখ্য। প্রেমিকের বহু আচরণ, বহু কথাবার্তা এমনকি জ্ঞানীও বুঝতে পারে না। প্রভু কে লাভ করতে হয় প্রেমের আচরণ দিয়ে। আর প্রেমের আচরণ সর্ব অবস্থাতেই প্রেমিককে করে তোলে ভক্তিপ্রবণ। প্রেমাস্পদ এর নিকট চরম সমর্পনই তখন মূখ্য হয়ে উঠে প্রেমিক চিত্তে। সকল অহমিকা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ জ্ঞান করে সে নিজেকে বিলীন করে দেয় ভগবানের তথা মানুষগুরুর চরণে। সে ভক্তটিই গুরুর যথাযথ নির্দেশনায় হয়ে ওঠে প্রকৃত ধার্মিক।
তখন সে ভক্তটি শুধুমাত্র তাঁর ভগবানের তথা মুর্শিদের বা গুরুর সেবা করেই আনন্দ পায়। গুরুপদে নিজের সব বিলিয়ে দিয়ে গুরুময় অস্তিত্বের অধিকারী হয়ে স্বার্থক করে তোলে তাঁর মানব জনম। বলা হয়, গুরুতে নিষ্ঠ তথা সমর্পিত একজন ভক্তের মর্যাদা দেবতা থেকেও বেশি। এ ভক্তই লাভ করে প্রভুর দীদার তথা পরম প্রভুর স্বানিধ্য। তারাই প্রকৃত ধার্মিক।
ধর্মপথে একজন ভক্তের কর্তব্য শুধু গুরুর শ্রীপাদপদ্মে নিজেকে পূর্ণ সমর্পণ করা তথা শরণাগত হওয়া। মানুষ গুরুর শরণ নিলে সে ভক্তের আর ভজনা করতে হয় না। তাঁর ভজনা আপনা আপনিই হয়ে যায়। কারণ, সে তো পরমে আশ্রয়েই আছে। তাঁর সকল কাজই তখন ভজনা। সে ভক্তটি শুধু পূর্ণ নিবেদনে থেকে গুরু সেবায় ব্যাস্ত থাকে। যে ভক্তটি নিজের কোনো বিশেষত্ব না দেখে কেবল নিজেকে দীনহীন জেনে, নিরহংকারী হয়ে একাগ্র চিত্তে পড়ে থাকে দয়ালের চরণে, সে ভক্তটির উপর ই দয়ালের সমস্ত করুণার বিগলিত ঝর্ণা ধারা প্রবাহিত হয়। গুরু হৃদয়ে তার নিবেদিত ভক্তের প্রতি যে ভালোবাসা, কৃপা আর করুণা তা বলে বোঝানো অসম্ভব।
একজন নিবেদিত ভক্ত, সে যেই হোক না কেনো, এ জগতের শ্রেষ্ঠ বিদ্বানের চাইতে সে উত্তম। ধর্মজ্ঞানে পান্ডিত্য অনেকেরই থাকতে পারে, কিন্তু ভগবানের করুণা একমাত্র সেই লাভ করবে যার রয়েছে অচলা ভক্তি, যার রয়েছে শর্তহীন সমর্পণ, যার রয়েছে পূর্ণ আনুগত্য-নিবেদন।
জগত সংসার হতে মুখ ফিরিয়ে একজন খাঁটি ভক্ত সর্বাবস্থায় আপন দৃষ্টি নিবন্ধ রাখে শুধু তার দয়াল তথা পরমের প্রতি। ভগবানের প্রতি। ভক্তটির ধ্যানে, চিন্তনে, মননে শুধু প্রতিফলিত হয় তার ভগবানের শ্রীরুপ। এভাবেই প্রতিনিয়ত ভগবানের অর্চনায় ভক্তটির হৃদয় হয়ে উঠে গুরুকেন্দ্রিক। একটা সময় তাঁর আর ভগবানের ধ্যান চিন্তন ব্যতিত অন্য কিছুতে মন বসে না। এরুপ ভক্তকেই খাঁটি ভক্ত বলা হয়।
বৃথা পান্ডিত্য বা দুনিয়াবি কোনো নিয়ামক দিয়ে নয়, প্রকৃত ধার্মিক চিনতে হবে তাঁর ভক্তির আলোকে। জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ সেই, যার হৃদয় ভরা রয়েছে ভক্তিধন। ভক্তিধনে ধনী মানুষটাই জগতের সেরা ধনী। যার হৃদয় মন সর্বদা গুরুতে তথা ভগবানে লিপ্ত থাকে, তাকে কখনো সাধারন ভাবা যাবে না। সে সরাসরি প্রভুপ্রাপ্ত আর প্রভুতে সমাহিত। সে সদা প্রভুতে বাস করে। সে নিত্যধামের বাসিন্দা। চির সবুজ গোলোকধামের বাসিন্দা। তাঁর প্রতিটি কর্মে পূজা সাধিত হয়। তিনি সর্বদা মহাভাবে লিপ্ত থাকেন। তিনিই জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ।
আমাদের ধর্মচেতনা প্রতিষ্ঠিত হোক প্রেম ভক্তি আর বিশ্বাসের স্তম্ভের ওপর। তবেই আমরা হবো খাঁটি ধার্মিক। নতুবা বৃথা ধর্মজ্ঞানী সেজে কোনো লাভ হবে না। চরম বিনয়, আদব আর ভক্তিনিষ্ঠা পারে একজন মুক্তিকামী কে মুক্তির সন্ধান দিতে।
প্রভুগুরু সকলের সহায় হোক।
রচনাকাল – 20/10/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী