লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
উত্থান পতনে গড়া এই জীবন। যে জীবন এর নিত্যসঙ্গী দৈন্য-হতাশা, হাহাকার আর ব্যার্থতার পূঞ্জীভূত অভিমান। ধরার কন্টকময় ধুলা-ধুসরিত চরম বাস্তবতার মুখাপেক্ষী এ জগতে আলোকিত তারাই, যারা মাত্র কয়েকটি জাগতিক বর্বর চটেপাঘাত অ-ম্লান বদনে মেনে নিতে পেরেছেন। প্রান-প্রাসাদে বিপুল, আত্ম-অহমিকায় অধিষ্ঠিত, আত্ম-গৌরবের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে ব্যাপিত সুখ-সম্ভার ত্যাগ করে যে অহঙ্কারের অলি-গলি সিদ্ধ পায়ে মাড়িয়ে, ঈশ্বরের দেয়া শুধুমাত্র এতটুকু মিছে অনুভূতিকে চিরসঙ্গী করে, অদম্য পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারে মরুভূমির পথে অনিশ্চিত গন্তব্যে- আমার কাছে সেই মঙ্গলময়ের প্রকৃত দূত। তাঁর বাহু-বন্ধনে অনিশ্চিত অমৃতের বিশ্বাসযোগ্য রুপকাঠি, তার আছে অনন্ত উন্মাদনা । তাকে আমি ডাকব যাযাবর বলে, পরম সম্মানে মাথা নোয়াব তাঁর পাদপদ্মে।
অমৃত-নন্দিতের পেছনে যেমন তাড়িত অন্দর-অলিন্দের মোহময় হাতছানি, তার চাইতেও বেশি মোহাবিষ্ট আবেগময় লোভনীয় ডাক- যে মৃত্যুগন্ধহীন মানব, যেই মানব দু-দিনের ভাড়াটিয়ার মতো পচনশীল ননস্থায়ী এই দেউড়িতে অবস্থান করে চির সত্য কে ত্যাগ করে মিথ্যার আবেশে কভূ আড়ষ্ট হতে পারে না, যে মানব শ্বাশত-সুন্দর কে পেছনে ফেলে কুহেলিকায় অনিত্য-সংশ্রবে মুখিয়ে জীবন কাটাতে চায় না, তাকে তো পচনের তাড়না উপেক্ষা করতেই হবে। কারন- তাঁর হৃদ-আসনে অধিষ্ঠিত আছে অমরত্বের বীজ। যে বীজ প্রস্ফুটিত হবে তাঁর সুদীপ্ত-চাউনী, অস্পৃশ্য-অদৃশ্য অন্তরীক্ষের ধাবমান অনুভূতিসমূহের সু-সমাবেশ এবং স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিতে নিজেকে বিলীন করার সক্ষমতায়।
আমৃত্যু তত্ত্ব-স্বাদে মত্ত যে প্রান, গোকুলে সেই তো সত্যের হাওয়ারী। এটা অসম্ভব নয় যে, জগৎ-মোহে আকুন্ঠ আড়ষ্ট মানব শ্বাশত এক খেয়ালী শক্তিকে নিছক কল্পনা মনে করতেই পারে। তবু গতানুগতিকতায় আচ্ছন্ন চির-বহমান এ লীলাক্ষেত্রে কিভাবে এক ব্যাতিক্রম কর্মক্ষম হয়, আধার-সমাচ্ছন্ন হৃদয় কোন আকর্ষনে জ্যোতির্ময় হয়, যুগে-যুগে এ মহাসত্য কি জ্ঞাত? নাকি নিয়মানুসারেই অজ্ঞাত? নাকি ছেলেবেলার ধুলোখেলার মতোই প্রহেলিকা?
অচিন্ত এ স্পর্শমনি- যা গতানুগতিক আবদ্ধতা ও কৃত পাপ-পার্শ্ব উত্তরিতে এক হৃদয় চরাচর বিদীর্নকারী ডাক রূপে যুগে যুগে আবর্তিত হয় মর্ত্তে ধুলোখেলায় মত্ত জাগতিক-মোহাবদ্ধ স্তুপারাজির পাশে, যা অবহেলায় বুক-ফাটা আর্তনাদ এবং শুধুই ব্যর্থতাজনিত হাহাকারে সিমাবদ্ধ থাকা কারো কারো অস্পষ্ট কর্ণগহ্বরে কিঞ্চিৎ প্রবেশ করে। এতটুকুতেই কেউ কেউ হয়ে ওঠে মাতাল। ভুলে যায় সমস্ত বন্ধন। সকলের চোখে হয়ে ওঠে দুরন্ত, প্রথা-বিদ্বেষী। মুহুর্তের একটুখানি আবেগে সে পৌঁছে যায় মানব সাধ্যসীমার বাইরে, মুহুর্তে অতিক্রম করে শত শত মনজিল, অথচ সে নিজেই তার স্থান, কাল, পাত্র সম্পর্কে ওয়াফিকহাল নয়, অন্যে বোঝার সাধ্য রাখে কতটুকু?
সঞ্জীবনী সুধার পিপাসা যার বুকে, সেই তৃষাতুর দৃশ্যত মাজনুন- চাইলেই তার পিপাসা নিবৃত্ত করতে পারে না, তাঁর পিপাসাজনিত পাগলামীতে সমবেদনা প্রকাশ করার যোগ্যতা আছে কার? স্বীয় জীবন উপেক্ষা-পূর্বক ক্লেশাদী-যন্ত্রনা ভোগে আশ্বস্ত যে চিত্ত, যা নিয়তই কাওসারের অমৃত-সুধায় আকৃষ্ট, যেহেতু এই সুধার বিপরীত সবই যাক্কুম-রস, ফলশ্রুতিতে চির-বিতৃষ্ণায় উপেক্ষিত, তাহলে কে এই সুধা-মোহ নিবৃত্ত করবে? দুনিয়ার কোন সম্পদ দ্বারা?
সত্যের অভিসারী, অমৃতের সন্ধানী, চির কুহেলিকায় আচ্ছন্ন এক রুদ্ধদ্বারে দাঁড়িয়ে প্রকাশ করবে স্বীয় বিক্রম, দরওয়াজা ভেঙ্গে বানাবে ঢাল, একা একা নির্ঝরে কাঁদবে নিরবে, হাসবে আবার একাই, উন্মাদ?- হ্যাঁ, সে উন্মাদ। তোমার জন্যই সে উন্মাদ, তার নিজের জন্য নয়-সে শুধু তার নিজের, তার অনন্ত উন্মাদনা একান্ত তাঁর নিজের, অন্য কারো নয়।
রচনাকাল – 15/02/2015
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী