লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
মানব জিবনের একমাত্র পূর্ণতা ও সফলতা হলো ঈশ্বর প্রাপ্তি তে। যদি কেউ লাভ করে ঈশ্বরকে, তবে জগতের লাভ করার তাঁর আর কিছুই থাকবে না। না থাকবে আর কিছু জানার বা না থাকবে অন্য কোনো নিয়ামকের প্রয়োজনীয়তা। ঈশ্বরকে লাভ করতে সক্ষম হলে আমাদের হৃদয় থাকবে সদা সদ্ভাবে পরিপূর্ণ। সে ঈশ্বরপ্রাপ্ত মানুষটিই হবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তখন তাঁর মাধ্যমে অন্যরা ও লাভ করবে ঈশ্বরকে।
মাছ যেমন সদা আকুল থাকে জল বিহনে, তেমনি যে হৃদয় ঈশ্বর বিহনে সদা আকুল থাকে, তার পক্ষে ঈশ্বরকে লাভ করা কঠিন কিছু নয়। সংসারের সকল প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির উর্ধ্বে উঠে যিনি সদা নিমগ্ন থাকেন ভগবানের চিন্তায়, সেই আত্মমগ্ন সাধক খুব সহজেই ঈশ্বরকে লাভ করে থাকেন।
প্রকৃত সাধকতো তিনিই, যিনি সংসারের কোনো প্রাপ্তির আশা রাখেন না। কারণ সংসার হলো ক্ষনস্থায়ী। বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনো ক্ষণকালের প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। আর পরমাত্মা শ্বাশত বা চিরন্তন। তাঁকে লাভ করা হলো চিরকালের লাভ। তাই জ্ঞানী সর্বদাই পরমাত্মায় সন্তুষ্ট থাকেন। আর পরমাত্মা থেকে কখনো নিরাশ হতে হয় না।
সাধকের হৃদয়ে ভগবৎ প্রাপ্তির বাসনা যত ব্যাকুলতা লাভ করে, তাঁর ভগবৎ প্রাপ্তির পথ তত সহজ হয়ে আসে। ভগবান ‘আত্ম’তে লুকায়িত। যখন সাধক আপন সাধনার বলে তাঁকে খুঁজে বের করবেন, দেখে ফেলবেন, তখন ভগবান আর লুকিয়ে থাকবেন না। সর্বদিক থেকে সর্বঅবস্থায় প্রতিনিয়ত তিনি প্রকাশিত হবেন।
আর যদি আমরা বিমুখ হই পরম সত্ত্বা থেকে, তবে অনিবার্য ভাবেই আমরা বঞ্চিত হবো আমাদের পরমাত্মীয় আত্মা থেকে। ঈশ্বর প্রাপ্তি থেকে। আপন অন্তর থেকে। যখন আমরা কোনো ক্রিয়াকে নয়, বরং ভগবৎ প্রাপ্তির সহায় অবলম্বন করবো নিখাঁদ প্রেমকে, তখন ভগবান তাঁর স্বরুপ উন্মোচন করতে বাধ্য হবেন।
ভগবান নিত্যপ্রাপ্ত। ভগবান চিরন্তন। ভগবান চিরস্থায়ী। যখন আমরাও জিবন সাধনার বলে নিজেকে চিরন্তন বা শ্বাশত কালে উত্তীর্ণ করতে পারি, তখনই ভগবান আমাদের হবেন। যতক্ষন আমরা বন্দী আছি ক্ষণকালে, যতক্ষন আমরা লিপ্ত আছি অনিত্য মোহে, যতক্ষন আমরা মৃত্যুর অধীন হয়ে আছি – ততক্ষণ আমরা শত চেষ্টা করেও সেই চিরনিত্য ভগবানকে লাভ করতে পারবো না। কারণ অনিত্য পাত্রে নিত্য বস্তুর ধারণ হয় না।
যে উদ্দেশ্যে আমাদের সৃষ্টি, যার জন্য আমাদের জন্ম, সেই প্রভুকে লাভ করাই যদি কঠিন কার্য হয় তাহলে সংসারে সহজ কাজ কোনটি?
ভাব-ব্যাকুলতাই ভগবাৎ প্রাপ্তির পথের পাথেয়। হঠকারিতা কখনোই সেই নিরন্তর মহিমাকে অর্জন করতে পারে। শুদ্ধ প্রেমের আচার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন সেই প্রেমময় সত্ত্বা। এবং সেই পরম সত্ত্বার আগমনে, ভগবৎপ্রাপ্ত মানুষটিও পরিণত স্বয়ং ভগবানে। তখন সর্বদা তাঁর ভিতরে বাহিরে বিরাজ করে মহাপ্রেমভাব। সে জগতের পলে পলে তখন বিলিয়ে বেড়ান প্রেমধন। তখন সে মানুষটির সেবা করলে ভগবানের সেবা করা হয়। সে মানুষটিকে সন্তুষ্ট করলে ভগবানকে সন্তুষ্ট করা হয়।
প্রেমের পথে সবচাইতে মূল্যবান হলো ভাব-ভক্তি-প্রেম-বৈরাগ্য। জগতের আসক্তি ত্যাগ করে ভগবানের আসক্ত হতে হয়। জগতের আসক্তিই হৃদয়কে কঠোর করে তুলে। আমাদেরকে বঞ্চিত করে রাখে মহাপ্রেমভাব থেকে।
এটাই চির সত্য যে, একমাত্র লাভ করার বিষয়টিই হলো পরমাত্মা। কারণ একমাত্র পরমাত্মায় অস্তিত্বশীল বা বর্তমান। আমরা জাগতিকে যে সমস্ত বিষয় বা বস্তু লাভ করার অহমিকা করে থাকি, আসলে তার অস্তিত্ব বলে কিছু নেই। অর্থাৎ তা লাভ করা যায় না। অনিত্য বা অনস্তিত্ব কিছু লাভ করার অহমিকা নিশ্চয়ই বোকামী!
আমরা নিয়ত জগতে বন্দী। জগতের লিপ্সায় বন্দী। কামনা বাসনায় বন্দী। জগতের অনিত্যতায় বন্দী। যদি আমরা যুক্ত হতে পারি চির স্বাধীন তথা সর্ব-অমুখাপেক্ষী ঈশ্বর এর সঙ্গে তবেই আমরাও লাভ করতে পারবো সকল বন্দীত্ব হতে স্বাধীনতা। তবেই আমরা হবো নিত্য। তখনই আমরা হবো প্রকৃত ধার্মিক।
মনে রাখা দরকার, ভগবৎ প্রাপ্তি কর্মের নয়, কৃপার ফল। আমরা আমাদের সুকৃতির দ্বারা যদি অর্জন করতে পারি ভগবানের সন্তুষ্টি, তবেই তিনি দয়াপরবশ হয়ে আমাদেরকে তাঁর স্বানিধ্য দ্বারা সৌভাগ্যবান করবেন। ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটবে। বাস্তবে তিনিই বিদ্যমান। কেবল তাঁর অস্তিত্বই বিদ্যমান। “অজ্ঞানতার অন্ধকার ত্যাগ করে যখন আমরা শরণ নিবো তাঁর, তখন তিনি আমাদের পতিতপাবণ হয়ে উদ্ধার করবেন।” তখনই আমরা হবো মুক্ত।
ভগবান সকলের সহায় হোন। ভগবৎ প্রাপ্তির দ্বারা জ্যোতির্ময় হোক সকলের অন্তকরণ। জয় হোক সত্যের।
রচনাকাল – 20/10/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী