সংকলন – লাবিব মাহফুজ চিশতী
বাঙালীর চেতনায় সর্বাধিক আলোকিত এক মহাপুরুষ হলেন মহাত্মা ফকির লালন শাহ। বাঙলী মানসে রেসালাতের সুমহান দেশনা প্রজ্জলনে তাঁর রয়েছে সমধিক অবদান। লালন শাহ ফকির (১৭ অক্টোবর ১৭৭২ – ১৭ অক্টোবর ১৮৯০) এর অগনিত ওহী কালাম হতে সামান্য কিছু বাণী এখানে সংকলিত হলো। উল্লেখ্য, পোস্টটিতে লালন শাহ ফকির এর শুধুমাত্র আত্মতত্ত্ব ও গুরুতত্ত্বের বাণীগুলোই সংকলিত হলো –
লালন গানে আত্মতত্ত্ব –
১. অজুদের ভেদ বলি কিছু শোনরে মন, জেনে শুনে আপনার আপনি হও চেতন।
২. অধরা কে ধরতে পারি কইগো তারে আর, আত্মারূপে চলে ফিরে মানুষ মারা কলের পর।
৩. অবোধ মন তোর হলো না দিশে,এবার মানুষের করণ হয় কিসে।
৪. খুদিতে বান্দার দেহে, খোদা সে রয় লুকিয়ে।
৫. অযোনি সহজরূপ সংস্কার, স্বরূপে নয়ন করো নিহার।
৬. দুষ্ট দমন করো, স্বদেশে গমন করো ত্বরায়।
৭. আছে আদি মক্কা এ মানব দেহে, দেখনারে মন ধেয়ে।
৮. আছে ভাবের তালা সেই ঘরে, যে ঘরে সাই বাস করে।
৯. বর্তমানে চেয়ে দেখো, স্বরূপে রূপ নিশানা।
১০. আছে যার মনের মানুষ মনে, সেকি কভূ যপে রে মালা।
১১. লালন বলে যাবে জানা আপনারে চিনিলে।
১২. আঠারো মুকামের মাঝে রূপের বাতি জ্বলছে সদায়।
১৩. আত্মতত্ব সাধন করে, জ্ঞানী জনা বসে রয়।
১৪. আপন কাজ করে খাঁটি, বয়গা গিয়ে নিরালায়, আপন মনের গুণে সকলি হয়।
১৫. আপন খবর না যদি হয়, যার অন্ত নাই তাঁর খবর কে পায়।
১৬. অন্য গোলমাল ছাড়ো, আত্মতত্ব ঢ়ুড়ো।
১৭. আপন ঘরের খবর নেনা।
১৮. আপন মনে যার গরল মাখা থাকে, যেখানে যায় সুধার আশায় তথায় গরল দেখে।
১৯. আপন মনের গুণে সকলি হয়।
২০. আপন মনের বাঘে যদি খায়, কোনখানে পালালে বাঁচা যায়।
২১. আপন সুরতে আদম গঠলেন দয়াময়।
২২. আল্লাহ আদম না হইলে, পাপ হইতো সিজদা দিলে।
২৩. আপনার আপন খবর নাই, গগনের চাঁদ ধরবো বলে মনে করি তাই।
২৪. আপনার আপনি চিনেছে যেজন, দেখতে পাবে সে স্বরূপের কিরণ।
২৫. আপনার আপনি কে দেখেছে নয়নে, সবে বলে আমি আমি, আমি কি তা কয়জন জানে।
২৬. আপনাকে যে চিনেছে, ভবের নিগুঢ় তত্ব সে পেয়েছে।
২৭. আপনার আপনি ফানা হলে সে ভেদ জানা যাবে।
২৮. লালন কয় মনরে কানা, স্বরূপে রুপ দেখ সংক্ষেপে।
২৯. আপনার আপনি চিনি নে, দিন দুনিয়ার পর যার নাম অধর, তারে চিনব কেমনে।
৩০. আপনারে চিনতাম যদি, মিলত অটল চরণনিধি।
৩১. আত্মতত্বে পায় সাধ্যধন, সহজও সাধকজনে।
৩২. দিব্যজ্ঞানি যেজন হলো, নিজতত্ত্বে নিরঞ্জন পেলো।
৩৩. আপনার আপনি যদি চিনা যায়, তবে তো জানতে পারি সাঁই দয়াময়।
৩৪. আত্মারূপে কর্তা হরি, মনের ঘোরে চিনতে নারি।
৩৫. পর অর্থে পরমঈশ্বর, আত্মারূপে করেন বিহার।
৩৬. লালন বলেরে মন গুরুপদে ডুবে আপন, আত্মার ভেদ জেনে নেনা।
৩৭. আত্মতত্ব না জানলে ভজন হয় না।
৩৮. আপন ঘরের খবর হয়না, বাঞ্ছা করি পরকে চেনা।
৩৯. আপন ঘরে বোঝাই সোনা,পরে করে লেনাদেনা।
৪০. এই মানুষে আছেরে মন, যারে বলে মানুষ রতন।
৪১. আগে মনের মানুষ ধর, সার আপন কর্ম সার।
৪২. আমি কি তাই জানিলে সাধন সিদ্ধি হয়।
৪৩. কার কাছে কইরে আমি কোথা পাই আমি’র বেনা।
৪৪. আর কেনো মন ঘুরো বাইরে, চলোনা মন আপন অন্তরে।
৪৫. দলিলেতে এটা শুনি, কল্লায় কল্লায় আল্লা আছে।
৪৬. আত্মতত্বে ফাজিল যারা, নিগুঢ়লীলা দেখেছে তারা।
৪৭. আল্লাহ রাসুল আছে আমার এ দেহে জ্ঞান হলো না।
৪৮. নিজ আত্মার পরিচয় নাই যার, পড়লে কী যায় মনের অন্ধকার।
৪৯. জাহির নাই বেদ কুরানে আছে অজুদ মুকামে, ঐক্য হয় যার মনে ধ্যানে যার নাম সাঁই কয়।
৫০. ছয় প্রহরে মানব সৃষ্টি সর্ব মতে, জানা যায় আত্মতত্ব হতে।
৫১. ফুটেছে ফুল মানব সরোবর, শূন্য গোফায় ভ্রমরা তার।
৫২. ডুবে থাক রুপসাগরে বসত কর অজুদের ঘরে, লালন বলে বিনয় করে, মনের মানুষ চিনে ধর।
৫৩. এ বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নেরে মন।
৫৪. মানুষে হয় মাধুর্য ভজন, তাই মানুষ রূপ গঠলেন নিরঞ্জন।
৫৫. মম হৃদমন্দিরে থাকি স্বরূপ দাও গো দরশন, এসো হে প্রভু নিরঞ্জন।
৫৬. স্বরূপ রূপে রূপ করছে খেলা,স্বরূপ গুরুর স্বরূপ চেলা।
৫৭. মানুষে মানুষে বর্তমান, যারে বলি মানুষ রতন।
৫৮. একবার আপনারে চিনতে পারলে রে, যাবে অচেনারে চেনা।
৫৯. সে যে আত্মারূপে কর্তা হরি, মনে নিষ্ঠা হলে মিলবে তাঁর ঠিকানা।
৬০. আমি আমি কে বলে মন, যে জানে তার চরণ শরন লও না।
৬১. রত্ন যে পায় আপন ঘরে, সে কি খুঁজে বাইরে বাইরে।
৬২. কতজন ঘুরছে আশায় খুুঁজে না পায় এ জগতে, অর্থ করে বুঝো ভাইরে বর্ত্য আছে অজুুদে।
৬৩. দেহের খবর যেজন করে, আলেক রূপ দেখতে পারে।
৬৪. কাছের মানুষ ডাকছো কেনো সুর করে, তুই যেখানে সেও সেখানে, অযথা খুঁজিস কারে।
৬৫. ঘরের মাঝে ঘর খানা, ঢোড়রে সে আস্তানা, কে বিরাজ করে।
৬৬. আপন ঘরের নাই ঠিকানা, বাঞ্ছা করো পরকে চিনা।
৬৭. দেহ মক্কা ঢুড়লে পরে, পাবি সে পরওয়াররে।
৬৮. কিসে আর বুঝাই তোরে, দিল মক্কার ভেদ না জানিলে তার হজ্জ হয় কি করে।
৬৯. এই মানুষে মক্কা গঠন, তাই মানুষ মানুষকে করে ভজন।
৭০. দেখতে বাসনা যার হয়, দিল দরিয়া ডুবলে দেখা যায়।
৭১. আখিঁর কোনে পাখির বাসা, দেখতে নারি তার তামাশা।
৭২. যারে সাথে লয়ে ফিরি, তারে যদি চিনতে নারি, লালন কয় অধর ধরি কেমন ধ্বজায়।
৭৩. কি সন্ধানে যাই সেখানে মনের মানুষ যেখানে।
৭৪. কুদরতের সীমা কে জানে, আপনি করেন আপন জিকির বসে আল জবানে।
৭৫. খোদকে চিনলে খোদা চিনি, খোদ খোদা বলেছে আপনি, মান আরাফা নাফসাহু বানী, বুঝ কি তার মানে।
৭৬. কে কথা কয়রে দেখা দেয়না, নড়েচড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনম ভর মিলে না।
৭৭. খুঁজি তারে আসমান জমিন, আমারে চিনিনা আমি, এ বিষম ভ্রমে ভ্রমি, আমি কোনজন – সে কোনজনা।
৭৮. হাতের কাছে হয়না খবর, কি দেখতে যাও দিল্লি নগর।
৭৯. মরণের আগে যে মরে, শমনে ছোবে না তারে, শুনেছি সাধুর ও দ্বারে।
৮০. কেনো খুঁজো মনের মানুষ বনে সদায়, দেহের মাঝে আত্মারূপে খেলছে সাঁই দীন-দয়াময়।
৮১. পরমাত্মা সর্বত্র ফিরে, জীবাত্মা কে হরণ করে।
৮২. লালন ফকির বুদ্ধি হারায় আত্মতত্ব না সেরে।
৮৩. আদমের এ দেহের মাঝে হায়াত রূপে কে বিরাজে, লালন বলে তাই না বুঝে আযাযিলের হলো দুর্গতি।
৮৪. ঠাউরে ভজন সাধন করো, নিকটে ধন পেতে পারো, লালন কয় নিজ মুক্বাম ঢুড়ো, বহু দুরে নাই।
৮৫. ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়।
৮৬. নিজে সত্য না হলে, গুরু সত্য হয় কোন কালে, নিজে যেরূপ দেখনা সেরূপ, দিন দয়াময়।
৮৭. আত্মারূপে সে অধর, সঙ্গী অংশকলা তার।
৮৮. আপনারে না চিনে, ঘুৃরবি কত বনে বনে।
৮৯. খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
৯০. খাঁকি আদমের ভেদ, সে ভেদ পশু কি বুঝে, আদম ক্বলবে খোদা খোদ বিরাজে।
৯১. আদম শরীর আমার সে যে, বলেছে অধর সাই নিজে, নইলে কি আদমকে সিজদা ফেরেস্তায় সাজে।
৯২. আযাযিল শয়তান হলো আদম না ভজে।
৯৩. খুঁজে দেখ তোর আপন ঘরে, আপন ঘরে রেখে সে ধন, কেন খুঁজো বাইরে বাইরে।
৯৪. থাকতে রতন আপন ঘরে, একি বেহাল আজ আমারে।
৯৫. সিরাজ সাঁইজির বচন, মিথ্যা নয়রে লালন, ডুব দিয়ে দেখ স্বরূপদ্বারে।
৯৬. খেলছে মানুষ নীড়ে ক্ষীরে, আপন আপন ঘর খুজ মন আমার, কেনো হাতড়ে বেড়াও কুলের ঘোরে।
৯৭. খোদা রয় আদমে মিশে, যার জন্য মন হলি হত সে খোদা আদমে আছে।
লালন গানে গুরুতত্ত্ব –
১. গুরু তুমি পতিত পাবন পরম ও ঈশ্বর।
২. আল্লাহ রাছুল দুটি অবতার, গাছ বীজ যেরূপ দেখি যে প্রকার।
৩. জানতে পায় নিগুঢ় কারখানা, হলো রাসূল রূপে প্রকাশ রাব্বানা।
৪. লালন বলে গুরুর চরণতলে পাবিরে নিরঞ্জন।
৫. গুরুর চরণ পরম রতন কররে সাধন।
৬. ধরো ধরো এবার জিবন্ত সাঁই,সাঁই বিনে আর কিছু নাই।
৭. একবার এসে এ নদীয়ায় মানুষরূপে হয়ে উদয়, প্রেম বিলায়ে যথায় তথায় গেলেন প্রভু নিজপুরে।
৮. আলিফ লাম মীম আহাদ নুরী, তিন হরফের মর্ম ভারি।
৯. যিনি মুর্শিদ রাছুলুল্লাহ, সাবুত কুরান কালামুল্লাহ, আশিক্বে বলিলে আল্লাহ তাও হয় সে।
১০. এমন দিন কি হয় আর, খোদা করে রাছুল রূপে অবতার।
১১. আহমদ নামে কেন ভাই, মানব লীলা করিলেন সাঁই।
১২. খোদ সুরতে পয়দা আদম, এও জানা যায় অতি মরম।
১৩. আল্লাহ রাসুল দুটি অবতার, এক নুরেতে মিশাল করা।
১৪. গুরু নামে রুচি হলে ভবপাড়ে যাওয়া যায়।
১৫. গুরুর চরণ ধরো এ বেলা, যদি বাঁচতে চাও তরঙ্গে।
১৬. গুরু বস্তু অমুল্য ধন, ঘুমের ঘোরে চিনলি না মন, ঐ ঘুমেতে হয় মরণ, যেতে হয় শমনের অধীন।
১৭. কিসে ত্রান পাবি সংকটে, বৈতরনীর ঘাটে, গুরুর চরণ করবে তারণ, অকপটে।
১৮. কীর্তিকর্মার খেলা কে বুঝিতে পারে, যে নিরঞ্জন সে রাছুল নামটি ধরে।
১৯. খোদ খোদার প্রেমিক যেজনা, মুর্শিদ রূপ হৃদয়ে রেখে কর সাধন ভজনা।
২০. আকার অনন্ত রূপ সাকার এক রূপ, রয় সর্ব ঘটেতে, বান্দার রূপ খোদার রূপ হয়, লালন কয় পাক পাঞ্জাতন যাতে।
২১. নাম দিয়ে সাঁই কোথায় লুকালে, মুর্শিদ ভজলে নিকটে মিলে।
২২. দেখবি যদি সাঁই নিরঞ্জন,মুর্শিদ রূপ ভজে কর অন্বেষণ।
সংকলন – লাবিব মাহফুজ চিশতী