প্রবন্ধ – ত্যাগের অনুশীলনে মোহাম্মদী দ্বীন – পর্ব ০১

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

পৃথিবিতে প্রতিটি ধর্মের বা ধর্ম প্রচারকের আগমন একটি কারণে। আর তা হলো বিশ্ব-মানবতার মুক্তি প্রদান।মানুষ তার আপনত্বে নিহিত পাপবীজ বা কুসংস্কারে স্বভাবতই নিয়ত আবদ্ধ হয়। বদ্ধ-দৃষ্টিতে সে সকল কিছু উপলব্ধি করতে থাকে অন্যায়-অসত্য বা অনাচারের আদলে বা রঙে। মানব সত্তায় নিহিত এ সকল অপবিত্রতা বা খান্নাছকে দূর করে প্রতিটি মানুষ যাতে লাভ করতে পারে সচ্চিদানন্দ, অর্জন করতে পারে নিত্যময় পবিত্র জীবন- সেই লক্ষেই মানুষকে চির মুক্তির পথ দেখাতে যুগে-যুগে ধরাধামে আগমন করেছেন অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী, নবী-রাছুল, মুনি-ঋষি সহ সকল মহামানবগণ।

দেশ-ভেদে, জাতি-ভেদে, আচার-আচরন, কৃষ্টি-কালচার  বা জীবনাচার বিভিন্ন রকম হলেও প্রতিটি ধর্ম মুলত একই বীণার সুর। প্রতিটি ধর্মের বাহ্যিক সাজসজ্জা স্বাভাবিক কারণেই বিভিন্ন রকম হলেও বিধান, নিয়ম বা নির্দেশনা একই। আর তা হলো সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, সুন্দর-অসুন্দরের লীলাভূমিতে আসীন হয়ে শয়তান বা খান্নাছ বা স্রষ্টার স্বভাব বিরুদ্ধ ধারণায় আড়ষ্ট রিপুময় মানুষ কি করে মুক্তি লাভ করবে? কি করে মানুষ অনিত্য এ ধ্বংসস্তুপ বা কিয়ামতের করাল ছোবল এড়িয়ে জরা-ব্যাধি-মৃত্যু তথা মানবসত্তার বিপরীত বন্ধত্বের নিয়ামক সমুহের ভয়াল থাবা অতিক্রম করে পৌঁছতে পারে চুড়ান্ত মঞ্জিল বা চির মুক্তি বা চির শান্তির দেশে।

নিছক পোষাক-আশাক বা ঢিলা-কুলুখের ব্যবহার শিখানোর জন্য ধর্মের আগমন ঘটে নাই। ধর্ম শ্বাশত মুক্তি-বিধান। যে মুক্তি হাসিল হবে যুগে-যুগে, দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, প্রেরিত মহামানবের প্রদর্শিত উপায়ে। মোহাম্মদী সত্ত্বায় স্থিত সকল প্রশংসিত পুরুষ জড় স্বভাব ত্যাগ করে ইনছানিয়াতে অধিষ্ঠিত হওয়ার যে শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন, তা অনুসরণেই আসবে কাঙ্খিত শান্তি, প্রতিষ্ঠিত হবে দ্বীনে ফিৎরাত, স্ব-মহিমায় মানব-সত্তায় প্রতিষ্ঠিত হবে সেই মোহন বংশীধারী, মানব সমাজের প্রতিটি সংস্কারে আবর্তিত হবে মহান বিধি দর্পহারি, এই মানবে বিরাজিত মতি-মুক্তা শোভিত ময়ূর সিংহাসনে ত্রিভঙ্গে নৃত্য করবে শঙ্খ-পদ্ম-গদা-চক্র চতুর্ভুজধারী মুকুন্দ মুরারী।

বিশ্ব মানবতার এক ক্রান্তিকালে, যখন মানব সমাজ, মনুষত্ব-কে বিকিয়ে দিয়ে খরিদ করে নিয়েছিল অন্ধত্ব বা পশুত্ব- ঠিক তখনই ধর্মের বিজয় কেতন আবার পতপত করে উড়ে উঠল মরু-সাহারার বুকে। যুগ-বিবর্তনে পশুত্বকে তাড়িয়ে চলা রাখালের অলৌকিক প্রেমভঙ্গিতে। সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে যুগে যুগে আবর্তিত সকল মহামানুষে অবস্থিত এক মানুষ গেয়ে উঠলেন অনাদি কালের হৃদয় উৎসের গভীরতম সংগীত, মৃত্যুর ভাগাড়ে বেজে উঠল মনমোহিনী সুর, বিশ্ববীণায় নব-স্পন্দনে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল ব্রজ-চারিণীর সপ্তসুরের মুর্চ্ছনা, প্রতিষ্ঠিত হলো স্রষ্টার স্বভাব-বিধান বা দ্বীনে হানিফা, আরব মরু-প্রান্তর হতে জগৎব্যাপি প্রকাশিত হলো মিল্লাতে ইব্রাহিম, বিশ্ববিধাতার  অপরূপ লীলায় সকল কুসংস্কার-বন্ধনের অবসান-কল্পে শেষ জামানায় আরব দুলাল মোহাম্মদ (সা), তাঁর অনুসারি তথা তাঁর আদর্শের গৃহে বসবাসকারি বা আহলে বাইয়াত-দের সমন্বয়ে জারি করলেন নুরুন-আলা-নুর, বাস্তবায়িত হতে লাগল পিতা পুত্র ও পবিত্র আত্মার (ট্রিনিটি, ত্রিত্ববাদ) এর সীমাহীন অপরূপ লীলা, বিশ্বময় প্রতিটি কন্ঠে-কন্ঠে ধ্বনিত হতে লাগলো মহান বেদজ্ঞান-  ঈসা, মুসা, দাউদ, ইব্রাহিম, বুদ্ধ, কৃষ্ণ, কবীর, নানক সকলে মিলে এক আসনে অধিষ্ঠিত করলেন চির সত্যকে। প্রতিষ্ঠিত হলো সহজাত মানব-ধর্ম।

বিধিবদ্ধ পথপ্রদর্শনের ক্রমতালিকায় সমাপ্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করলেন সহজাত প্রেমধর্মকে। সকলে মিলে মানব সত্ত্বার সহজাত ধর্ম মানব-ধর্মের জয়গান গাওয়ার জন্য এক দলে, এক কাতারে, এসে এক সুরে সুর মিলিয়ে নিখিল বিশ্ব-বীণায় ফুটিয়ে তুললেন বেলায়েত বা প্রেমধর্মকে। যেখানে অতিত-বর্তমান-ভবিষ্যতের বন্ধন ভুলে স্বয়ং হেদায়েতকারি শক্তি প্রশংসিত মহামানব মুক্তিকামীর ঘরে ঘরে বিলিয়ে দিতে লাগলেন প্রেম। পশুত্বের সংস্কারে আবদ্ধ জাতিকে টেনে তুলতে লাগলেন আপন তরীতে। প্রতিটি মোহাম্মদী নুরী সত্তা বা আলে মোহাম্মদ বা মোহাম্মদের নুরী বংশধর খাতামিয়াতে নবুয়তের পর অবিরাম চলমান হেদায়েতকারি রসুল রূপে উদ্ধার করতে লাগলেন মানব সমাজকে।

দ্বীনে মোহাম্মদী বা স্বতঃসিদ্ধ মানবধর্ম যা প্রচলিত সকল ধর্মের সার এবং অখন্ড রূপ, যেখানে দেওয়া হলো নিশ্চিত ক্ষতিতে আবদ্ধ পতিত মানব-জাতির মুক্তির দিশা। সর্বাঙ্গীন সুন্দর এবং পরিপুর্ণ রূপে সহজসাধ্য করা হলো মুক্তিপথের আবহমান কালের পরিক্রমাকে। দুনিয়ার প্রতিটা মানুষ নফসানিয়াতের সমন্বয়ে আমিত্ব বা দুনিয়ার রিপুময় সংস্পর্শে জন্মগত মনুষ্যত্ব হারিয়ে দাখিল হচ্ছে পশুত্বে। পশুত্ব  বা নফসানিয়াত প্রতিটি মানব সত্ত্বায় অনিবার্য ভাবে প্রোথিত বিধায় প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের অভ্যন্তরস্থিত পশুত্ব বা আমিত্ব কাটিয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না শান্তি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সারা বিশ্বের বৈশ্বিক রাজনীতিতে সভ্যতার শুরু থেকেই তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে সঠিক রাষ্ট্রব্যাবস্থা কায়েম করে শান্তি স্থাপন করার। কিন্তু আফসোছ, বিশ্বময় মহান মহান সকল নীতিনির্ধারক, এতো বড় বড় মহামানব, চিন্তাবিদ, গবেষক আজ পর্যন্ত এমন কোনো ব্যাবস্থাই প্রনয়ণ করতে পারলেন না, যেটা সকলকে শান্তি দিতে পারে! সকলকে শান্তি দিতে না পারলেও অন্তত একটা রাষ্ট্রে তো শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারে? মুক্তচিন্তার অধিকারী মানুষ বার বার রাষ্ট্রব্যাবস্থা  পাল্টিয়েছে, একনায়কতন্ত্র থেকে শুরু করে রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পূজিবাদ, ধনতন্ত্র, গনতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, কোনো তন্ত্রই বাদ দেয়নি কিন্তু মানুষ তার কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছতে পারে নি। সবাই যার যার মতো আপন আপন তন্ত্রকে সঠিক বলে ব্যাঙের মতো কূয়োয় বসে লাফাচ্ছে কিন্তু বিবেকের অধিকারী মানুষ মুক্তমনা উপাধি গ্রহণ করে আজও কুপমন্ডুকই রয়ে গেছে। সারা জীবন কঠোর তপস্যা করে কোনো তন্ত্র উদ্ভাবনকারি ব্যক্তি বা দল মানব জাতিকে তাদের অসাধারন মেধা ও ত্যাগের বিনিময়ে অরাজকতা ছাড়া আর কি’ই বা দিতে পেরেছে? তাদের অবদান আকাশচুম্বি হলেও মানব জাতি শান্তি পায়নি। তার প্রমান আজ পৃথিবির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। মানবজাতি মুখে শান্তিপ্রিয় হলেও বাস্তবে তার উল্টো। তাই হয়তো এই ব্যার্থতা। কি আর করার! মানব সমাজ মুখে যতই শান্তি চা’ক, তার হৃদয় যদি শান্তির জন্য উন্মুক্ত না হয় তবে কে তাকে শান্তি দেবে? মানুষকে বোধ হয় এমন করেই তৈরী করা!

বিধান প্রণেতাদের গর্ধপনা এতদূর যে তারা মুখে শান্তির বোল বললেও জানেনা অশান্তি কোথায়! রাজধানিতে অশান্তি হতে পারে না, রাজপথে কখনো বিদ্রোহ হতে পারেনা, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মায়ানমারে অশান্তি হতে পারে না। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নীতি নির্ধারকদের এতটুকু বোঝা উচিত – স্থান-কাল-বস্তু নিরপেক্ষ। অশান্তি বিদ্রোহ হানাহানির উৎপত্তি একমাত্র পশুত্ব স্বভাব বিশিষ্ট মানব সত্ত্বায়। যেখান থেকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে মানব জাতিকে, দেশকে। প্রতিটি ব্যক্তি সত্ত্বাকে যদি পুতঃপবিত্র রূপে তৈরী করা না যায়, তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। এই বুঝটুকুই যদি আমাদের না থাকে তাহলে কি করে আমরা বিশ্বকে উপহার দিবো শান্তি, নিরাপত্তা? এ জ্ঞান মানুষের হবার কথা না কারণ, মানুষ মুখে শান্তিপ্রিয় হলেও বাস্তবে সে নিজেই অশান্তির উৎস। প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক- এ কামনা থাকলে প্রতিটি মানুষ ব্যাস্ত থাকতো আপন আপন শুদ্ধিকর্মে। সবাইকে উৎসাহিত করত আপন আপন শুদ্ধির জন্য। কিন্তু নফসানিয়াত সম্বলিত মানব সত্ত্বায় এ রকম হবার কথা নয়। কারন শকুন তো আর পোলাও কোর্মা খায় না, ওর খাবার পচা গোশত।

মানব সত্ত্বায় স্থিত পশুত্বকে ত্যাগ করলেই প্রতিটি মানুষ অর্জন করবে তার চুড়ান্ত লক্ষ্য এবং পাশাপাশি অনিবার্য ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সামাজিক শান্তি। প্রতিটি ধর্ম মানুষকে যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে আসছে কি করে  মানুষ লাভ করবে আত্মিক প্রশান্তি। পরিশুদ্ধ করতে পারবে নিজেকে। মানবতার সংরক্ষণকারী সম্প্রদায় মুসলমানদের ধর্মীয় বিধান ইসলামে রূপক প্রতীক বা আলংকারিক এর সাহায্যে মানবজীবনের প্রতিটি পলে-পলে কিভাবে আন্তশুদ্ধি অর্জন করা যায় তারই পথনির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বভাব সিদ্ধ আচরণেই মানবজাতি ঐশি প্রেমের পথ বা স্বর্গীয় বিধান পরিত্যাগ করে মহান মুক্তির দিশারি মোহাম্মদ (সা) এর দেখানো সিরাতুল মুস্তাকিম কে অস্বীকার করে তাগুত নির্দেশিত এমন এক ভারসাম্যহীন গাজাখুরি মতবাদ কে ইসলাম বলে চালাচ্ছে তা শুধু বিধ্বংসীই নয় বরং মানবতার বিরুদ্ধবাদী। একশ্রেনীর ধার্মিক নামধারি অতিবোদ্ধারাই করছে এহেন বিকৃতি সাধন। যারা বরাবরই মানবতার শত্রু এবং তাদের পৈশাচিক কর্মকান্ডের ফলেই সহজাত মানব ধর্ম ইসলাম সমাজে পেয়েছে এক নিন্দনীয় আসন। ধর্মের ছদ্মাবরনে বাস করা লেবেল-লেবাছ ধারি এসব গন্ডমুর্খ দের জন্যই ইসলামের পরিচিতির স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে ভিন্ন দিকে । লজ্জাহীন এ জাতিটির ধর্মের নামে অপকর্ম করার জন্যই আজ মানবতার কান্ডারি মোহাম্মদ (সা) বিবেচ্য হচ্ছেন বর্বর ক্ষমতালোভীরূপে, মানব ধর্ম ইসলাম পরিণত হয়েছে জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ, ত্রাস সৃষ্টিকারি মধ্যযুগীয় বর্বরতারূপে।

প্রতিটি যুগে যুগে প্রেরিত সকল মহামানবগণ মুক্তির শান্তির যে বিধান বাস্তবায়িত করেছেন, অজ্ঞ মানব সমাজ চিরাচরিত নিয়মেই তার বিরোধিতা করেছেন। সকল ধর্ম প্রচারকগণই মুখোমুখি হয়েছেন সমসাময়িক তীব্র বিরোধিতার। কোনোযুগেই সত্যের পূজারি কে মানবসমাজ সহজভাবে মেনে নেয়নি। অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছে তাদের ওপর। যুগে যুগে হত্যা করা হয়েছে মহামানবদের। কারণ, মানব সমাজ জন্মগত ভাবেই জিবাত্মা তথা রিপুসমুহ বা পশুত্বের গুণ খাছিয়তে আবৃত। যখনই কোনো নবী রাছুল বা কোনো মহামানব হায়ানাতের দেওয়াল ভেঙ্গে মানুষকে ডাক দিয়েছেন ইনছিনিয়াতের দিকে, তখনই তা অজ্ঞতায় আবদ্ধ মানব জাতির কাছে নেহাত হাস্যকর ব্যাপার বা পাগলামী বলে বিবেচিত হয়েছে। চলেছে তুমুল বিরোধিতা। কারণ রিপুময় মানুষের কাছে জিতেন্দ্রিয়ের ডাক শুধু খাপছাড়াই নয়, বিবেচিত হয়েছে তাদের মুর্খতার রাজ্যে হুমকি-স্বরুপ। ফলে দলবদ্ধ ভাবে বিরোধিতার তীব্র স্রোত প্রবাহিত হয়েছে সত্যের ওপর।

পড়ুন – ত্যাগের অনুশীলনে মোহাম্মদী দ্বীন – পর্ব ০২

রচনাকাল – 18/02/2015
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর