লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
অনুচরবর্গসহ এক তাপস একবার অরণ্যে ভ্রমণ করছিলেন। ঘণ অরণ্যের মাঝে হঠাৎ তারা দেখতে পেলেন একটি বিপুল ধনভান্ডার। স্তুপিকৃত রাশি রাশি স্বর্ণ রৌপ্য ছিল সেখানে। দরবেশের অনুচরবর্গ তৎক্ষণাৎ ঝাপিয়ে পড়লো ধনভান্ডারের ওপর। যে যা পারলো কুক্ষিগত করলো সেসব ধনরত্ন।
কিন্তু সেসব ধনরত্নের মোহ বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারলো না দরবেশের হৃদয়কে। ধনাগারের দুয়ারে একটি কাঠের ফলকে লেখা ছিল মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র নাম মুবারক। দরবেশ সেই ফলকটি সযন্তে গ্রহণ করে পরম ভক্তিভরে বারবার চুমু দিতে লাগলেন।
রাতে স্বপ্ন দেখলেন দরবেশ। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাকে বলছেন, হে দরবেশ! তুমি ধনের মোহাক্রান্ত না হয়ে যেভাবে চৌকাটের ফলকে অঙ্কিত আমার নামকে ভক্তি করেছো, আমি খুশি হয়ে তোমার জন্য জাহেরী বাতেনী সকল ইলেমের দরজা তোমার জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম।
তাপসপ্রবর হযরত জুননুন মিশরী। তাঁর পুরো নাম সাওবান ইবনে ইব্রাহিম আল মিশরী। জন্ম ১৫৫ হিজরি মোতাবেক ৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে। সংসার বিরাগী এক অপূর্ব আধ্যাত্ম জিবনশৈলীর অধিকারী সাধক পুরুষ। তার বোনও ছিলেন মহাতপস্বী। নির্জনে ঈশ্বরসাধনায় মগ্ন থাকতেন জুননুন মিশরী। অসংখ্য কারামত তথা অলৌকিক ঘটনায় ভরপুর তাঁর মহাজীবন।
একবার এক রাজপুত্র জুননুন মিশরীর কাছে এসে জানতে চাইলো, হুজুর, আল্লাহর দীদার লাভের উপায় কি? তাপসপ্রবর বললেন, দুটি উপায় আছে। একটি ছোট, অন্যটি বড়। ছোট উপায়টি হলো, সকল পাপ কাজ ছেড়ে দিতে হবে। আর বড় উপায়টি হলো, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছু কেই ছেড়ে দিতে হবে। হৃদয়কে করতে হবে শূণ্য। দুটির মধ্যে অবশ্য বড় উপায়টিই উত্তম।
প্রবৃত্তিকে বশ করার এক অনন্ত যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন সারাজীবন। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কখনোই প্রবৃত্তি বা ইচ্ছার সঙ্গে আপোষ করতেন না। অদম্য আধ্যাত্মশক্তিতে বলীয়ান হযরত জুননুন মিশরী আত্মসাধনায় নিমগ্ন থেকেছেন অসীম সাহস ও অনুরাগকে সঙ্গী করে।
মিশরবাসীরা জুননুন মিশরীকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। বাগদাদের অধীনস্ত মিশরের খলিফা ছিলেন মুতাওয়াক্কিল বিল্লাহ। খলিফা মিশরবাসীর অভিযোগে জুননুন মিশরীকে আটক করে হাতে পায়ে লোহার বেড়ি পড়িয়ে বাগদাদে খলিফার দরবারে নেয়া হয়। চল্লিশ দিনের কারাবাস হয় মহান ওলীর। চল্লিশ দিন পর তাকে রাজদরবারে আনা হয়। তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্ব, চেহারায় ঐশী নূরের ফোঁয়াড়া ও অসীম জ্ঞান প্রত্যক্ষ করে বাদশাহ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দেন।
এক লোক বৃদ্ধাবস্থায় খুব কষ্ট করে কাবা তাওয়াফ করছিল। তা দেখে হযরত জুননুন মিশরী তাকে বললেন, তুমি কি আল্লাহর বন্ধু? সে জবাব দিলো, হ্যাঁ। পুনরায় প্রশ্ন করলেন, তিনি তোমার কাছে না দূরে? বৃদ্ধ জবাব দিলো, কাছে। তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, তিনি তোমার পক্ষে না বিপক্ষে? বৃদ্ধ জবাব দিলো, পক্ষে। এবার জুননুন মিশরী বললেন, তাহলে তোমার এ দুরবস্থা কেনো? বৃদ্ধ জবাব দিলো, বিরুদ্ধাচরণের কষ্ট যত বেশিই হোক, নৈকট্য অর্জনের শান্তির কাছে তা কিছুই নয়!
একবার এক মহিলাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, প্রেমের সীমা কোনখানে? মহিলা বললো, প্রেমের কোনো সীমা নেই। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, কেনো নেই? মহিলা বললো, যেহেতু প্রেমাস্পদ অসীম, তাই প্রেমের কোনো সীমা নেই।
জীবনের অন্তিম সময়ে হযরত জুননুন মিশরী কে প্রশ্ন করা হলো, আপনার জীবনের অন্তিম ইচ্ছা কি? তিনি জবাব দিলেন, ক্ষণিকের জন্য হলেও আমার প্রভুকে জেনে নেওয়া। অতঃপর তিনি একটি সংগীত গেয়ে উঠলেন –
প্রভু গো, তোমার ভয় আমাকে করেছে রোগী
তোমাকে দেখার ইচ্ছা আমাকে রেখেছে জীবিত।
তোমার প্রেম আমাকে করেছে দূর্বল
তোমার করুণা ও জ্ঞান আমাকে রেখেছে জীবিত।
কিছুদির পরই (মিশরের জিজাহ নামক স্থানে ৮৫৯ খ্রি.) পরম প্রেমাস্পদের সাথে দীদারে রওয়ানা হন হযরত জুননুন মিশরী। তাঁর ওফাতের রাতে সত্তরজন আউলিয়া স্বপ্নে দেখেন রাসুলুল্লাহ (সা) বলছেন, আল্লাহর বন্ধু জুননুন মিশরী। মহাযাত্রার পথে তাকে স্বাগত জানাতে এসেছি। তাঁর পবিত্র দেহ মোবারক রঁওজার দিকে নিয়ে যাবার সময় দেখা যায় অসংখ্য পাখি তাঁর দেহবহনকারী খাটের ওপর পাখা বিস্তার করে ছায়া দিয়ে আছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহান ওলীর উসিলায় আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
24/10/2024