লেখক – মোঃ আলাউদ্দিন ওয়ায়েছি
সর্ব প্রশংসা সেই রাব্বুল আলামিনের যিনি সমগ্র জাহান সৃষ্টি করেছেন, তার প্রদত্ত খিলাফত বাস্তবায়নের মঙ্গলার্থে, সমগ্র সৃষ্টি অধীন করে দিয়েছেন মানবের হীতার্থে। আর হাজারো সালাম ও দরূদ সেই রাহমাতাল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর শানে, যিনি মহান সৃষ্টির মূল উৎস। আরো সালাম ও দরূদ তার আহলে বায়্যেতের শানে।
রাহমাতাল্লিল আলামিন খাতামান নাব্যিয়ান হযরত মোহাম্মদ সা: ইসলামী জীবন ব্যবস্থাপনার যে উন্মেষ ঘটিয়েছেন, ফলশ্রুতিতে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় রাজ্য শাসনের সীমাহীন দর্শন বাস্তবায়িত করে তারই উত্তরসুরী আহলে বায়েত তথা পাক পাঞ্জাতনের প্রধান হযরত আলী আ: কে মাওলাইয়্যাতে অভিষিক্ত করলেন।
আর এটা ও নির্মম সত্য যে, ইসলামী ব্যবস্থাপনার এই মহানায়ক হযরত মোহম্মদ সা: এর ওফাতের সাথে সাথেই তার প্রদত্ত খেলাফত কে তছনছ করে দিয়ে প্রশংসিত তথা খোলাফায়ে রাশেদার আবরনে এক নায়কত্ব রাজতন্ত্রের বীজ আরোপিত হল। অধ্যাত্মিক দর্শনের উৎসধারা পাক পাঞ্জাতনের সমষ্টি আহলে বায়েতকে অন্ধকারের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত করল। আহলে বায়েতের নূরকে চিরতরে মুছে দেয়ার প্রয়াসে ইনডিমিনিটি আদেশজারী করা হল। বিনময়ে আহলে হাদিস নামে সংবিধানে এক নতুন অধ্যায়ের সুচনা করল। তবে সুফি মুসলিম মিল্লাতের সংগ্রামী সাধনায় চিরবর্তমান আহলে বায়েত আজও দিপ্তিমান, আর সৃষ্টির প্রজ্জলিত জ্যোতিরূপে স্ব-স্থানে স্থিত আছে। সৃষ্টির মূল উৎস এই আহলে বায়্যেত এর যৎকিঞ্চিত পরিক্রমা কোরআন ও হাদিস ভিত্তিক উপস্থাপনের জন্যই আমার এই প্রয়াস।
আহল শব্দের অর্থ তাবু। আহলে বায়েত হল তাবুর বাসিন্দা। মূলত আহলে বায়েত বলতে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাইকে বুঝায়। তবে নবী রসুলগণের বেলায় অনেক ক্ষেত্রে এই সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছিল। তবে কর্মদোষে কোন নবীর স্ত্রী আবার কোন নবীর ছেলে আহলে বায়েত হতে বঞ্চিত হয়েছিল। যেমন হযরত নূহ্ (আ:) এর ছেলে কেনান। আর সায়েদুল মোরসালিন, রহমাতাল্লীল আলামিন, হযরত মোহাম্মদ সা: এর আহলে বায়্যেতগণ হলেন আলমে আরোয়া হতেই রাসুল সা: এর প্রতিনিধি যাহা সৃষ্টির ধারক, অর্থাৎ চিরন্তন শ্বাশত অনন্ত সৃষ্টির মূল উৎস। এই আহলে বায়েত ধারণ করে মানুষ মৃত্যুকে জয় করে অমরত্ব লাভ করে থাকে।
হযরত আলী- ফাতেমা-হাসান-হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুম এই চারজন পাক পাঞ্জাতনের প্রজ্জলিত শক্তি। মোহাম্মদ সা: হলেন পঞ্চ নূরের মুল উৎস। আহলে বায়্যেতের ভেদ রমুজাত যারা জানেনা তারা আহলে বায়্যেত কে বুঝে না আর আহলে বায়্যেত ভেদ রহস্য জানেনা তারা ইসলামকে জানেনা। আর আহালে বায়েতের প্রধান হলেন হযরত আলী (রা:)। হযরত আলী (আ.) আমাদের মত একজন মানুষ, ইহাই ইতি বাচক কথা নয়। জেসেমি আলী (আ.) এর ভেদ রহস্য হলো আল্লাহ মনোনীত ইসলাম ধর্ম যেখানে প্রতিষ্ঠিত, হযরত আলী সেখানে স্থিত আছেন। হযরত আলী (আ.) কে হারুন নবীর সাথে তুলনা করে রসুল সা: বলেছেন, “হে আলী তুমি আমার নিকট ঐ স্থানে, যেখানে মুসার (আ:) নিকট হারুন ছিল। কিন্তু আমার পরে নবী নেই, আমিই শেষ নবি।” (বোখারী ২য় খন্ড ১৯৪ পৃ: ৩য় খন্ড ৫২৬ রাবি সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা)।)
রাসুল (সা:) আরো বলেছেন ‘আনা ওয়া আলী উন নূরিন মিন ওয়াহিদ।’ আমি এবং আলী একট নুরের দুই খন্ড। আলী মিন্নি ওয়া আনা মিনাল আলী। আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে, ফাতেমা মিন্নি ওয়া আনা মিনাল ফাতেমা। ফাতেমা আমা হতে এবং আমি ফাতেমা হতে, হাসান মিন্নি ওয়া আনা মিনাল হাসান। হাসান আমা হতে আমি হাসান হতে। হোসাইন মিন্নি ওয়া আনা মিনাল হোসাইন। হোসাইন আমা হতে অমি হোসাইন হতে। (তিরমিজি, মেসকাত শরিফের ১১তম খন্ড)।
পাক অর্থ পবিত্র, পাঞ্জাতন অর্থ পাঁচটি তন বা দেহ। পাক পাঞ্জাতন অর্থ পাঁচটি পবিত্র দেহ। উপরোল্লিখিত নবুয়্যাতি চার জনকে নিয়েই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আয়াতে তাৎহির (৩৩:৩৩) নজুলের মাধ্যমে পবিত্র হতেও পবিত্র ঘোষণা করেছেন। ইন্নামা ইউরিদুল্লাহে লি ইউজ হিবা আন কুমুর রিজছা আহ্লাল বায়্যিতি অ ইউ তাহ্ হিরাকুম তাৎহিরা (আহযাব-৩৩)। আল্লাহ পাকের নাহনুর সদস্য নবুয়্যাতি ছুরত, পাক পাঞ্জাতন, যাদের বেলায়েতি রূপ সমস্ত সৃষ্টি ব্যাপৃত আছে।
আল কোরআনে উপস্থাপিত হয় কুল লা আজ আলূকুম আলাইহে আজরান ইল্লাল মা আদাদাতা ফিল কুরবা ওমাইন ইয়াকতারিফ হাসানাতান নাজিদ লাহু ফিহা হুসনা (সুরা শুআরা-২৩)। অর্থাৎ – আপনি বলে দিন হে রাসুল, আমি চাই না তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান আমার নিকট বর্তীদের ভালোবাসা ব্যতিত। যে ব্যক্তি ইহার সদ্ব্যবহার করে আমি তার শ্রী বৃদ্ধি করিয়া থাকি। আহলে বায়্যেতের প্রতি মহব্বত রাখা প্রতিটি মানবের জন্য ওয়াজিব। তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই আয়াতটি। এই আয়াতটি নাজিলের পর রসুল (স:) কে সাহাবাগণ প্রশ্ন করিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনার নিকটজন কারা? যাদের ভালোবাসা আল্লাহপাক আমাদের জন্য ওয়াজিব করে দিয়েছেন? উত্তরে রাসুল (সা:) বলেছেন, আল্লাহুম্মা হাওলাই আহলে বায়্যেতে আলীয়াঁও ওয়াফাতিমাতাঁও ওয়া হাসানু ওয়াল হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহুম। অর্থাৎ হে আল্লাহ এই আমার আহলে বায়্যেত হলো আলী-ফাতেমা-হাসান-হুসাইন । হে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থেকো। (আব্দুর রহিম গ্রন্থাবলী প্রথম খন্ড)।
১০ম হিজরির ঘটনা। নাজরান প্রদেশের একটি বৃহৎ গীর্জার পাদ্রীদের সাথে রসুল (সা:) এর মোবাহেলা বা বাহাস হয়। উক্ত বাহাসে রোমের বাদশাহের নির্দেশে ৬০ জন খ্রিষ্টান আলেম ও ২৪ জন তাওরাত জবুরের কিতাবের জ্ঞানে পারদর্শী জ্ঞানী ছিলেন। তাহাদের দলনেতা ছিলেন সুলাবিল। রাসুল (সা:) এই সুলাবিলের অযৌক্তিক প্রশ্নাবলী ও যুক্তিহীন ধারনাকে যুক্তিপূর্ণভাবে সমাধান করেন। তদুপুরী রাসুল (সা:) এর সাথে বেয়াদবিমূলক কুতর্কে লিপ্ত হয়। আর এ সময়ে আল্লাহ মহান মুবাহিলা আয়াত নাযিল করেন। ফামান হাজ্জাকা ফিহে মিমবাদে মাজাআকা মিনাল ইলমে ফাকুল তাআলাও নাদউ আবনা আনা ওয়া আবনা আকুম ওয়ানিছা আনা ওয়া নিছা আকুম ওয়া আনফুসানা ওয়া আনফুসাকুম নাব তাহেল ফানাজ জাআল লা না তাল্লাহে আলাল কাজেবিন। ইমরান-৬১। অর্থ – অতপর জ্ঞান থেকে তোমার নিকট যা এসেছে তার পরেও সে বিষয়েও তোমার সাথে কুতর্ক করে তবে তুমি বল এসো আমরা আমাদের সন্তানগণকে ও তোমাদের সন্তানগণকে আর আমাদের রমনীগণকে ও তোমাদের রমনীগণকে এবং আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে ডাকি। তৎপর আল্লার কাছে প্রার্থনা করি যেনো মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হয়। (৩:৬১)।
এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসুল (সা:) হযরত হুসাইন কে বামে হাসানকে ডানে এবং আলীকে পিছনে ও সবার পিছনে ফাতিমাতুজোহরাকে নিয়ে মুবাহিলায় হাজির হলেন। আর বললেন আমি যখন মুনাজাত করবো তখন তোমরা আমিন! আমিন! বলবেন। পাদরীদের দলনেতা সুলাবিল দেখলেন মোহাম্মদ (সা:) ও আহলে বায়্যেতগণের উপর ধীরে ধীরে নূর বিকশিত হচ্ছে। আর তখনি সুলাবিল চিৎকার করে বললেন, সাবধান! তোমরা কেউ এই পাঁচজনের মোকাবেলায় বের হবে না। যারা বের হবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। শুনে রেখো, এই ৫জন যদি পাহারের উপর পাহাড় তোলার প্রার্থনা করে তবে তাহাই কবুল হবে। এই ৫ জনের মধ্যে হযরত হুসাইন আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর বিকশিত নূর তাযাল্লীর স্রোত দেখে সুলাবিল স্বীকার করলেন যে রসুল (সা:) এর নব্যুয়াতি সত্য। (মেশকাত শরীফের বাবে আহলে বায়্যেত অধ্যায় রাবি হযরত সাদ ইবনে ওয়াক্কাস (রা.))। হযরত জাবের (রা.) বলেন আনফুসানা বলতে রসুল (সা:) ও মাওলা আলীকে বুঝানো হয়েছে। ওয়ানিছানা বলতে হযরত ফাতেমাতুজজোহরাকে ওয়া আবনা আনা শব্দদ্বারা ঈমাম হাসান ও হুসাইনকে বুঝানো হয়েছে।
হিজরী ১০ম সাল নবীকরিম (সা:) ইচ্ছা প্রকাশ করলেন হজ্বব্রত পালন করবেন। এটাই হবে শেষ ও বিদায় হজ্ব । এই ধারনা পোষনান্তে তিনি সর্বত্র প্রচার করে দিতে নির্দেশ দিলেন যে মুসলিম যেখানেই থাকুক হজ্ব পালনে ইচ্ছুক সবাই যেন আরাফায় সমবেত হয় আর হলো ও তাই। আনুমানিক সোয়া লক্ষ হাজীদের সমাবেশ ঘটে ছিল। বিশাল জনসভায় রাসুল (সা:) মুসলিম জনতার উদ্দেশ্যে এক ভাষন দিলেন। এই নছিহত পূর্ণ ভাষণকে বিদায় ভাষণ বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। ভাষনান্তে হজ্ব সমাপন করিয়া রসুল (সা:) এহরাম বাধা অবস্থায় লক্ষাধিক সাহাবিদের নিয়ে মদিনার পথে রওনা হলেন। সেদিন ছিল ১৮ই জিলহজ্জ। দিনটি ছিল শনিবার। যোহর ও আছরের মধ্যেবর্তী সময়ে মক্কা মদিনার মধ্যেবর্তী জুফায় গাদীরে খুম নামক স্থানে পৌঁছলেন। তখনই রসুল (সা:) এর কাছে জিবরাঈল (আ:) ওহীর বার্তা নিয়া আসেন। জানালেন “ইয়া আইয়্যুহার রাসুল বাললিগ মা উনযিলা উলাইকা মিররাব্বিকা ওয়া ইল্লাম আফআল ফামা বাল্লাগতা রিসালাতাহু, ওয়াল্লাম ইয়াছিমুকা মিনান নাছি, ইন্নাল্লাহা লা ইয়াহদিল কাওমাল কাফিরিন।” মায়েদা-৬৭ ।অর্থ হে রাসুল, আপনার রব হতে যা নাযিল হয়েছে তা পৌঁছে দিন। আর যদি তা না করেন তবে আল্লাহর রিসালাত পৌঁছে দেয়া হলো না। আল্লাহ আপনাকে মানব মন্ডলী হতে নিয়া আসবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদের হেদায়েত করেন না।