মুহাম্মদ আরশেদ আলী
গাধাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু জোর করে পানি পান করানো যায় না, যদি গাধা নিজে পানি পান না করে। কেউ মানুষকে জ্ঞানের পথে টেনিহিঁচড়ে নিতে পারে না, যদি তার স্বতঃস্ফূর্ততা না থাকে। লাওজু ছিলেন পরম জ্ঞানী। কেমন করে তা বুঝি? কী তার প্রমাণ? প্রমাণ তাও-তে-চং। তাও-তে-চিং একবার পড়লে আরেকবার পড়তে মন চায়। এটি লিখিত হয়েছে জ্ঞানের ভাষায়। জ্ঞানীরা বুঝে জ্ঞানীর ভাষা। জ্ঞানী একই শব্দ ব্যবহার করেন কিন্তু শব্দকে তিনি এমন একটা রহস্যময় রূপ দেন যা জ্ঞানের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। কিন্তু নির্বোধরা তা ধরতে পারে না।
অহং নিস্তেজ না হলে জ্ঞানের কিরণকে স্বাগত জানানো যায় না। জীবনের গোধূলি বেলার ছবিগুলো সুন্দর সম্ভবত একারণেই। জ্ঞানের সাধক প্রার্থনা করে নিজের কাছে। কর্ম তার প্রার্থনা। সে নিজের কর্তব্য পালন করে। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে না। জ্ঞানবান সকলকে গ্রহণ করেন অকপটে। তার গভীরতা সমুদ্রের মতো, স্থিরতা পাহাড়ের মতো, গতি নদীর মতো, স্বচ্ছতা ঝর্ণার পানির মতো। কোনো বাহ্যিক পরিস্থিতি তাঁকে উত্তেজিত করে না। তিনি নিজে পূর্ণ তাই জগতে পূর্ণতা দেখেন। তিনি সংঘর্ষের মোকাবিলা করেন প্রেম দ্বারা। তিনি নিরপেক্ষ। তিনি ধর্ম করেন – ধর্মব্যবসা করেন না। তার কোনো পার্থিব আকাঙ্খা নেই, আসক্তি নেই, গর্ব নেই। অর্থ -বিত্ত, খ্যাতি, নারী প্রতিষ্ঠা কোনোকিছু দ্বারাই তাঁকে প্রলুব্ধ করা যায় না।
তিনি কারো কাছ থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি, পূজা আশা করেন না। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো, সকলকে তিনি সমদৃষ্টিতে দেখেন। তিনি স্বাধীন। তিনি অতীতের জন্য দুঃখ করেন না। ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখেন না। তিনি জীবনযাপন করেন বর্তমানে। জ্ঞান, প্রেম ও সত্য অর্জিত হয় অনুশীলন দ্বারা – সম্যক সময়ে সম্যক কথা ও সম্যক কর্ম দ্বারা। অন্যের জ্ঞান লিপিবদ্ধ হলে তথ্য হয়ে যায়। নিজের তথ্য পাঠ করলে তা জ্ঞান হয়ে যায়।
আত্মশাস্ত্র ছাড়া জ্ঞান অর্জনের বিকল্প উৎস নেই। জ্ঞানী কষ্টের জন্য প্রস্তুত। সে জানে কষ্ট ও ক্ষতি ছাড়া জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করা যায় না। তার জীবনেও সুখ-দুঃখ আসে, বিরহ-আনন্দ আসে, ঝড় আসে – সেও উদ্বেল হয় কিন্তু বৈঠা ছাড়ে না। লক্ষের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন চিন্তা সে করে না ; অপ্রয়োজনীয় কথা সে বলে না, অপ্রয়োজনীয় কাজও করে না। মূঢ়তার কাঁটা, লোভের বোঝা ফেলে সে অগ্রসর হয় সম্মুখ পানে। পূর্ণ উদ্যমে ধৈর্য ও বিনয়ের সঙ্গে যে জ্ঞানের পথে চলে জ্ঞানের মিষ্টি শহরে সে প্রবেশ করবেই।
লেখক – মুহাম্মদ আরশেদ আলী
সুফি ধারার লেখক ও সম্পাদক।