লেখক – ড. জাকির হোসেন
“আমারি রচিত কাননে বসিয়া, পরানু প্রিয়ারে মালিকা রচিয়া
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া, আপনারি গলে দোলে হায়”
কে মালা রচে? কি সে মালা? কাননটি কিসের? মালা কাকে পড়ায়? সহসা জেগে উঠার দরকার কী? জেগে উঠে কী দেখা গেল? কে সে প্রিয়? তার গলে পড়ানো মালা আবার নিজের গলায় দোলছে কেন? হ্যাঁ, সেই ‘আপনের চেয়ে আপন যে জন’ তাকে খুুঁজে বেড়াচ্ছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি ইউনিভার্সিটির নয়, ইউনিভার্সের ছাত্র। জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়- যার সিলেবাসে রয়েছে শুধু আপনাকে জানা, চেনা, রহস্যজ্ঞান উদ্ধার করা, সংস্কার বর্জন করা আর অচেনাকে চেনা। তাই তো তিনি তার আনন্দঘন সুন্দর ‘প্রেমঘন সুন্দর’ কে স্বীয় আত্মদর্শনে উপলব্ধি করে স্বগতোক্তি করতে পারেন “যখন কুড়ি হয়ে ফুটে উঠি, পাতা হয়ে ঢেকে রাখ” । কবি বলেন, “মুক্তির দিগ্দর্শন হলো আপন অস্তিত্ব বা দেহমন নামক অস্তিত্বকে সমর্পণ করা”। সে মুক্তি কোনো বৈষয়িক, সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষন থেকে মুক্তি নয়- এ মুক্তি মহানন্দের-মুক্তি, পরম পাওয়ার মুক্তি। তার জন্য প্রয়োজন রিপু- ইন্দ্রিয় হীন অবস্থা সৃষ্টি। আর সে অবস্থা সৃষ্টি হলে চিরচাওয়া, পরম আরাধ্য মহান সত্ত্বা হবে নিত্যসঙ্গী।
মনুষ্যত্বের ও মানবতার মহান সৈনিক নজরুলের মতে কাফের মানে হলো আবরণ যা আবৃত করে রাখে বা ঢেকে রাখে। “আমার মধ্যে যতক্ষণ আবরণ অর্থ্যাৎ ভেদাভেদ জ্ঞান, সংস্কার, কোনো প্রকার বাধা-বন্ধন আছে ততক্ষন আমার মাঝে কুফরও আছে। আমি সর্ববন্ধনমুক্ত, সর্বসংস্কার মুক্ত, সর্বভেদাভেদজ্ঞান মুক্ত না হলে সেই পরম নিবারণ, পরম মুক্ত আল্লাহকে পাব না আমার শক্তিতে।
নিছক শাস্ত্র না ঘেটে, শুধুই ধর্মগ্রন্থের বেড়াজালে আটকে না থেকে প্রেম ও ধ্যানের সহৃদয় কার্যকরি পথচলাই অধরা কে ধরার সুযোগ করে দিতে পারে- দিতে পারে সেই সদানন্দ জ্যোর্তিময়ের প্রেমময় সান্নিধ্য এনে দিতে।
“খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে, বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে
ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধরে।”
ধ্যান, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা কাজী নজরুল ইসলাম অধ্যাত্মবাদ, সুফী, মরমী ও বাউল সম্প্রদায়ের আত্মার উদার জমিনে পরিভ্রমন করেছেন স্বচ্ছন্দে। তিনি ছিলেন ধর্মীয় দর্শন সমুহের এক মহান পর্যবেক্ষক এবং তাঁর ছিল ঋষির আত্মা। ভক্তকুলের জন্য, অসুর সংহারের জন্য, ইনসাফ কায়েমের জন্য, সৃষ্টিকে অসত্য থেকে সত্যে রূপ দেয়ার জন্য, কল্যাণময় স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে যারাই এ ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছেন নজরুল কোনো বাছবিচার ছাড়াই তাদের সকলের জয়গান গেয়েছেন।
আত্মা বা মর্মের সঙ্গে যার সংযোগ, সেটাই মরমী। পরম সত্ত্বার সঙ্গে যার মর্ম বা অন্তঃকরণ সর্বক্ষণিক সংযুক্ত তিনিই মরমী। স্রষ্টার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংযোগ স্থাপনে সক্ষম ব্যক্তিকেও মরমী বলা হয়। আমাদের বিদ্রোহী কবি কী নিজেও মরমী ছিলেন? তাকেই উদ্ধৃত করা যাক-
“মম একা ঘরে নাথ দেখেছিনু, তোমাহীন দীবালোক হীন করি
হেরি বাহির আলোকে অনন্তলোকে এ কী রুপ তব মরি মরি।”
অথবা,
“প্রানের: মতন আত্মার সম
আমাতে আছ হে অন্তরতম
মন্দির রচি, বিগ্রহ গড়ি
দেখে তুমি হাস স্বামী।”
আমাদের বিদ্রোহী কবি বিশ্বের নকল ধর্মগ্রন্থ, অবতার, মানব মনের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করেছেন দেহ-মন নামক অস্তিত্ব দিয়ে, আদি রহস্য দর্শন করে, সমর্পণ করা জন্য আল্লাহ-মোহাম্মদ-আদম সৃষ্টির মৌলিক রহস্যের পর্দা উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন:
“সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায়
সে যে আমার কামলিওয়ালা, কামলিওয়ালা”।
কোনো মরমী, বাউল, সুফী ও বৈষ্ণব-সাধক কোনো মানুষকে সাম্প্রদায়িক ভাবে চিহ্নিত করেন না-পরমত অসহিষ্ণু হন না- তারা জ্ঞানচক্ষু, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তরচক্ষু দিয়ে আপনাকে মৌলিক সত্ত্বার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করার জন্য সার্বক্ষণিক ভাবে অস্থির থাকেন। ধর্মব্যাবসায়ীদের আচার সর্বস্ব লোক দেখানোর আনুষ্ঠানিকতা তাদের আর আকর্ষণ করে না। নজরুলের মতে “বুড়ো নীতিবিদ-শাস্ত্র শকুন, জ্ঞান মজুরের দল- অজ্ঞানতা, সম্প্রদায়িকতা, অসাম্য ও ভেদজ্ঞানে বন্দি খাচার পাখি কিচির মিচির শব্দ, গৃহকর্তার শেখানো বুলি ছাড়া পাখি কিছুই শিখলো না, আল্লাহকে জন্মে চিনলো না, পাখি খাচা হতে মুক্ত হলেও শেখানো বুলির অতিরিক্ত কিছু জানা সম্ভব হয় না”।
“জোব্বা জাব্বা দিয়ে ধোকা
দিবি আল্লাহরে ওরে বোকা,
কেয়ামতে হবে মাথা নিচু”।
অথবা:
এ দুনিয়া পাঠশালা
ধর্ম গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূন্য পূন্য ছালা!
হেথা সবে সম পাপী
আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি”।
নজরুলের মতে এ দেহ মনের মধ্যে সদা বিরাজমান অনন্য সত্ত্বা কে জাগাতে হলে তাকে সত্য দিয়ে আঘাত করতে হবে। “পাথরেতে অগ্নি থাকে,বের করতে হয় ঠুকনি ঠুকে”। সেজন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে মহাআড়ম্বরে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের চেয়ে নিজের নিভৃত অন্তর্দেশেই পরম সুন্দরের সন্ধান করা শ্রেয়।
“এই তোর মন্দির মসজিদ
এই তোর কাশী বৃন্দাবন,
আপনার পানে ফিরে চল
কোথা তুই তীর্থে যাবি মন”।
মানুষ যেন অন্নবস্ত্রহীন, পরাধীন না থাকে সেজন্যে প্রার্থনা, সাধ, সাধনা ছিলো নজরুলের। পাশাপাশি বিদ্রোহী কবির সাধনা ছিলো অরূপ দর্শনের। “মানুষ দেখার কৌতুহল আমার নেই, স্রষ্টা দেখার সাধনা আমার। সুন্দরকে দেখার তপস্যা আমার। তোমার প্রকাশ দেখতে চাই আমি, তোমায় দেখতে চাইনি। সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টাকে যে দেখেছে, সেই বড় দেখা দেখেছে। এই দেখা আর্টিষ্টের দেখা, ধ্যানীর দেখা, তপস্বীর দেখা। আমার সাধনা অরূপের সাধনা।
“এসে শয়তান ভোগ বিলাসের
কাড়িয়া লইয়াছে ঈমান তাদের
খোদারে হারায়ে মুসলিম আজ হয়েছে সর্বহারা”।
আল্লাহ, মোহাম্মদ (সা) আল কোরআন, বেদ, গীতা, পুরান, ত্রিপিটক ও বাইবেলের সারমর্ম ও সারকথা উদ্ধার করে পরমেয়র জয়গানে বিদ্রোহী কবি ছিলেন মুখরিত। গুরুবাদী ধর্মীয় দর্শন ও তাদের চিন্তাচেতনায় মৌলিকতত্ব তথা সমাজ, রাষ্ট্র,মানুষ ও ধর্মীয় সকল পবিত্র গ্রন্থ ও অবতারদের রহস্য উদ্ধার করে পশুত্ব ও অশুভ শক্তিকে বর্জন করে কিভাবে আদর্শ, ধারাগত মুক্তির স্পৃহা জাগ্রত করা যায় সেটাই ছিলো তার লক্ষ্য। তাঁর ‘পথ হারার পথ’ আল্লাহত্ব অর্জনের এক দিক নির্দেশক।
অধ্যাত্ম ধর্ম সাধনার মৌলিক বিষয় হলো “মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’ -নজরুলের ভাষায়-
“ভগবান-
আত্মজ্ঞান”
অথবা,
“দেবতারে যারা করিছে সৃজন
সৃজিতে পারে না আপনারে,
আসে না শক্তি,পাষনা আশিস
ব্যর্থ সে পূজা বারেবারে”।
নজরুলের মতে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসতে হবে, মুক্ত জ্ঞান আর বৈষয়িক জ্ঞানের তুলনা করে অর্জন বর্জনের দ্বারা আপনাকে জানতে হবে।পরমাত্মার রহস্য উদঘাটন করতে হলে দেহমন অবিরাম স্বতঃস্ফূর্ত কিসের অর্চনা করে চলেছে, সেদিকে নজর দিতে হবে। অজ্ঞানতা দুঃখ বৃদ্ধি করে, ভেদজ্ঞান বাড়িয়ে দেয়। বিষয় বাসনাও দুঃখবোধের উপাদান।মুক্তির জন্য মুক্ত জ্ঞানের শক্তি বৃদ্ধি করতে হয়। নজরুল বলেন, আপনারে তুমি চিনিয়াছ যবে, শুধিয়াছ ঋন, টুটেছে ঘুম, অন্ধকারের কুড়িতে ফুটেছে আলোকের শতদল কুসুম।
বিদ্রোহী কবি শ্রদ্ধা করতেন তাঁদের যাঁদের আত্মা জাগ্রত। যাঁরা বাইরের সম্মান লোভ, খ্যাতি সবকিছু বিসর্জন দিয়ে রাহে লিল্লাহ নিজেদের সদ্কা দিতে রাজি, আল গনি আল্লাহতে আত্মনিবেদন করলেই বাদশাহর বাদশা যিনি তার পরম করুণা পাওয়া যায়। এই আত্মনিবেদনের মাধ্যমেই পৌঁছে যাওয়া যায়- ফানাফিল্লাহর স্তরে। আর ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ মৌলিকত্বের সঙ্গে এই দেহমন নামক অস্তিত্ব দিয়েই অর্জন ও উপলব্ধি করার রহস্য নজরুল ইসলাম গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। বাকাবিল্লাহ আল্লাহর সাথে বা আল্লাহর অবস্থার স্থায়ী অবস্থাতে উপনিত হওয়া। বিশেষ এ ধারাতে অনেক সুফী, বাউল, ফকির ও সন্ন্যাস জীবনের সাধন- ভজনের দর্শন অগনিত। হযরত মোহাম্মদ (সা) নবুয়ত ও বেলায়েতের দর্শন হেরা গুহা থেকেই প্রকাশ পেয়েছিলো। এর মুল গ্রন্থ হলো দেহমন নামক অস্তিত্ব। এই বেলায়েতের ধারকদের এক সফল উত্তর পুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম- যিনি তার বন্ধন মুক্তির ঘোষণা দেন এভাবে “ আমি সহসা চিনেছি আমারে আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাধ”।
আজন্ম আকাঙ্খিত, চির চাওয়া সেই পরম প্রিয়তমের দর্শন বা সান্নিধ্য লাভে কাতর বিদ্রোহী কবির কন্ঠে এ কী শুনি –
“ তোমার না দেখা পরম প্রিয়তম পরম বন্ধুকে পেতে, বিপুল অসহ তৃষ্ণা, স্বপ্ন, সাধ, কল্পনা, বাধ না মানা, বেগসহ অসীমের পানে প্রবল প্রবাহ নিয়ে উজান গতিতে উর্দ্ধের পানে চলেছিলে, আজ সেই পরম পূর্ণতার, পরম শান্তি ও পরম মুক্তির আনন্দবাণী নিয়ে আমি তোমার কাছে এসেছি তোমার বন্ধু হয়ে। এই পৃথিবীতেই তার সঙ্গে তোমার অপরুপ পূর্ণ মিলন হবে। তার আগে তোমাকে এই অসুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর করতে, সর্ব অসাম্য, ভেদকে দুর করতে হবে। মানুষ যে তার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, পৃথিবীতে তা তোমাকে প্রমাণ করতে হবে, তোমার সুন্দরের সাথে পরম বিলাস, পরম বিহার”।
জ্যোর্তিময় সেই সুন্দরের সাথে পরম বিলাস আর পরম বিহার রত বিদ্রোহী কবির মত স্রষ্টার প্রেমের অমৃত সুধা আকন্ঠ পান করে তারই আনুগত্য ধন্য হয়ে আমরা কজন বলতে সাহসী হয়েছি-
ঐ নামের দাওন ধরে আছি
আমার কিসের ভয়,
ঐ নামের গুণে পাব আমি
খোদার পরিচয়।