লেখক – নূর আলম খাঁন
ইসলাম ধর্ম সাধারনত পাঁচটি স্তম্ভে দাড় করানো হইয়াছে- কলেমা, রোজা, নামাজ, হজ্জ, যাকাত। ইহার মধ্যে নামায অন্যতম। সাধারনত নামায বলতে আমরা যা বুঝি ফজর, জোহর, আছর, মাগরিব, ঈশা যাহা ওয়াক্তিয়া বলিয়া গন্য। অবশ্য আরও নামায রহিয়াছে, তবে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ বলিয়া জানি।
পবিত্র কোরআনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় ক্বাদ আফলাহা মান তাজাক্কা অজাকারাস্সা রাব্বহী ফাসাল্লা (৮৭:১৪-১৫)। অর্থঃ নিশ্চয় সে ব্যাক্তি কল্যাণপ্রাপ্ত হইয়াছে যে নিজেকে পবিত্র করিয়াছে; এবং তাহারা স্বরন ও সংযোগে চলিয়া আসিতেছে। অতএব, সে করিল সালাত।
উপরোক্ত ওয়াক্তিয়া নামায ও কোরআনের ভাষায় সালাতের কি সমন্বয় আছে তা জ্ঞানীদের বিবেচনার বিষয়। তরিকত পন্থীদের মধ্যে অন্যতম উজ্জল নক্ষত্র হযরত সদর উদ্দীন চিশতী ‘কেবলা ও সালাত’ গ্রন্থের ৪৪ পৃষ্ঠায় লিখলেন- বাস্তব অবস্থান্তরের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন সংঘটিত হওয়ার কারনে ভাব ভক্তির সমন্বয় রক্ষার চেষ্টা বিহীন আনুষ্ঠানিক নামাজ, নামাজ বলিয়া কথিত বটে কিন্তু আসলে উহা আল্লাহর ইবাদত নয়।
মোহাম্মদী সালাতের গুরুত্বকে কমাইবার জন্য ইহাকে ‘নামাজ’ বানাইয়াছে এবং অনুষ্ঠানের মধ্যে সিমাবদ্ধ করিয়াছে। শুধু তাই নয়, কোরআনে উল্লেখিত সালাত ‘দাড় করার’ কথা এড়াইয়া নামাজ পড়ার কথা বলা হইতেছে। উনি ঐ গ্রন্থের ৫৫ পৃষ্ঠায় আরও বলেন, আনুষ্ঠানিক নামাজ একটি মহড়া বিশেষ। নামাজের মহড়া কখনো বেহেস্তে পৌছাইয়া দিতে পারেনা।
উপরোক্ত কথা হইতে আমরা বুঝবো যে, ওয়াক্তিয়া সালাত মহড়া মাত্র। প্রকৃত পক্ষে কোরানিক ভাষার সালাতই মূল সালাত। যাহারা মুহাম্মদ ধর্মের ধারক ও বাহকদের বিশ্বাস করে না, মানে না, তথা তরিকত পন্থিদের লেখা কেতবাদি পাঠ করে না তাহারা প্রকৃত সত্য হইতে বঞ্চিত। সত্যকে উপলব্ধি করিতে হইলে সত্যবাদীদের নিকট গমন করা অপরিহার্য। অন্যথায় তাহারা সত্যের সন্ধান কোন দিনই পাইবে না। লাইব্রেরী থেকে ‘নামাজ শিক্ষা’ কিনিয়া কোরানিক ভাষায় সালাত সম্পর্কে কিছুই বুঝিতে পারিবে না। অবশ্যই তাহাকে একজন জ্ঞানী লোকের নিকট হইতে সালাতের জ্ঞান লাভ করিতে হইবে।
দায়েমী সালাতে স্থিত যেইজন
মুর্শিদ রুপে খোদাকে করে সে স্বরন
সময় নির্ণয় করে হয় না প্রেমিকের সালাত
হামেসা সালাতে থাকে হয়ে এক জাত।
আমার জানামতে, কোরানের একটি আয়াতও নাযিল হয়নি অঙ্গভঙ্গির সালাত সম্পর্কে। নামাজে ইমাম সাহেবর নিয়তে আমরা যদি নামাজ আদায় করতে চাই তবে ইমামের নিয়ত পরিশুদ্ধ না হইলে আমার উপায় কি?
দিবারাত্রী ওয়াক্তিয়া সালাতের কথা কোরানে পাওয়া যায় না। যাহা পাওয়া যায় উহা দায়েমী সালাত যাহা স্থায়ী। সদর উদ্দিন চিশতী সাহেব রুকু ও সিজদা সম্পর্কে বলেন, কিয়ামের অবস্থায় সৃষ্টি রহস্যের কিয়দংশ নিবিষ্ট চিত্তে অধ্যয়ন করিতে বিনয়ে অবনত হইয়া পড়াকে রুকু বলে। রুকুর প্রেরনার অতিশয় উদ্বুদ্ধ হইয়া সৃষ্টিকর্তাকে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করা কে সেজদা বলে।
আনুষ্ঠানিক সালাতে মুখে যাই বলি কার্যক্ষেত্রে কি উক্ত রুকু সিজদার মধ্যে আছি?
সালাতের অর্থ যদি হয়, রবের স্বরন ও সংযোগ প্রচেষ্টা তবে নির্ধারিত সময় ব্যাতিত কি উহা সম্ভব না? দেখি কোরান কি বলে, (মুসুল্লি তাহারা) যাহারা তাহাদের সালাতের উপরে সর্বক্ষন অধিষ্ঠিত থাকে। (৭০: ২৩)
অতএব, বুঝা গেল কোরানিক ভাষায় সালাত আনুষ্ঠানিক অপেক্ষা উত্তম। সালাত ও যাকাত একসাথে জড়িত। কোরানে বলা হইয়াছে তোমরা সালাত কায়েম করো ও যাকাত দাও এবং তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু করো। (২: ৪৩)। দেহের যাকাত না বুঝে যারা সম্পদকে যাকাত বুঝে তারা সালাত ও যাকাত সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। নামায কায়েম কর যাকাত দাও আর আল্লাহকে দাও কর্জে হাসানা(উত্তম ঋণ)৭৩:২০। কোরান মতে সালাত মানুষকে যাবতীয় পাপকার্য হইতে দূরে রাখে। তাহলে সালাতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলতে পারি-‘ শুদ্ধচিত্তে যাবতীয় সৎকর্মই সালাত’। মহাত্মা সুফিয়ান সাওরী (রা) বলেছেন, নামাজের মধ্যে যার মনে মিনতি, ভীতি ও দীনতা উপস্থিত না হয় তার নামায সিদ্ধ নহে। হযরত হাসান বসরী (রা) বলেছেন, যে নামাজে মন আল্লাহর সঙ্গে যোগ না হয় সে নামাজ শাস্তির নিকটতর ও পূণ্যের দূরতর। কোরানে বলা হয়েছে‘ ক্বদ আফলাহা মান যাক্কাহা। অর্থাৎ যার দীল পরিশুদ্ধ হইয়া গিয়াছে সেই সফলকাম। দীল পরিশুদ্ধ হলেই সালাত কায়েম সম্ভব। ওয়াক্তিয়া সালাত আর কোরানিক ভাষার সালাত এক নয়। অবশ্য অধিকাংশ মুসলমানেরা কোরানের সালাত না বুঝে ওয়াক্তিয়া সালাতকে আল্লাহ নির্দেশিত সালাত বলে জানে ও মানে।
আকিমুচ্ছালাতা লা জিকরী- অর্থ আমার জিকিরের জন্য নামায কায়েম করো।(উনত্রিশ পারা, সুরা মায়ারেজ)। ইল্লাল মুছাল্লিনাল্লাজিনা আলা ছালাতিহুম দায়েমুন (৭০:২২-২৩)। অর্থ কিন্তু সেই নামাজীগন (ঐরুপ নহে যাহারা নামাজের ওপর সর্বদা থাকে)।
ওয়াজকুর রাব্বুকা ইজা নাছিতা (১৮:২৪)। অর্থ- এবং যখন তুমি ভুলিয়া যাইবে তখন আপন পালনকারিকে স্বরন করো।
কোরানে আছে তাদের মুখমন্ডলে সেজদার চিহ্ন থাকবে(৪৮:২৯)। একদল অবুঝেরা নামাজে সিজদার সময় জায়নামাজ ও কপালে ঘর্ষন করতঃ কপালে দাগ ফেলে। আয়াতের অর্থ সরাসরি ললাট থাকলেও ধরে নেয়া যেত। ইহারা আয়াতের অপব্যাখা কারী নির্বোধ।
রাসুল (সা) বলেন হুজুরী কালব ব্যাতিত নামাজ সিদ্ধ হয় না। শুধু শারীরিক কসরতের মধ্যে ডুবে থাকলে খোদা প্রাপ্তি হয়না। হয় শুধূ সময়ের অপচয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় সালাতের নিগুঢ়ত্ব আছে। তাই বর্তমান জামানার তরিকত পন্থিদের মধ্যে উজ্জল নক্ষত্র তরিক পন্থিদের মধ্যে আমার প্রিয় লেখক ধর্ম বিজ্ঞানী হযরত কাজী মুহাম্মদ বেনজীর হক আল চিশতী নিজামী সাহেব ওনার বিখ্যাত গ্রন্থ বেহুঁশের চৈতন্য দান এর ১০ পৃষ্ঠায় লেখলেন, এখন মুসলমানরা ভেড়ার মতো মসজিদে যায় আর আসে। মানুষ নেশাগ্রস্থ মাতালের মতো চলছে। যেন ক্লান্ত পথিক। এ কথার অর্থ যারা বোঝেনি তারা ওনার প্রতি ক্ষিপ্ত হবে নিশ্চয়। আর যারা বুঝেছে তারা ওনাকে উচুমাপের মানুষ হিসেবে গন্য করবেন। আজ যদি বেনজীর হক সাহেবের মতো ২০ জন প্রতিবাদী শক্তিশালী লেখক এবং আয়নাল মিয়া, রশীদ সরকারের মতো ৫০ জন ইসলাম প্রচারক থাকতো তবে বাংলাদেশে মুহাম্মদী ইসলাম অনেকটা প্রাণ ফিরে পেতো।
যাইহোক, জিন্দাশাহ বাবা এর নিয়ামতে খোদা গ্রন্থে লিখলেন নামাজ জাহেদা ছেজদা ও ছজুদাস্ত, নামাজে আশেকা তরকে অজুদাস্ত। মানি- মাশাইখগন বলেছেন, কে বলে আশেকগন বেনামাজী? আশেকগনের অজুদই পূর্ণ নামাজ। তিনি আরও বলেন, নামাজের মূল মানি ধ্যানযোগে মনকে সরল করে বিলয় করা।
ব্রহ্মচারী রেবতী মোহন দাস ‘দয়ালের উপদেশ’ গ্রন্থে বলেন, যা দ্বারা মন পবিত্র হয়ে দয়ালকে স্বরনে আসে তাই নামাজ।
তাফসীরে কবির ৩৩৩ পৃষ্ঠায় দেখলাম গোলাম এর পিছনে নামাজ যায়েজ না। অর্থাৎ গোলাম ইমাম হতে পারবে না। গোলাম অর্থ যদি বেতন ভোগী হয় তাহলে আমাদের দেশের অবস্থা এখন কি দাড়ায়?
ইমাম আবু হানিফা (র) একদিন সালাতের সময় তার উপর ছাদ থেকে একটি সাপ লাফিয়ে পড়ে কিন্তু তিনি তা টের পাননি। মহানবী (সা) যখন সালাত আদায় করতেন তখন তার বক্ষদেশে ফুটন্ত ডেকচির মতো শব্দ শোনা যেত।
উপসংহারে বলতে চাই, বর্তমানে আমরা সাধারন মানুষ যে নামাজ পড়ি সেই নামাজ আর আত্মশুদ্ধির নামাজের মধ্যে যে পার্থক্য তা জ্ঞানীদের বোধগম্য বিষয়।