পত্রিকা – আহলে বাইয়্যেত বনাম খিলাফত, রাজতন্ত্র ০২

লেখক – মো. আলাউদ্দিন ওয়ায়েসী

খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী সাহেব তাঁর বেহুঁশের চৈতন্যদান কেতাবের ১৬৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করিয়াছেন “আর যদি না করেন তবে রেসালত পৌঁছে দেয়া হলো না।” কথাটি দ্বারা রসুল (সা:) কে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব পৌঁছে দেয়ার হুকুম করলেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এই প্রতিনিধিত্ব কার কাছে পৌঁছানোর হুকুম করলেন। যার কাছে পৌঁছানোর হুকুম হলো তিনি হলেন মাওলা আলী (আ:)। কারণ মোল্লা জালাল উদ্দিন সিউতির তাফসিরে দূররে মনসুর এর দ্বিতীয় খন্ডের সূত্রে, সদরউদ্দিন চিশতী সাহেব তার মাওলার অভিষেক গ্রন্থের ১৩ পৃষ্টায় উল্লেখ করেছেন, ইবনে আবি হাতিম বর্ণনা করেছেন, আবু সাঈদ খুদরী হতে উক্ত আয়াত হযরত আলীর সানে নাযিল হয়েছিল। ইবনে আবু মারদুইয়া ইবনে ওমর হতে বর্ণনা করেন যে, আমরা উক্ত আয়াতটি রসুল (সা:) সামনে এভাবে পড়তাম।” ইয়া আইয়্যুহার রসুল বাল্লেগমা উনজিলা ইলাইকা মির রাব্বিকা। আন্না আলিউন মাওলাল মোমেনিন। ওয়া ইল্লাম তাফআল ফামাবাল্লাগতাহ রিসালাতাহু। ওয়াল্লাহু ইয়াসিমুকা মিনান নাছু। উক্ত আয়াত হতে “আন্না আলিউন মাওলাল মোমেনিন”। কথাটি খলিফা হযরত উসমান (রা.) প্রকাশনীর সময় বাদ দেওয়া হয়েছে।

টানা ২৩ বছর ইসলাম প্রচারে হাজারো দুশমন প্রাণনাশের চেষ্টায় ব্যর্থ হলো। ইসলাম প্রচারে জীবনে ১৭টি যুদ্ধে নিজে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সমস্ত শত্রু পরাস্থ হয়ে সমগ্র আরব বিশ্ব ইসলামে পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। তা হলে প্রচারের বাকী রইল কি? আর শত্রুই বা কাহারা? যাদের কবল থেকে আল্লাহ রক্ষা করবেন এবং কাফেরদের হেদায়েত করবেন না বলে নিশ্চয়তা দিলেন? আল্লাহ মহানের এই পরিপূর্ণ বাণীর প্রেক্ষিতে রসুল (সা:) স্বীয় উটের পৃষ্ঠ হতে নেমে পড়লেন। সামনে পিছনে সবাইকে একস্থানে জড়ো হতে নির্দেশ দিলেন। যোহরের নামাজ আদায় শেষে উটের বেদিগুলো দিয়ে একটি মঞ্চ তৈরী করালেন। রসুল (সা:) মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করলেন। তারপর বললেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দুটি আমানত রেখে যাচ্ছি, যদি এ দুটিকে তোমরা আকড়িয়ে ধর তাহলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আল কোরআন, যা আসমান হতে জমীন পর্যন্ত টানা রশি এবং অন্যটি হলো আমার আহলে বাইয়্যেত। এদুটি কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না যতক্ষণ না হাউজে কাউসারে আমার সাথে মিলিত হইবে। তাই লক্ষ্য রেখো তাদের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ করবে। তিরমিযি সূত্রে মেশকাতে হাদিস নং ৫৮৯২ ও ৫৮৯৩ সূত্রে বর্ণিত আছে যে, আমি আমার আহলে বায়্যিত সম্পর্কে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।

অতপর রসুল (সা:) হযরত আলী (আ:) এর দুই হাত উপস্থিত জনতার সামনে তুলে ধরে ঘোষণা দিলেন, মান কুন্তুম মাওলাহু ফাহায আলীউন মাওলাহু আল্লাহুমা ওয়ালেমান ওয়ালাহু আদামান আদাহু, আনশুরমান নেছারা, ওয়াখজুল মান খাজালা, ফাল ইয়াস হাদিল হাজেরান খায়েরা। অর্থা আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা, হে আল্লাহ তুমি তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর, যে তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তাকে শত্রুরূপে গ্রহণ কর যে তাকে শত্রুরূপে গ্রহণ করে, সাহায্য কর তাকে যে তাকে সাহায্য করে এবং লাঞ্ছনা দাও তাকে যে লাঞ্ছনা দেয়। মেশকাত পৃ:-১৫৭, হাদিস নং-৫৮৪৪।

হযরত বারা ইবনে আয়েব ও জায়েদ ইবনে আরকাম আরও বলেন যে, এর পর যখন হযরত আলী (আ:) এর সাথে হযরত ওমর (রা.) এর সাক্ষাত হয় তখন হযরত আলী (আ:) কে বললেন ধন্যবাদ হে আবু তোরাব তুমি সকাল সন্ধ্যা প্রতিটি মোমিন নর নারীর প্রশংসিত হয়ে রইলেন। হযরত ওমর (রা.) এই আফছোছ ভরা উদ্বেগ জনক কথাটিতে ভবিষ্যতে এক অশুভ বীজ নিহিত ছিল। আর হয়েছিল ও তাই। নবী (সা.) এর ওফাতের পর রসুলের নির্দেশকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। এমনকি ইনডিমিনিটি আদেশের ন্যায় এই হাদিসটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বিপরীতে রোমঞ্চকর ও ভাবপ্রবণ কিসসা তৈরী করে সত্যকে ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। লুটের মাল বন্টনের আখড়ায় গঠিত খিলাফতের ধ্বংশের সূত্রপাত করেছিল পরবর্তীতে মুনাফিক মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদের পোষা মোল্লারা মূলভাবটি জগত হতে মুছে ফেলার যথেষ্ট তদবীর চেষ্টা করেছে। আর এখানো করিতেছে তবে রাখে আল্লাহ মারে কে?

আল কুরআনে উপস্থাপিত হয় – আন নাব্যিও আওলা বিল মুহমিনিনা মিন আনফুছিহিম (আহাযাব -৬)। অর্থাৎ – নবী মোমেনদের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষা অধিক প্রিয়। অত্র আয়াতের মমার্থে দেখা যায় রসুল (সা:) মহব্বত অনুসরণ তার প্রতি ইয়াকিন সহ বায়্যিত সবই আল্লাহ তার নিজের প্রতি ওয়াজেব করে দিয়েছেন। মূলত দাসত্ব আনুগত্য কেবলমাত্র রাসুল (সা:) এর প্রতি হতে হবে। রসুল (সা:) সৃষ্টির উছিলা, সৃষ্টি জগতের করুণা, রসুল (সা:) এর উছিলায় আল্লাহ দান করেন। আবার দান গ্রহণ করেন। সেই রসুল (সা:) বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী (আ.) তার দরজা। সেই দরজায় দর্শন হয় ইলমে লাদুন্নী আর হযরত আলীই রসুল (সা:) কে দেখেছেন। রসুল (সা:) বলেছেন ও তাই, মারাআনী আহাদুন ইল্লা ইবনে তালিব। আলী ছাড়া আমাকে কেউ দেখেনি।

মুলত যারা আলী (আ:) কে দেখেছে তারা রসুল (সা:) কে চিনেছে এবং ইলমে লাদুন্নীর অংশীদার হয়েছেন। কেননা হযরত আলী (আ:) নবীর ওয়ারিশ। আলী (আ:) কে যারা চিনেছে তারাই ওয়ারিছিতুল আম্বিয়া। হযরত আলী (আ:) ও রসুল (সা:) একই নূরের দু খন্ড। নবী এবং তার আহলে বায়্যিত একই সুত্রে গ্রথিত। সৃষ্টির মাঝে হযরত আলী (আ:) নাতেক কুরআনের অমিয় ধারা। শিরক ও বিদআত রক্ষাকারী আলী (আ:) হলেন আল্লাহ ও রসুল (সা:) এর গোপন রহস্যের ভান্ডার। হাকিকি, মালাকি, ও নবুয়্যতি ত্রিজগতে হযরত আলী (আ:) তিন নামে বিরাজিত আছেন এবং থাকবেন ও তাই। বিধায় রসুল (সা:) তার প্রকৃত ওয়ারিশ হযরত আলী (আ:) কে গাদিরে খুমে মাওলাইতে অভিষিক্ত করিলেন।

প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তায়ালার রিসালত বাস্তবায়ন হলো। দয়াময় আল্লাহ নাযিল করলেন কুরআনের শেষ আয়াত। “আল ইয়াওমা ইয়া ইসাল্লাযিনা কাফারু মিন দ্বিনীকুম ফালাতাখ শাওহুম ওয়াখ শাওনি, আল ইয়ামা আখমালতু লাকুম দ্বিনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নিয়ামাতি ওয়া রাদ্বিতু লাকুমুল ইসলামা দ্বিনা। (মায়েদা-৩) অর্থ – আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বিন হতে নিরাশ হয়েগিয়েছে অতএব তাদেরকে আর ভয় করিও না। ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ দান করলাম এবং তোমাদের ধর্ম ইসলামের উপর আমি সন্তুষ্ট হইলাম।

চিরন্তন শাশ্বত আহলে বায়্যিতে ভেদ রহস্য যদি মানব মন্ডলীর কাছে উন্মোচিত না হলো, তবে সদ্যঘোষিত পরিপূর্ণ ইসলামের বাস্তবায়নে ঘোর তমশা নেমে আসতে পারে। কারণ, আদি সৃষ্টির এই পবিত্র পাঞ্জাতন এর চারতন যে, জেসেমি হযরত আলী (আ.)-ফাতেমা-হাসান-হুসাইন (আ.) তাহার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত রাখার প্রয়াসে হযরত আলী (আ.) কে বাশারীয়াত জিন্দীগিতে খলিফা নিযুুক্তি ছিল রসুল (সা:) এর প্রধান দায়িত্ব। তাই হযরত আলী (আ.) খলিফা নিযুক্ত করে আপন কর্তব্য সম্পাদনের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রসুল (সা:) বললেন “আল্লাহু আকবার আলহামদু লিল্লাহ আলা আকমালে দ্বিনা ওয়াএতমামেন নিয়ামাতিন ওয়া রুয়ে রাব্বি আলা রিসালাতি ওয়া বেলায়েতে আলী ইবনে আবু তালিব। অর্থাৎ আল্লাহ মহান দ্বিনকে কামেল করে দেওয়ার উপর এবং নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দেয়ার উপর সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। আর রেসালাতের উপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং আবু তালিবের পুত্র আলীর বেলায়েতের জন্য সকল প্রশংসা আল্লাহর। (বেহুসের চৈতন্যদান পৃ-১৭৪-১৭৫)।

রাসুল করিম (সা:) যাহা কিছু করেন তাহা আল্লাহ মহানের ইচ্ছাতেই হয়। আর হযরত আলী (আ.) এর খিলাফত দান মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছিল। সৃষ্টির আদিতে হযরত আদম (আ.) কে আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন যে খিলাফত দিয়ে ছিলেন, যুগে যুগে নবী রসুলগণ যে খিলাফত এ অভিষিক্ত হযরত আলী (আ.) এর এই খিলাফত ছিল তারই ধারাবাহিকতার ফসল। এই খিলাফত ছিল রিসালত বাস্তবায়নের খিলাফত। রাসুল (সা:) এর শরীয়তের আবরণে হকিকতের খিলাফত।

এই খিলাফত জাগতিক জগতের রাজনৈতিক খিলাফত ছিল না। ভোগ লালসায় লালায়িত উমাইয়া ও আব্বাসিয়া বংশের কিছু কিছু জিঘাংশু লোকেরা আধ্যাত্বিক এই খিলাফতের ভেদ রহস্য বুঝতে না পেরে, তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াসে আধ্যাত্বিক খিলাফতকে রাজনৈতিক খিলাফতের আবরনের জড়িয়ে স্বঘোষিত রাজা বনে গেলেন। আর মিহি সুরের ধ্বনী তুলে প্রচার করতে লাগলেন যে মশহুর সাহাবাদের সম্মিলিত সমর্থনের ফসল খোলাফায়ে রাশেদা। আদৌ কি তাই? তাই যদি হয় তবে প্রজ্ঞাময় আল্লাহ কেন বললেন “ইন্না আনজালনা ইলাইকাল কিত্বাবা বিল হাক্কে লিতাহকুমা বাইনান নাছি বিমা আরাকাল্লাহ (আন নিছা-১০৫)। অর্থ নাযিল করিয়াছি তোমার কাছে সত্য সহ কিতাব আল্লাহ যে জ্ঞান দান করিয়াছেন যেন সেরূপ তুমি লোকদের বিচার মিমাংসা করিয়া দাও। ওয়ালাতাকুলু লিল খায়েনি মা খাছিমাও। খেয়ানতকারী পক্ষ পাতিত্ব করিও না। রসুল (সা:) তার আমানত সঠিকভাবে সঠিক স্থানে অর্পন করেছেন খেয়ানত করেন নি।

আপন খবর