লেখক – কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
জানা দরকার, মানুষ যখন সিবগাতাল্লায় সিক্ত হয় তখনই হয় আরশুল্লাহ। যখন আমানু বা মুরিদগণ একা হয়ে আল্লাহকে ডাকে বা ডাকার জন্য সাধনা করে তখন সাথে সাথেই আল্লাহপাক তাঁর ডাকের সাড়া দেন এবং ঐ বান্দার ক্বলবে সেরাতুল মুস্তাকিম কায়েম হয়ে যায়। এই অবস্থায় দুই আকৃতিই এক দৃষ্ট হয় তথা ওয়াজেব এমকান এক হয়ে যায় এবং প্রকাশ পায় অজহুল্লাহ। সেই আমিকে এই আমিতে দৃষ্ট হয় তথা আমিকে ফিরে পেলাম তথা তাতে ঈদ পূর্ণমিলন হলো।
জ্ঞানীগণ চিনে নিলো এইতো আমার আল্লাহ। জ্ঞানীগণ আল্লাহকে চিহ্নিত করে তথা শনাক্ত করে শবে মেরাজ আদায় করে নিলেন আর এটাও বুঝে নিলেন যে, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে এক আল্লাহ ছাড়া আর কিছু নেই। জাত জুলমাত বেমেছাল তথা তনজিয়া এখানে তিনি বিমূর্ত। বিমূর্তের মূর্ত তথা তসবিয়া সিফাতে তিনি দৃশ্যমান, এখানে তাঁর ছুরত আছে, তিনি মূর্তমান হয় আছেন।
দিব্যদৃষ্টি যাদের আছে তারাই সেই রূপ চিনেন এবং দেখেন। কোরানে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুহাম্মদ, আমার বান্দারা জিজ্ঞেস করবে আল্লাহ কোথায়? আপনি বলে দেন, তিনি নিকটেই আছেন।’ তিনি এতো নিকটে যে, তাঁর অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছু দৃশ্যমান নেই। অস্তিত্বের প্রকাশের তীব্রতার আড়ালে তিনি অবস্থান করছেন।
মানবীয় দৃষ্টির বাহিরে তাঁর অবস্থান, অথচ এক সাথেই একাকার হয়েই তিনি অবস্থান করছেন। এজন্যই বলা হচ্ছে, লা তুদরিকুল আবছারু। কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানে জ্ঞানীগণ তাকে চিনেন এবং দেখেন। কারণ তিনি বলেছেন, ফালানাকুচ্ছানা বেইলমিউ, ওয়ামা কুননা গায়িবিন। অর্থাৎ আমি জ্ঞান সহ প্রমাণ করবো যে, আমি অদৃশ্য ছিলাম না। সুরা হাদীদের ৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহর চারটি আকছাম তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো হুয়ায জাহিরু। আ কালামগুলোর ভেদ রহস্য আছে আল্লাহ প্রদত্ত ইলেমের ভিতর, আর আল্লাহ নিজেই হলেন আলীমুন। এদিকে লক্ষ্য করেই কোরানে বলা হচ্ছে, আল্লাহ যাকে জ্ঞান দান করেন সেই জ্ঞান পায়, যাকে জ্ঞান দান করেন না, সে জ্ঞান পায় না। এ জ্ঞান অবশ্যই জাহিরী বিদ্যা বা ইলমুল কালাম তথা ইলমুল লেছানী নয় তথা মানবীয় এলেম নয়। কাজেই যারা বলছে, আমরা জ্ঞান দান করি, এমনটা বলা ঠিক নয়। কারণ, একমাত্র আল্লাহই জ্ঞান দান করেন তথা কোরান শিক্ষা দেন। দেখুন সুরা রহমান। আল্লাহই রহমান হয়ে কোরান শিক্ষা দেন বলে জানিয়েছেন। যেমন, আর রহমান অর্থাৎ তিনিই রহমান। আল্লামাল কোরান অর্থাৎ তিনি শিক্ষা দেন কোরান।
‘কোরান শিক্ষা দেন’ এ কথার মর্মার্থ হলো নিজেকে চেনার জ্ঞান দান করেন তথা রবকে চেনার শিক্ষা দেন। যা কোরান তথা আল্লাহর কালাম ইনছান সৃষ্টি করে তথা ইনছানিয়াত প্রতিষ্ঠিত করে। তাই বলা হচ্ছে, খালাকাল ইনছান। এই ইনছানের ছুরতই হলো আল্লাহর আমানত। আল্লাহর কালাম ছাড়া এই আমানত রক্ষা করা যায় না। আর আমানত রক্ষা না করলে তথা হেফাজত না করলে আসফালাস সাফেলিন হবে এবং তাতে বারবার চামড়া পরিবর্তন হবে তথা ছুরত বদল হয়ে যাবে। যেমন, বলা হচ্ছে, লাওয়াহাতুল্লিল বাশার অর্থাৎ বাশারের পরিবর্তন ঘটবে। এই জন্য বিশ্বাস এবং আদবের মাধ্যমে রহমানের কালাম মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতে হবে এবং সেই মোতাবেক জীবন গড়তে হবে তথা আমানত হেফাজত করতে হবে।
ঈমানদারগণ রহমান আল্লাহর কালাম শ্রবণ করতে পারেন। এই কালাম শ্রবণে ইনছানে পরিণত হচ্ছেন। প্রচলিত মাদ্রাসার ইলেম তাহা নয় এবং এই কালাম আল্লাহর শ্রবণযোগ্য কালাম নয়। আল্লাহর কালাম শ্রবণের মধ্যেই ঐ কালামের ভেদ রহস্য লুকিয়ে রয়েছ। এই কালাম শ্রবণে দিব্যদৃষ্টি খুলে যাবে তাতে আল্লাহকে চেনা যাবে। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেহই জ্ঞান দান করতে পারেন না। আর আল্লাহপাক যাকে খুশি জ্ঞান দান করেন। কাজেই মাদ্রাসায় ধর্মজ্ঞান দান করা হয়, একথা কুফরী। আর আলেম সমাজ যাকে শরীয়তের ইলেম বলে দাবী করছে, তা আসল নয়। ইহা ধর্মজ্ঞানের রূপক প্রতীক তথা মুতাশাবেহাত বা জাহিরী ইলেম- যাকে কালাম শাস্ত্র বলে। ধর্মজ্ঞান হলো আত্মার জ্ঞান যা রূপকের আড়ালে রয়েছে। রূপকের ভেদ উন্মোচন হলে তবে মিলে ধর্মজ্ঞান। জাহিরী ইলেম যেহেতু রূপক, কাজেই রূপকের আবরণ উন্মোচন হলেই দেখা যাবে শরীয়তি ইলেমের বিপরীত হলো ধর্মজ্ঞান, যা রূপকের আড়ালে রয়েছে।
বোখারীর ১২২ নম্বর হাদিস হতে জানা যায়, হযরত আবু হোরায়রা (রা) বলছেন, আমি রাসুল (সা) হতে দুটি ইলেমের পাত্র লাভ করেছি। তার মধ্যে একটি তোমরা সবাই জানো, অপরটি আমি যদি তোমাদেরকে বলি, তবে তোমরা আমার কন্ঠনালী কেটে ফেলবে। এ জন্যই বলা যায় মাদ্রাসায় যা শিক্ষা দেয় হচ্ছে তা তাশাবাহা বা রূপক। কাজেই রূপক ধর্মজ্ঞান নয়, রয়েছে রূপকের আড়ালে। সুতরাং যাকে বলা হচ্ছে শরীয়তি ইলেম তা এক প্রকার পাগলামী বৈ আর কিছু নয়। আলেম-মোল্লারা কোরান বা ধর্মজ্ঞান শিক্ষা দিচ্ছে তাহা বলা মাত্রই ঠিক নয়। কারণ, আল্লাহ ছাড়া কেউ কোরান বা ধর্মজ্ঞান দান করতে পারে না। সুরা রহমান ই তার প্রমাণ। মাদ্রাসায় শিক্ষা দেয়া হয় ভাষাজ্ঞান, যা ইলমুন কালাম বা কালাম শাস্ত্র। এ বিদ্যা দিয়ে আরবী ভাষার কোরান পড়া যায়, তার আক্ষরিক বিদ্যা শিক্ষা করা যায় তথা রূপক-কাঠামো শিক্ষা করা যায় কিন্তু কোরানের জ্ঞান লাভ করা মোটেও সম্ভব হয় না।
মাদ্রাসার বিদ্যা হলো মোতাশাবেহাত, এর আড়ালে যে চরম সত্য জ্ঞান মুহকামাত রয়েছে তাই হলো কোরান জ্ঞান, যা অর্জন করা প্রত্যেকের জন ফরজ। মাদ্রাসার বিদ্যা দ্বারা শত-সহস্র মতভেদ সৃষ্টি হয়। কারণ, কোরানের জ্ঞান রয়েছে রূপক-প্রতীকের আড়ালে, আর তাশাবাহা (রূপক-প্রতীক) হলো দ্ব্যার্থক, যা বহুমুখী, যা ইলমুল কালামের বিপরীত। আল্লাহপাক যে কোরান শিক্ষা দেন তা হলো ‘ফি কিতাবিম মাকনুন’ তথা যা আছে গোপন গ্রন্থের মধ্যে। সেই কিতাব যাতে রয়েছে রবের রব তথা আরবী কোরান। এ আরবী কোরান আসমান হতে নাযিল হচ্ছে। আল্লাহ শিক্ষা দেন আরবী কোরান। শিক্ষা দেন মানে নিজেকে চিনিয়ে দেন।
কারণ, নিজেকে চিনলেই রব আল্লাহকে চেনা যায়। আল্লাহকে চিনে তাঁর পাক জাতে বাস করাই হলো মানুষের সাধনা বা ইবাদত । কারণ, জিন ইনছানের ইবাদত হলো নিজেকে চেনা। কোরানের লি ইয়াবুদুন কথাটি লি ইয়ারেফুন শব্দ হতে এসেছে। লি ইয়ারেফুন কথাটির অর্থ হলো নিজেকে চেনা। নিজেকে চেনা মানেই হলো আল্লাহকে চেনা। কাজেই আর রহমান অর্থাৎ তিনি রহমান। আল্লামান কোরআন মানে তিনি শিক্ষা দেন (চিনিয়ে দেন) কোরান। খালাকাল ইনছান বা ইনছান সৃষ্টি করেন। মানব মনের হায়ানিয়াত রূপান্তর করে ইনছানিয়াতের ভেতর কায়েম করেন আর তখনই ইনছান সৃষ্টি হয়। ইনছানই আল্লাহকে চিনে এবং আল্লাহর পাক জাতে বাস করে তথা নিজেই আল্লাহ হয়ে যায় তথা আনাল হকে স্থিত হন।
হাদিসে এহসানে বলা হচ্ছে, তোমরা এমন ভাবে ইবাদত করো যেনো আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছো। আর যদি আল্লাহকে দেখতে না পাও তবে মনে করো আল্লাহই তোমাদেরকে দেখেন। এই হাদিস হতে জানা যায়, দুই শ্রেণীর উপাসক বর্তমান। এক শ্রেণীর উপাসক আল্লাহকে চিনেন এবং দেখেন। এরা রাসুলের প্রথম নির্দেশের ভেতর আছেন মানে এরা জ্ঞানী সম্প্রদায়। তাদের জন্য বলা হচ্ছে ‘লা ছালাতা ইল্লা বে হুজুরিল ক্বালব’ অর্থাৎ ছালাত নেই আল্লাহকে হাজির নাজির দেখা ব্যাতিত। এরা সংখ্যায় খুবই কম । আর দ্বিতীয় শ্রেণীর উপাসক বা ইবাদতকারী হলো তারা আল্লাহকে দেখে না, তবে আল্লাহই তাদের দেখেন, এই বিশ্বাসে পড়ে আছে। এরা সাধারণ শ্রেণীর মানুষ। এরা অন্ধ-মূর্খ। এই শ্রেণীর উপাসকদের মধ্যে দুটি ধারা।
বৃহৎ দলটি গোঁড়া জঙ্গি-মৌলবাদী। এরাই ধর্মের নামে যতো অন্যায়-অত্যাচার, জোর-জুলুম, মানুষ হত্যা ইত্যাদি করে যাচ্ছে। এই দলটি সর্ব ধর্মের আড়ালেই বাস করছে। এমন কোনো জঘণ্য কাজ নেই যা তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে করছে না। তাদের কোনো ধর্ম নেই- এরা ধর্মের হিজাব পড়ে আছে তথা ধর্মের ছদ্মাবরণে বাস করছে। পৃথিবীতে যতো মানুষ মারা গেছে তার অর্ধেকই মারা গেছে ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব বিভেদের কারণে। এরা বাস করছে হায়ানিয়াতের ভিতর। পৃথীবি ধ্বংস হবে বনের পশুদের দ্বারা অবশ্যই নয়, ধ্বংস হবে মানব নামক জীবের মনের মধ্যে বাস করা পশুদের দ্বারা। বনের পশুদের আকার আকৃতির সীমা আছে কিন্তু মানব মনে বাস করা পশুদের আকার আকৃতির কোনো সীমা এবং সংখ্যা নেই। এ মানবরূপে বাস করা নরপশুদের দ্বারাই মানব সভ্যতা ধ্বংস হবে। তাদের কোনো ধর্ম নেই পশুত্ব ছাড়া।