লেখক – শাহ্ মোকলেসুর রহমান
“রাসুলে পাকপর ভেজ আয় খোদা, দরুদ ও সালাম, আলী ও ফাতেমা হাসান হোসাইন পারভী মোদাম”
মানব ইতিহাসে, বিশেষ করে ইসলামের মহত্তম সন্তানদের মধ্যে আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (কঃ) নিঃসন্দেহে স্বরণীয় ব্যক্তিত্ব। মহানবীর (সঃ) এর নৈকট্য তাঁর মত আর কেউ লাভ করার সুযোগ পায়নি। তার জীবন ধারা এক আদর্শিক ভিওির উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নানাবিধ বিপত্তির মধ্যেও তিনি সেই আদর্শকে সমুজ্জল করেন। তাঁর অসীম জ্ঞান ও আকর্ষনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট তাকে সাধারন মানুষের কাছে অত্যন্ত আপনজন হিসাবে পরিচিত করে তোলে। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী, আলাপ আলোচনায় অত্যন্ত বিজ্ঞ এবং পরমসহিষ্ণু।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর প্রতি তাঁর অবিচল ভক্তি ও আস্থা এবং তাঁর নির্দেশ পালনে দৃঢ়চিত্ততার তুলনা নেই। আরবী ভাষায় আমীরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ) এর অসাধারন বুৎপত্তি ছিলো এবং তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর লিখিত পত্র ও বক্তৃতার মধ্যে। তিনি ছিলেন অসাধারন বীর ও মহানবীর বিশ্বস্ত সাহাবী, ন্যায়পরায়ণ খলিফা, সর্বোপরি একজন মহান জ্ঞান সাধক।
আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) আরবের কুরাইশ গোত্রের অন্যতম শাখা হাশিমী বংশে মহানবী (সাঃ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তির ১০ বছর পূর্বে রজব মাসের ১৩ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আবু তালিব এবং মাতার নাম ফাতিমা বিনতে আসাদ। পৃথিবীতে তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি পবিত্র কাবা ঘরের অভ্যন্তরে জন্মগ্রহণ করেন। জননী স্বীয় পিতার নামানুসারে পুত্রের নাম রাখেন আসাদ, যার অর্থ সিংহ। পাঁচ বছর বয়স থেকেই হযরত আলী (আ) আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও মহীয়সী নারী বিবি খাদিজার নিকট লালিত পালিত হন। তাই তাঁর মন মানসিকতা প্রিয় নবীর পবিত্র হাতের পরশেই বিকশিত হয়েছে। রাসুল (সা) উদার হস্তেই তাকে ভবিষ্যত মানব জাতির জন্য গড়ে তুলেছেন। বদর যুদ্ধের পর মহানবী (সা) এর প্রিয় কন্যা বিবি ফাতিমা (আ) এর সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
শিক্ষা নিয়েছেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষকের নিকট থেকে, সংকলন করেছেন পবিত্র কোরান। বিজয় এনেছেন ইসলামের প্রতিটি যুদ্ধে, রচনা করেছেন হুদাইবিয়ার সন্ধি। তিনি খেতাব পেয়েছেন আল্লাহর তরবারি, ধ্বংস করেছেন কাবার সমস্ত মুর্তি। জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন নবীর হিজরতে, প্রনয়ণ করেছেন হিজরী কামারী সনের। মহান আল্লাহপাক তার কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে পবিত্র কালাম পাকে আয়াত নাযিল করেছেন। নবী কারীম (সা) তাকে ভালোবেসে উম্মতের যোগ্য কান্ডারী ও ওয়াজির হিসেবে প্রকাশ করেছেন অসংখ্য হাদীস, যা বোখারী থেকে শুরু করে প্রতিটি হাদীস গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
তৃতীয় খলিফা ওসমান (রা) নির্মম ভাবে হত্যা হওয়ার ৬ দিন পর আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) খলিফার সম্মানিত পদ গ্রহণ করেন। তাঁর খেলাফতকাল মাত্র ৪ বৎসর ৯ মাসের মধ্যে হযরত ওসমান হত্যার বিচার ও শাস্তির দাবী, নানা বিক্ষোভ, বিশৃঙ্খলা, অশান্তির মধ্যেও উষ্টের যুদ্ধ ও ভয়াবহ সিফফিনের যুদ্ধ মোকাবিলা ছাড়াও তাকে খারিজিদের দমনে তৎপর হতে হয়। এসব প্রতিকূল অবস্থা সত্বেও ইসলামের বিধান অনুযায়ী একটা শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, তার গৃহিত ব্যাবস্থা এখন ও আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত।
এইসমস্ত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাঝে এবং সীমাহীন দুঃখ কষ্ট ও দারিদ্রের মাঝেও এত সুন্দর ভাবে রাষ্ট্রকে পরিচালনা করে, তিনি এমন শিক্ষা দান করেন যার মাধ্যমে সবাই সত্যিকারভাবেই সিরাতে রাসুল (সঃ) এবং মারেফতে ইলাহীর পথ দেখতে পান। তাঁর সত্যিকার মারেফত বোঝা আমাদের আয়ত্বের বাইরে। কেননা তিনি নুরে মেশকাতের সত্যিকারের আয়না। পন্ডিত, চিন্তাবিদ, আলেম ওলামায়ে কেরামগণ যত বেশি এই সমুদ্রের গভীরে নিমগ্ন হবেন, তত বেশি আলো আবিষ্কার করতে পারবেন। যাহা মারেফতের এলাহী তৃষ্ণাকারীকে মাধুর্য দান করে।
বর্তমান বিশ্বে আমরা একটি বিপর্যস্ত সময়ের মধ্যে বাস করছি। ন্যায়নীতি পৃথীবিতে ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। মানুষের জীবন ও বিশ্বাসে চলার পথে শিথীলতা ঘটছে, কর্তব্য কর্মে অবহেলা একটি প্রাত্যহিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।
সুদুর অতীতে উচ্চারিত আমীরুল মুমেনিন হযরত আলী (ক) এর সাবধানবাণী বর্তমান মুহুর্তে অত্যন্ত প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
বাণী – “দেশের বিদ্বান ব্যাক্তিগণ লোভী হইলে কে দেশের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করিবে? দেশের নেতৃবৃন্দ ঐর্শ্বযের পিছনে ছুটিলে সাধারণ মানুষ কাহাকে অনুসরণ করিবে? দেশের ব্যাবসায়ীগণ অসাধু হইলে মানুষ কাহাকে বিশ্বাস করিবে? দেশের সৈন্যদল দেখার শোভা হইলে কে দেশ রক্ষা করিবে? দেশের প্রশাসন, বিভাগীয় রাজকর্মচারীগণ এবং দন্ডধারী বিচারকমন্ডলী দায়িত্বহীন হইলে নিপীড়িত জনগনকে কে রক্ষা করিবে?”
আমীরুল মুমেনিন আলী (আ) একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত এক গভীর জ্ঞানের অধিকারী হিসেবে। সারা বিশ্ব তাঁকে শ্রদ্ধা জানায় সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে। একই সাথে তিনি ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রতীক। মহান আল্লাহর ওপর তার গভীর বিশ্বাস এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর ওপরে তার আস্থা ছিলো প্রবাদতুল্য। বিশ্বনবী তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘আমি জ্ঞানের শহর আর আলী তার দরজা’ , আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা। বিশ্বনবীর এই সফল উক্তি থেকেই মহানুভব আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) এর অসাধারন জ্ঞানের পরিচয় বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে।
কুরআনে – লাইলাতুল মাবিত অর্থ্যাৎ রাসুল (সা) এর হিজরতের রাতে আলী (আ) রাসুলের বিছানায় শুয়ে ছিলেন। তাঁর এ মহান ত্যাগের জন্য মহান আল্লাহ তার সম্মানার্থে এ আয়াত নাযিল করেন- ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছেন যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজেকে বিক্রয় করে থাকেন। আল্লাহ তার বান্দাগণের প্রতি দয়ার্দ্র। (সুরা বাকারা-২০৭)’
বোখারী শরীফে বর্ণিত আছে- গাদীরে খুম নামক স্থানে জোহরের নামাজান্তে রাসুলুল্লাহ (সা) আমীরুল মুমিনিন হযরত আলীকে নিজ ডান পার্শ্বে দাড় করাইলেন। তারপর আল্লাহ তায়ালার গুণগান পূর্বক বলিলেন, হে লোক সকল- আমার যেনো ডাক আসিয়া গিয়াছে এবং আমি উহা গ্রহণ করিয়া নিয়াছি। আমি অতি ভারী মহান দুইটি বস্তু তোমাদের নিকট রাখিয়া যাইতেছি। আল্লাহর কিতাব এবং আমার পরিবার পরিজন আমার আহলে বাইয়্যেত। আলী,ফাতেমা, হাসান, হোসেন এরাই আমার আহলে বাইয়্যেত। আমার পরে এই দুই বস্তু সম্পর্কে নীতি অবলম্বনে তোমরা গভীর চিন্তা করিও। এই বস্তুদ্বয় একই সাথে হাউজে কাওসারের কিনারায় আমার নিকট উপস্থিত হইবে।
তারপর নবী বলিলেন, আল্লাহ আমার প্রিয়, আমি সকল মুমিনের প্রিয়। এই কথা বলার পর নবী (সা) আলী (আ) এর হস্ত ধারণ পূর্বক বলিলেন, আমি যাহার প্রিয় হইবো আলীও তাহার প্রিয় হইবে। হে আল্লাহ তুমি প্রিয় বানাও ঐ ব্যাক্তিকে যে আলীকে প্রিয় বানায় এবং শত্রু গণ্য করো ঐ ব্যাক্তিকে যে ব্যাক্তি আলীকে শত্রুকে শত্রু বানায় এবং তুমি ভালোবাসো ঐ ব্যাক্তিকে যে ব্যাক্তি ভালোবাসে আলীকে এবং অসন্তুষ্ট থাকো ঐ ব্যাক্তির প্রতি যে আলীর প্রতি অসন্তষ্ট থাকে এবং সাহায্য করো ঐ ব্যাক্তিকে যে আলীকে সাহায্য করে। (পৃষ্ঠা ৪০৪ বোখারী শরীফ)।
আলী সম্পর্কে হাদীস-
১. আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা। (বোখারী)
২. হে আলী তোমার সাথে আমার ঐ রূপ সম্পর্ক যেরূপ সম্পর্ক মুসার সাথে হারুনের। তবে পার্থক্য এতটুকু পার্থক্য যে আমার পরে আর নবী আসবে না। (বোখারী)
৩. আমি জ্ঞানের শহর আর আলী তার দরজা। (মুস্তাদরাকে হাকেম)
৪. আলীকে মহব্বত করা ঈমান, আর আলী (আ) এর সাথে শত্রুতা মুনাফেকি। (মুসলিম ১খন্ড, ৪৮পৃ)
৫. যে আলীকে দোষারোপ করলো সে আমাকে দোষারোপ করলো। আর যে আমাকে দোষারোপ করলো সে খোদাকে দোষারোপ করলো। (বোখারী ২খন্ড,তিরমিযি ৫খন্ড,মুসলিম ২ খন্ড, সুনানে মাজাহ, মুস্তাদরাকে হাকীম ৩খন্ড)
৬. হে আলী তুমি আমার থেকে আমি তোমার থেকে। (বোখারী ২খন্ড,৭৬পৃষ্ঠা)
৭. রাসুল হতে আবুবকর বর্ণনা করছেন, রাসুল (সা) বলেছেন,আমার ও আলীর হাত ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সমান। (কানযুল উম্মাল ৬ খন্ড,পৃ ১৫৩,হাদিস নং ২৫৩৯)
৮. নবী করিম (সা) বলেছেন,যে কেউ পছন্দ করে আমার মতো জীবন যাপন করতে ও আমার ন্যায় মৃত্যুবরন করতে এবং সেই চিরস্থায়ী বেহেশত যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, তার অধিবাসী হতে, সে যেনো আমার মৃত্যুর পর আলী ও তার বংশধরদের অভিভাবকত্ব মেনে নেয়। তারা তোমাদেরকে হেদায়েতের দ্বার হতে বহিষ্কার করবে না এবং গোমরাহীর পথে পরিচালিত করবে না। (কানযুল উম্মাল ৬খন্ড,পৃ ১৫৫,মুস্তাদরাক ৩খন্ড,পৃ১২৮)
হযরত আলী এর সন্তানদের মধ্যে সকলের শ্রদ্ধাভাজন যারা ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইন, মোহাম্মদ হানাফিয়া, বিবি জয়নব, উম্মে কুলসুম, রুকাইয়া, উম্মে হাসান নাফিসাহ ও সোগরা।
হযরত আলী (আ) এর স্বরণীয় ঘটনা সকলের মনে প্রাণে জীবিত রাখার মাধ্যমে আহলে বায়েতের প্রতি ভালোবাসার আহ্বান করছি।
খারিজীদের গোপন ষড়যন্ত্রে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) ১৯ রমজান কুফা মসজিদে মেহরাবে ফজরের নামাজরত অবস্থায় গুপ্ত ঘাতক আব্দুর রহমান মুলজামের তলোয়ারের আঘাতে মাথায় মারাত্মক আহত হন।
মানব ইতিহাসের এই ব্যক্তিত্ব আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) পরম করুণাময়ের স্বানিধ্য লাভের জন্য ইহজগতের বন্ধন ছিন্ন করে ৬৩ বছর বয়সে ২১ রমজান ৪০ হিজরী শাহাদাৎ বরণ করেন।