প্রবন্ধ – স্বরূপ – অখন্ড মহাকালে ব্যাপৃত চিরন্তন স্বরূপ তত্ত্ব

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

স্বরূপ হলো অখন্ড জগতে স্থিত পরম সত্ত্বার রূপ। যার কোনো লয়, ক্ষয়, পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা বিনাশ নাই। জগতে দুটি অবস্থা নিয়ত অস্তিত্বশীল। একটি শ্বাশত, চিরকালের বা মহাকালের। অন্যটি ক্ষনিকের, ধ্বংসশীল। সাধকের উচিত সর্ব অবস্থাতেই চিরন্তন বা শ্বাশত অস্তিত্বের দিকে তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ রাখা। জগতের মায়া মরিচিকার মোহে আবদ্ধ সাংসারিক জীবেরা সর্বদাই অনিত্য তথা নশ্বর বস্তুমোহে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা। ফলশ্রুতিতে বন্দীদশাই হয় তাদের পরিণতি। ঘুরপাক খেতে থাকে অনিত্যের অকুল দরিয়ার মধ্যে। সাধক সেই, যে অনিত্য বস্তুমোহ অতিক্রম করে নিজেকে নিত্যের সাধনায় নিয়োজিত রাখে।

পরম প্রভু চিরনিত্য। তিনি একমাত্র নিত্যের দেশেই বাস করেন। অনিত্যের দেশে খুঁজলে প্রভুকে কভূও লাভ করা যাবে না। তাঁকে পেতে হলে আপন অস্তিত্ব হতে ত্যাগ করতে হবে সকল প্রকার অনিত্যের জঞ্জালতা। তবেই দয়াময় আসীন হবে সাধকের হৃদয় পদ্মে।

জগতের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদেরকে সবসময় কামবিকারে আবদ্ধ করে। আর পরম সত্ত্বা নিষ্কাম। স্বরূপ সত্ত্বাও নিষ্কাম। সকাম ভাব হৃদয় হতে ত্যাগ করাই সাধকের সাধনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। “জগতের বন্ধন সবসময়ই দুঃখ আনে। আর পরমের বন্ধন সবসময়ই মুক্তি আনে।” আমরা যতক্ষন বিনাশশীল জগতের বন্ধনে আবদ্ধ থাকি তথা আমাদের অস্তিত্বকে ধ্বংসের মোহে ঢেকে রাখি ততক্ষন আমরাও বিনাশশীল জগতের সাথে সাথে বিনাশ হতে থাকি। কিন্তু আমাদের স্বরূপ বিনাশের উর্ধ্বে। আমাদের স্বরূপ সর্বপ্রকার দুঃখভোগ বা সুখভোগের উর্ধ্বে নিত্য লীলায় মগ্ন। আমরা অনিত্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকলে বিচ্ছিন্ন থাকি পরম হতে তথা স্বরূপ হতে। আর আমরা স্বরূপ তথা পরমে লিপ্ত থাকলে পৃথক থাকি জগত হতে।

যা চিরকাল থাকবে না তথা যা নশ্বর, তা থেকে পৃথক থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

স্রষ্টা চান যে আমরা তাঁর শরণ নেই। কিন্তু আমরা অজ্ঞানতার মোহে পড়ে প্রতিনিয়ত স্রষ্টা কে ভুলে জাগতিক নশ্বর বস্তুর শরণ নিয়ে নিজের মহত্ত্বকে হেয় করে চলেছি। জগতের সঙ্গে সম্পর্কের আধিক্যই আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে সবচাইতে বড় অন্তরায়।

আমাদের শরীর বস্তুজগতের নিয়মের মুখাপেক্ষী। কিন্তু আমরা স্বয়ং স্বরূপের তথা পরমের অধীন। আমরা নিয়ত যুক্ত পরমাত্মার সাথে। পরমাত্মার সাথে যুক্ত থেকেও তা আমরা জানি না। অজ্ঞতায় আমরা অস্বীকার করছি পরমকে। যখনই আমরা পরমাত্মার সাথে একাত্মতায় লীন হতে পারবো তখনই উপলব্ধ হতে স্বরূপ। আমাদের স্বরূপ হলো অখন্ড সত্ত্বা। আর স্বরূপ ভুলে আমরা যে অস্তিত্বে নিয়ত বাস করছি তা হলো খন্ডিত অহং। অহং ত্যাগেই মুক্তি আর স্বরূপ ত্যাগেই বন্ধন। সাধক সদা সর্বদাই অহং ত্যাগ করে স্থিত হয় স্বরূপে তথা পরমে। পরমে স্থিত হলেই সে সত্ত্বা সুখ দুঃখের উর্দ্ধে উঠে নিত্যকালে স্থিত হয়।

আমাদের সবচাইতে আপন হলো আমাদের স্বরূপ। আত্মপরিচয় লাভ না করার কারণে আমরা স্বরূপতত্ত্ব কে জানি না। স্বরুপ বাদে জগতের সবকিছুই আমাদের পর বা দূরের।আপন বা কাছের স্বরূপকে জানাই যদি কঠিন হয়, তাহলে আমাদের জন্য সহজ হবে কি? পরমের সহিত নিত্য স্থিতির উপলব্ধিই সাধককে নিয়ে যায় চিন্ময় প্রেমের অমর লোকে।

আমাদের অস্তিত্ব অত্যন্ত মহান অস্তিত্বের অংশ। আমরা স্বয়ং পরমাত্মার অংশ। এর চাইতে বড় লজ্জার আর কি থাকতে পারে যখন আমরা ভুলে যাই যে, আমরা পরমাত্মার অংশ!  স্বরূপ কে ভুলে যাওয়া মানেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা। নিজেকে হারিয়ে মানেই হলো খন্ডিত বা বিনাশশীল হয়ে যাওয়া তথা মৃত্যুর অধীন হয়ে ধ্বংসলোকে বাস করা যা অত্যন্ত অনুতাপের আর যন্ত্রনার।

আমাদের সত্ত্বা চির পবিত্র। জগতের সকল পবিত্রতার আধার সে। স্বরূপের মধ্যে বিন্দুমাত্রও অপবিত্রতা বা নোংরা নেই। আমরা অজ্ঞতার কারণে স্বরূপকে শুধু অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হই না, স্বরূপ কে নানা অপবিত্রতা বা নোংরামির দ্বারা ঢেকে রাখি।

মনে রাখা দরকার যে, আমরা দেহের বা জগতের বা জমীনের অধীন নই। দেহ আমাদের স্বরূপের অধীন। দেহসত্ত্বা নির্মিত হয় স্বরূপ সত্ত্বার বাসের জন্য। আমরা দেহে চরমভাবে লিপ্ত হওয়ার ফলে স্বরূপকেই অবহেলা করি। স্বরূপ বিনা দেহসত্ত্বার কোনো অস্তিত্ব হয় না কিন্তু শরীর বিনা স্বরূপ সত্ত্বার কিছুই যায় আসে না। সেই প্রকৃত সাধক, যিনি স্বরূপ কে উন্মোচিত করেন আপন অস্তিত্বের মধ্যে আর নিজে লিপ্ত হন স্বরূপ তথা পরমে। তিনিই বাস করেন অখন্ড গোলোক ধাম তথা নিত্যধামে। থাকে নিত্য আনন্দে। মগ্ন থাকেন নিত্যলীলায়।

রচনাকাল – 20/10/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর