লেখক – ফকীর আতিকুর রহমান চিশতী
কুরআনে কলব বা অন্তর সম্পর্কে বেশ আলোচনা দেখা যায়। হাদীসের বরাত দিয়ে “এক খন্ড মাংস” কে কলব বলে প্রচার করছেন আমাদের ওহাবী ও সমমনারা। অবাক হওয়ার ব্যাপার হলো সুফীবাদের পোশাক পড়েও কেউ কেউ এরূপ কথা বলছেন। সেখানে নাকি যিকিরের তেজে বুকের মাংস লাফালাফি করে। এগুলো প্রকাশ্য রিয়া, তা রাসূল (স.) ও অলিয়ে কামেলের জীবনী হতে প্রমাণিত ৷ কুরআন কলব অর্থ হৃদয় বা হার্ট নির্দিষ্ট করে নি, কেন না- পণ্ড, পক্ষী, মৎস, কীট পতঙ্গের মধ্যে যারা শ্বাস-প্রশ্বাসে বেচে আছে তাদের মধ্যে “হৃদপিন্ড” দেখতে পাই। একটি সাধারণ অর্থে কলবকে হৃদপিন্ড বলা যায় মাত্র, যেহেতু তা দেহে রক্ত সংবহনতন্ত্র সচল রাখে । তবে এ হৃদপিন্ডেরও পরিচালক রয়েছে। মস্তিষ্কের এক এক অংশ অংঙ্গ সমূহকে পরিচালিত করে। জড় জগতের ইন্দ্রিয় ঘরসমূহ অনুভূতি ও জ্ঞানের বাহ্যিক পথ। রুহ বস্তজগতের আবরণে জড়িয়ে আত্মদর্শনে বাধা পরেছে। কলব, ফুআদ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা কি বুঝায় কুরআন হতে দেখি ।
“ইন্না ফী যালিকা লাযিকরা লিমান কানা লা কালবুন আও আলকাস সামআ ওয়া হুওয়া শাহীদ ৷” অর্থঃ “নিশ্চয় এতে উপদেশ (যিকর বা স্মরণ) রয়েছে তার জন্য যার কলব আছে। এবং যে কান দেয় আর সাক্ষ্য বহন করে (সে হয় সত্য প্রত্যক্ষকারী) ।”(৫০:০৭]
“কাযালিকা ইরাতবাউল্লাহু আলা কুল্লি কালবি মুতাকাব্বিরিন জাব্বার”। অর্থঃ “এইরূপেই আল্লাহ প্রত্যেক উদ্ধত অহংকারীর কলবের উপরে মোহর মেরে দেন।” [৪০ঃ৩৫]
“লাছম ক্কুলুবুল লা-ইয়াফকাহূনা বিহা, ওয়া লাহুম আ’ইউনুল লা ইউবছিরুনা বিহা, ওয়া লাহুম আযানুল লা-ইয়াসমা’উনা বিহা, উলাইকা
কাল আনআমি বালছুম আদাল্লু; উলাইকা হুমূল গাফিলুন ।”অর্থঃ “তাদের রয়েছে হৃদয় কিন্তু তা দিয়ে হৃদয়াঙ্গম করে না, এবং তাদের
রয়েছে চক্ষু কিন্তু তা দিয়ে দেখেনা, এবং তাদের রয়েছে কর্ণ কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা পশুর মত, বরং তারা ভ্রান্ত । এরাই তারা যারা গাফেল (অলস, অমনোযোগী) ৷” [৭:১৭৯]
“খাতামাল্লাহু আলা কুলুবিহিম” আত্মবিস্মৃতদের কলবের উপর মোহর মেরে দিয়ে আল্লাহ মানুষ ও জিনকে সত্যপথ হতে গাফেল রাখেন। “এবং ফেরাউন বলেছিলঃ হে হামান, আমার জন্য একটি মিনার তৈরী কর যেন আমি বিশেষ পথগুলিতে পৌঁছতে পারি” [৪০:৩৬|। আকাশের পথে (জ্ঞানের উচ্চতায়) অবস্থিত পথ ও পদ্ধতিগুলির আত্মিক দিক কঠিন হওয়ায় সে বস্তুমুখী উচ্চতার পথগুলিতে পৌঁছতে চাইলো। কলব খতম হয়ে তারা আল্লাহর জন্য কাল্পনিক আসন বানায়, লৌকিক এবাদতের পথগুলোকেই বেছে নেয়। অথচ তারা মৃত, পশুকে শিক্ষা দিলে কিছু কিছু বিষয়ে বুঝতে পারে, তারা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। রাসূল ডাকেন এমন কিছুর দিকে যা জীবন দান করে। আল্লাহ “বাইনাল মাররি ওয়াল সালবিহি” অর্থঃ “মানুষ ও তার কলবের মধ্যে” বিরাজ করছেন, তারই দিকে হাশর করা হয় [৮:২৪]।
সুফীরা “কলব” কে “হৃদপিন্ড” অনুবাদ না করে অনুবাদ করেছেন “দেল”। আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে “মুমিনের দেল আল্লাহর আরশ” ৷ এক খন্ড মাংসপিন্ড কি আল্লাহকে ধারণ করতে পারে? তাই তো দেখতে পাই “দেল নহে মাংস পিন্ড, দেল বিশ্ব-ভ্রমান্ড” (দেওয়ান রশিদ র.) সূফীদের আলোচনা ৷ দেলে তামাম মজুদ আছে, দেলে মুদওয়ারীতে মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র খেকে বৃহৎ তত্ত্ব ও তথ্য জমা আছে। মহাবিশ্বে দেল মাত্র একটি ৷ গরু বকরি জবাই করে যে দেল আমরা দেখতে পাই মানুষে তা আছে, দেল মুদওয়ারীর নির্দেশ প্রাপ্ত একটি আজল পর্যন্ত কর্মক্ষম দেল এটি । দেহ ধ্বংসের সাথে সাথে এ মাংসপিন্ড পচে যায়। কিন্তু দেল মুদওয়ারীতে ভাল-মন্দ তামাম তথ্য জমা থাকে কিতাবাকারে প্রতিফল দেয়ার জন্য, এখানেই রয়েছে মহাপুরুষদের আল কেতাব যা হেফাযতে থাকে। কোনকালে স্মৃতিভ্রম হয় না। সাধারণ ব্যাক্তির পরিচিত দেলে (সানোয়ার, নিলুফারী) জমা তথ্য মৃত্যুর আঘাতে মুছে যায়।
৭০ হাজার নফসানী পর্দার অন্তরালে রুহের পরিচিতি প্রকাশ পায় না। কলবে রব তাঁর দিকে হাশর করেন যাতে তাকে মুক্তির দিকে আনা যায়। রুহ কোন মানুষে প্রকাশিত হতে না পেরে পশুজগতেরও নিম্ন অধঃপতনে নেমে যায়, এতে সেটিতে রুহ্ নাই এমন প্রমাণ করে না, বরং রুহ নফস আম্মারার ফেলে প্রকাশ পাওয়ায় তা রুহ হায়ানী নামে প্রকাশিত হয়, যা কোন কোন ক্ষেত্রে আনআম বা পশু হতেও নিকৃষ্ট। আলোচনা হতে স্পষ্ট যে রুহের শক্তিই দেহের শক্তি প্রবাহের মূল কারণ। রবের আমর বা নির্দেশ হতেই “কুন” বল প্রয়োগ হয়ে প্রতিটি জীবকোষ কর্মশীল আছে। জীবের অস্তিত্ব, বৃদ্ধি, বংশরক্ষা ও জিনকে প্রবাহমান রাখা রুহের শক্তিরই পরিচয় বহন করে। পরিস্কার ভাষায় বলা যায় কোথাও কোন নফস কোন কালেও অস্তিত্বে আসেনা বা আসতে পারে না যতক্ষণ না তাতে কোন রুহের শক্তি কার্যকরহয়।
রুহ যখন যে নফসের উপর কর্তৃত্বশীল দেখার তখন সেই নফসের পরিচিতিতে রুহের পরিচিতি হয়। যেমন- নফসে ওয়াহেদ রুহু কুদসি, নফসে আম্মারা রুহু হায়ানী, নফসে মোৎমাইন্না রুহ ইনসানী, নফসে লাওয়ামা রুহ মাবাতি, নফসে মুলহেমা রুহ জামাদির পরিচিতি বহন করে। রুহের পরিচিতি নফসে, নফসের পরিচিতি অজুদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রকাশ পায়। আল্লাহর আহাদ, ওয়াহেদ, লা-শরিক, দুনিল্লাহ, গায়রুল্লাহ জগতগুলোর রহস্য রুহের নানামূখী পরিচিতি ভঙ্গি মাত্র। সর্বত্র তার নূর থাকলেও তিনি জাহের হন মুমিনের দেলে। রুহের শক্তি ছাড়া জীব-জগতের বেঁচে থাকার প্রেরণা কোথায়? মৌমাছিরা পর্যন্ত রুহের শক্তিতে ওহি দ্বারা অবগত হয় কোথায় ফুল ফুটেছে। প্রতিটি সৃষ্টিতেই রুহের প্রেরণা লক্ষ্য করা যায়।
পাঁচটি মুল উপাদান- বায়ু, অনল, বারি, মাটি ও এদের চালিকা শক্তি নূর সমন্বয়ে সৃষ্টি বন উপবন জখুমা-কানন জীব জন্তু নর নারীতে সু-সজ্জিত হয়। “পরম সত্তা নিজে পঞ্চভূতে সেজে, আপনারে দেখিতে আপনি প্রেমে মজে, আপনারে খুঁজে হয় উতালা”। পঞ্চভৌতিক বস্তুর পাঁচটি দেহ (পাঞ্জাতন), পাঁচটি নফস, পাঁচটি রুহ, পাঁচটি মোয়াক্কেল, পাঁচটি মোকাম, পাঁচটি মঞ্জেল, পাঁচটি রাহা, পাঁচটি ঈমান/একিন বিষয়গুলোর বিষদ গুণাগুণ যার পরিচিতি নাই তিনি আরেফ হন কি ভাবে?
দেল, রুহ্, নফস একে অপরের পরিচয়ের সমন্বয়ক। বিজ্ঞান আজ বলছে প্রতিটি মানুষ তার সাথে মরন জিন (DEATH GENE) তার পূর্ব পুরুষ হতে বহন করে চলছে। জীবন মৃত্যু নিয়ে জেনেটিক কোডের ব্যাখ্যা ও কত থিওরি দিচ্ছে তারা। তারা কিছুদিন পূর্বে মাতৃদেহ হতে জীবন্ত কোষ নিয়ে বিশেষ কৌশলে পিতৃকোষ ব্যতীত ডলি নামক ভেড়ার জন্ম দিয়ে হৈচৈ ফেলে দেন। প্রকৃতিতে আমরা অহরহ ক্লোন বা কলম পদ্ধতি দেখতে পাই। প্রতিটি দেহেই রয়েছে অসংখ্য কোষ, প্রতিটি কোষেই রয়েছে স্ব-স্ব জেনেটিক তত্ত্ব ও তথ্য, ধর্মের ভাষায় “কুন” বল আমানত রয়েছে। বিশ্বজগতে মৌলিক পদার্থ নির্দিষ্ট। তাদের জটিল সংযোগে জীবন সমৃদ্ধ জীবিত কোষ রুহেরই পরিচিতি বহন করে। মৌলিক পদার্থ থেকে জীবিত প্রাণীর নির্দিষ্ট জীবিত কোষ উৎপাদনে বস্তবিজ্ঞানীরা ব্যার্থ।
অসংখ্য সুক্ষ দেহের সমষ্টি একটি স্থুল দেহ। জীবের কোষ থেকে তার অনুরূপ জীব উৎপাদন করা আল্লাহ্র সুন্নতে রয়েছে। স্বভাব দ্বারা বীজ উৎপাদন হয়েছে। প্রতিটি বীজেই জমা রয়েছে তার ভবিষ্যত দেহ, নফস-রুহের পরিচিতি কেমন হবে তা। উপযুক্ত পরিবেশেই তা স্থুল অবস্থায় আসে। সেইখানে সকলই ছিল, ছিলনা তোর এই আকার, নজুলের ভেদ জানরে মন আমার”- এটি আরেফের বাণী । গাছ হতে বিচি হয়, বিচি থেকে গাছ- এর মধ্যে কোনোটিকে নকল বলার উপায় নাই।
বলার উপায় নাই এর মধ্যে রুহ নাই, নফস নাই- সুক্ষ অবস্থায় আছে মাত্র । ধর্মে সুফীদের (আত্মার বিজ্ঞানী) আধ্যাত্ম ব্যাখ্যা ছাড়া বর্তমানে গোমরাহদেরকে শান্তির ধর্মে ফিরিয়ে আনা কষ্টকর। মহাবিশ্বের নমুনা একটি দেহ। আরেফগণ নিজ গুরুর মধ্য দিয়ে নিজ রবের পরিচিতি পান, পরে প্রতিটি স্থানেই জগতগুরু আল্লাহর পরিচয় পান। হযরত আলী (কঃ) এর সিনার তালিম সিনা-ব-সিনা হয়ে আরেফের অন্তরে আমানত স্বরূপ জমা রয়েছে যা বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
এখন স্পষ্ট করে বলা যায়- যেখানে রুহের শক্তি নাই সেখানে নফস (স্বভাব) কার্যকর হতে পারে না। প্রত্যেকটি নফসের উপর রয়েছে হেফাযতকারী রুহ । দেহের উপযুক্তভার উপর ভিত্তি করে রুহের পরিচিতিতে এ নফসের প্রকাশ পায়। মানবদেহে পাঁচটি নফসের উপরে পঞ্চরুহের পরিচিতি পেতে পারে। কে কোন নফসে অবস্থান করে তার উপরেই নির্ভর করে, মানুষ কি পশু । পঞ্চভোতিক দেহে পাঞ্জাতন ও সপ্ত সিফাত মিলে ১২ রই লীলা-খেলা। এটি কালেমার গাঠনিক সংকেত । চারটি প্রতীজ্ঞা নূর, এলেম, শহুদ, অজুদ কার্যকর হয়ে সারাবিশ্বময় আহাদ আল্লাহর পরিচিতি ।
তদুপরি প্রত্যেক ব্যক্তিরই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজনঃ
১। আদম হাওয়া নিষিদ্ধ বৃক্ষ (কথিত গন্দম) আস্বাদন করে অপরাধী হলেন। আদম, হাওয়া, গন্ধম, শয়তান এদের একটি কম্বলে পেঁচিয়ে দুনিয়ায় নিক্ষেপ করা হলো। তারা এখন কে কোথায় কোন হালে আছে?
২। আদম অজুদে রুহ ফুৎকার করার সময় আল্লাহ কোথায় ছিলেন? আদমে কি রব/আল্লাহ্ ছিল না? না কি সুপ্ত রুহ বস্তুদেহের উপরে হুর রুপে জাহের হলো? “নুরুন আলা নূর” মানে কি? রুহ কোথায় স্থান নিলো? রুহ বের হয়ে গেলে নফস মরে, তখন আল্লাহ কোথায় থাকে?
৩। দাউদ নবির উম্মতদের অনেকে নবিকে না মানার কারণে বানর শুকরে পরিণত হয়। পশুতে রূপান্তরিত হওয়ার পরে কি তাদের রুহ ছিল? নাকি পূর্বেই এ লোকদের রুহ ছিল না?
৪। প্রত্যেক নফসের উপরেই তো হেফাজতকারী আছে? কে সে? আল্লাহ নিজেই রবরূপে? তাহলে তাঁর কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হয়? রুহ ছাড়া? যদি হয় তাহলে মানুষের রুহের প্রয়োজন কি? জিন জাতি ধুম্রহীন আগুনে তৈরী ৷ তাতে কি রুহ আছে? তারা কারা? না কি তারা এই গ্রহে আর নাই? তাদের রুহ থাকলে কিভাবে আছে? না থাকলে তাদের জান্নাত জাহান্নামে যাওয়ার অর্থ কি? শাস্তি বা শান্তি কে ভোগ করবে? আগুনকে কোন আগুনে পোড়াবে?
৫। পশু পাখিকে শিক্ষা দিলে তারা মানুষের চেয়েও জ্ঞানী হয়ে উঠে ৷ বিমান চালায়, অস্ত্র উদ্ধার করে। বাতিতে তেল না থাকলে তা জ্বালানো যায় না, ম্যাচ কাঠির অপব্যয় হয়। সাধারন লোহায় চুম্বক ঘষলে তা চুম্বকের মত অন্য লোহাকে আকর্ষণ করে। কারণ চুম্বকের কণাগুলো একমুখীভাবে সুসজ্জিত । লোহায় তা এলোমেলো । চুম্বকের সাথে ঘষাঘষিতে এলোমেলো কণাগুলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও একমুখী হয়ে চুম্বকের স্বভাব (নফস) ধরে। পগুতে কি ইনসানী রুহ সুপ্তভাবে পূর্বেই ছিল না? না কি মানুষের স্বভাবের (নফসের) কারণে পশুর স্বভাব (নফস) পরিবর্তন হয়? চুম্বকে তো কণাগুলো একমুখী হওয়ার কারণে হয়, পশুতে কিসের কারণে স্বভাবের পরিবর্তন আসে, জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে?
৬। আসহাবে কাহাফের কুকুরে রুহ ছিল কি? না থাকলে এত বুদ্ধি খাটিয়ে ঘুমন্ত মানুষের পাহাড়ায় তারা চেতন রইলো কি কারণে? পশুরা কি বেহেস্তে যাবে? নফস তো মারা যায়। এ কুকুরদের রুহ না থাকলে তারা বেহেশতে যাবে কিভাবে? যদি পশু নফস নিয়েই যায় তাহলে তারা কি বেহেস্তের হুর শরাব আরাম আয়েশ পাবে না! যদি পায় সেগুলো ভোগ করবে কিভাবে? রুহের আলোকিত রূপ হুর কি না? যদি হয় পশু নফস দ্বারা তারা কিভাবে হুর ভোগ করবে?
৭। মৌমাছিদের কাছে অহি/প্রেরণা কে পাঠায় যে কোথায় ফুল ফুটেছে? অহি কি নফস পায় না রুহ? বাবুই পাখির বাসা বানায় কি নফস/স্বভাবের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই না রুহের শক্তি কাজ করে? শুধুমাত্র নফস কি কাজ করতে পারে? সৃজনশীল শক্তি কার?
৮। দম কি? শ্বাস-প্রশ্বাস কেন গতিশীল থাকে? রুহের কারণে না নফসের কারণে? পশু-পক্ষী ও অন্যান্য জীবে শ্বাস-প্রশ্বাস, রগ, হৃদপিন্ড, হাড়, মাংস, অস্থি-মজ্জায় মানুষের সাথে এত মিল কেন? সপ্ত সিফাত অন্যান্য জীবে পঠিত হচ্ছে কি না? জাত নূর ছাড়া কোথাও সিফাত কার্যকর হতে পারে কি? নূরের সত্তাই রুহ কি না?
৯। ইহকালের শাস্তি হিসেবে বহু মানুষ পরকালে পশু কাতারভূক্ত হবে, লম্বা লম্বা খুঁটিতে বেঁধে দেয়া হবে? তখন তাদের রুহ থাকবে কি না? রুহ না থাকলে নফসমুক্ত রুহ কোথায় রাখা হবে? রুহ ছাড়া নফস কিভাবে শাস্তি ভোগ করবে? জান্নাতে রুহ থাকলে জাহান্নামে থাকবে না কেন?
বছ জগতখ্যাত অলিয়ে কামেল স্পষ্টভাবে পঞ্চরুহের পরিচিতি তুলে ধরেছেন। তাদের মধ্যে উপমহাদেশে যিনি দেওয়ান পরিচিতিতে ভূষিত হয়েছেন, তিনি তাসাউফ গুরু দেওয়ান শাহসুফী আবদুর রশিদ চিশতি নিজামী র. (ঝিটকা শরিফ) । মানবদেহকে খন্ড খন্ড করে দেল, রুহ, নফস, মন, দম, দেহ, ফেরেশতা ও তাদের ফেল, অবস্থান, রঙ, আবজাদ, দেহে মুকাত্তায়াত হরফের পরিচিতি ইত্যাদি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কুষ্টিয়া উদিবাড়ী দায়রাপাকের মনসুর শাহ র. সহ অসংখ্য ব্যক্তি উপমহাদেশে তার প্রচারিত শাস্তিবাদে স্থান নিয়েছেন।
ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক ড. উপেন্দ্রনাথ যাকে পূর্ববঙ্গের আওলিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে উল্লেখ করে তার বহু গান গজল উল্লেখ করেছেন- তিনি আর কেউ নন দেওয়ান শাহসুফী আবদুর রশিদ চিশতি নিজামী র. (ঝিটকা শরিফ)। তিনি বলেছেন-
চেন চেন আমার মন, চেন পাঞ্জাতন
যাতে রুহু পঞ্চজন, বিরাজ করে।
চেল আদম অজুদ, পাবি অজুদে মৌজুদ
তবে রুহুল আজম দেখবি নজরে।
রুহ কুদছি আর রুহ যে ইনসানী
দেখ নজর করে রুহ যে হায়ানী।
রুহু নাবাতি জামাদি, দেখবি মন যদি
তবে ভজ নিরবধি কামেলীন পীরে।
কামেলীন পীর হইবেন যিনি
রুহের সুরাত দেখাইবেন তিনি
তৌহিদ সাগরে ডুবাবে তোমারে
তবে অপরুপ রুপ দেখবে নজরে।
হজরত শাছ ছাফা পীর বাকাবিল্লা ওলি
তাহার কৃপায় জানিনু সকলি
দেওয়ান রশিদ বলে মন, ভুলনা কখন
তারে রেখ হৃদি মাঝে, যতন করে।
পঞ্চতৌতিক দেহে নবি, আলি, ফাতেমা, হাসান, হোসাইনের অবস্থান, তার মোকাম, মঞ্জেল, ফেরেশতা, রঙ, সিফাত অবগত না হয়ে কিসের ধ্যান হয়? কারণ নাসুত, মলকুত, জবরুত, লাহুত, হাহুত মঞ্জেল গুলোতেই তো বিভিন্ন রঙের পর্দা পাড়ি দিতে হয়, পাঞ্জাতনে পঞ্চরুহর পরিচিতি আসে৷ লাহুতে গেলে ইনসান আত্মদর্শন করতে পারে, তারপরে ফানাফিল্লাহর স্তর পাড়ি দিয়ে আলমে হাহুতে “লা মোকাম/মোকাম ওরাওলওরা””য় বাকাপ্রাপ্তি হয়। তিনি “ফিল আরদে খলিফা” অর্থাৎ “দেহের মধ্যে (নাগরদোলা চক্রের উপরে) প্রতিনিধি রুহুল আজম রূপে মহাবিশ্বে তার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন।