লেখক – মোস্তাক আহমাদ
হযরত গাউসে পাক (রা.) ৫২১ হিজরীতে ৫০ বছর বয়সক্রমে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রূহানি নির্দেশে বিবাহিত জীবনে প্রবেশের পরপরই সে বৎসরই তিনি ওয়াজ নসিহত ও হেদায়াতের কাজের জন্য নির্দেশিত হোন। রাসুল করিম (সা.) ঐ বৎসর ১৬ই শাওয়াল রাত্রে স্বপ্নে হযরত গাউসে পাককে ওয়াজ নসিহত করার নির্দেশ দেন। হযরত গাউসে পাক পারস্যবাসী বলে আরবী উচ্চারণে আরবদের সমকক্ষ ছিলেন না বলে জানালে নবী করিম (সা.) স্বপ্নে সামান্য থুথু মোবারক তাঁর জিহ্বায় ঢেলে দেন। এই থুথু মোবারকের বরকতে গাউসে পাকের জবান খুলে যায় এবং তিনি বেলায়াতের গুপ্তদ্বারের সন্ধান লাভ করেন। পরদিন থেকে তিনি ওয়াজ নসিহত শুরু করেন।
তাঁর ভাষার লালিত্বে, বাচনভঙ্গিতে এবং ভাবের গভীরতায় ওয়াজ মজলিশে দুচারজন করে লোক বেঁহুশ হয়ে মারা যেত। হুজুর (সা.)-এর বেলায়াত জ্ঞান দানের বরকতে তাঁর ওয়াজ মজলিশে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হতো। প্রায় চারশত পন্ডিত ব্যক্তি তাঁর ওয়াজ লিখে রাখতেন। এভাবে জগতময় গাউসে পাকের নাম ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তাঁর একটি কারামত প্রকাশ হয়ে পড়ে। মজলিশের সবচেয়ে পিছনের লোকটিও সামনের লোকের মত সমান আওয়াজে গাউসে পাকের ওয়াজ শুনতেন। এমনকি বাগদাদ থেকে ৫০০ কি. মি. দূরের শহর মোসেলে বসেও অনেক লোক বাগদাদ শরিফে গাউসে পাকের প্রদত্ত ওয়াজ শুনতেন। বর্তমান যুগে ইথারের তরঙ্গের মাধ্যমে মানুষের মুখের কথা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ছে। ঐ যুগে গাউসে পাকের বাণী বহন করে নিয়ে যেতো ইথারের তরঙ্গরাজী। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহপাকই আপন অলীদেরকে এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করে থাকেন। ইহা গাউসে পাকের খাস কারামত।
এ প্রসঙ্গে মোসেল নিবাসী বিখ্যাত পীর ও গাউসে পাকের মুরিদ হযরত আদি বিন মুসাফির (র.)-এর একটি ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। আদি বিন মুসাফির (র.) বাগদাদ শরিফে হযরত গাউসে পাকের ওয়াজ মজলিশে সবসময় উপস্থিত থাকতেন এবং ওয়াজ শুনতেন। গাউসে পাক শুক্র, শনি ও রবি এই তিনদিন তিন জায়গায় ওয়াজ করতেন। একদিন আদি বিন মুসাফির (র.) আরজ করলেন― ‘ইয়া গাউসে পাক! আমার মন আপনাকে ছেড়ে যেতে চায় না। তবুও দেশে যেতে হয় কিন্তু দুর্ভাগ্য, আপনার এই মূল্যবান ওয়াজ থেকে আমি বঞ্চিত হবো।’ গাউসে পাক (রা.) বললেন― ‘তুমি আমার ওয়াজের নির্ধারিত সময়ে মোসেল বাসীদের নিয়ে কোন পাহাড়ের পাদদেশে একটি বৃত্ত এঁকে তার মধ্যে সকলকে নিয়ে বসে যাবে। ইনশাআল্লাহ তোমরা সকলেই সেখানে বসে আমার ওয়াজ নসিহত শুনতে পাবে।’
উপদেশ মোতাবেক আদি বিন মুসাফির (র.) তাই করলেন। তিনি বলেন― ‘আমাদের মনে হতো যেন আমাদের মাথার ওপরে মেঘের মিনারে বসে হযরত গাউসে পাক বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর আমরা শুনছি।’ এখানে দেখা যায়, বার্তা প্রেরক একজন অলী এবং বার্তা ধারকও আর একজন অলী। আর বার্তাবাহক হচ্ছেন আল্লাহর ইথার তরঙ্গ। আল্লাহ আপন প্রিয় ও মাহবুব বান্দার খেদমতে এমনিভাবেই তার সৃষ্টিজগতকে বশীভূত করে দেন। হযরত শেখ সাদীর একটি বায়েতের অনুবাদ খুবই হৃদয়গ্রাহী―
এক সিজদা কর যদি মহা প্রভুর দ্বারে,
নত হবে শত শীর তব পদতলে।
তিনি কাছিদা গাউছিয়ায় বলেন― ‘ওয়া ওয়াল্লানী আলাল আক্তাবে জাম্আন, ফা-হুক্মী নাফিজুন ফি কুল্লি হালী’ অর্থাৎ ‘আল্লাহপাক আমাকে সকল কুতুবের ওপর কর্তৃত্ব দান করেছেন। আমার আদেশ সর্বাবস্থায়ই কার্যকর থাকবে।’ মূলকথা হলো : হযরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রা.) সর্বযুগের শ্রেষ্ঠতম অলী এবং সকল অলীদের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব বহাল থাকবে। হযরত গাউসুল আ’জম (রা.)-কে মহিউদ্দীন মুহাম্মদ বিন-নাজজার তাঁর ইতিহাসে যুগের শ্রেষ্ঠতম ইমাম বলে উল্লেখ করে বলেছেন― ‘ফিকহ ও হাদিসে গাউসে পাকের জ্ঞান ছিল অসাধারণ। তিনি নির্জন স্থানে পড়াশুনা করতে ভালবাসতেন। অধিকাংশ সময় তাইগ্রীস (দজলা) নদীর তীরে, বনে জঙ্গলে, কখনও বা নির্জন প্রান্তরে বসে বসে তিনি ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন। তিনি বেলায়েতের শাহানশাহ হযরত মাওলা আলী মুর্তজা (ক.) থেকে বেলায়েতের গুপ্তজ্ঞানের ভান্ডার থেকে সকল প্রকার জ্ঞানের অমৃতসুধা পান করে গাউসে পাকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
আল্লাহর মহান অলীদের কারামত নবীগণের মোজেজার ন্যায় সত্য ও আল্লাহ কর্তৃক বিশেষ কুদরতের সাক্ষরস্বরূপ। নবীদের ক্ষেত্রে যা মোজেজা অলীদের ক্ষেত্রে তা কারামত। গাউসে পাকের কারামত বেলায়াতের উচ্চতর মাকামের পরিচায়ক ও অলীদের গুপ্তজ্ঞানের ভেদরহস্যের উজ্জল সাক্ষর বহনকারী। সমস্ত অলীগণের গুপ্তজ্ঞানের বিকাশস্থল হলেন গাউসে পাক (রা.)। আর গাউসে পাকসহ সকল কুতুবগণের গুপ্তজ্ঞান ও বেলায়াতের কেন্দ্রবিন্দু হল শেরে খোদা মাওলা আলী মুরতাজা মুশকিল কুশা (ক. ওয়াজহাহু)।
মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর মক্কা শরিফের অদূরে নোমান পাহাড়ের পাদদেশে, মতান্তরে বেহেস্তে তাঁর পৃষ্ঠদেশ হতে কেয়ামত পর্যন্ত আগমনশীল সমস্ত সন্তানগণের রূহকে মর্তবা অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণিতে দলবদ্ধভাবে দাঁড় করালেন। আম্বিয়ায়ে কেরামের শ্রেণি, আউলিয়ায়ে কেরামের শ্রেণি, ওলামায়ে কেরামের শ্রেণি, সাধারণ মুমিনগণের শ্রেণি ও কাফেরদের শ্রেণি পৃথক পৃথকভাবে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলো। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর একত্ববাদ স¤পর্কে সকলকে জিজ্ঞাসা করলেন― ‘আলাস্তু বিরাব্বিকুম’ আমি কি তোমাদের রব নই? তদুত্তরে সকলে একের পর এক বলতে লাগলো― ‘কালু বালা’― ‘হ্যাঁ’; ‘আপনি আমাদের প্রভু।’ এই অঙ্গীকারকে রোজে আজলের অঙ্গীকার বলা হয়।
হযরত আদম (আ.) অবাক বিস্ময়ে আরজ করলেন― ‘হে আল্লাহ! এরা কারা?’ মহান আল্লাহপাক বললেন― ‘এরা তোমার আওলাদ।’ হযরত আদম (আ.) লক্ষ করলেন― আউলিয়ায়ে কেরামের সারি হতে একজন লোক আম্বিয়ায়ে কেরামের দলে শামিল হওয়ার জন্য অগ্রসর হতে চায়, আর ফেরেস্তারা বার বার তাঁকে আউলিয়ায়ে কেরামের দলে ধরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু ধরে রাখতে পারছিলেন না। অবশেষে গায়েবী আওয়াজ হলো― ‘হে মুহিউদ্দীন! স্থির হও। তোমার মধ্যে নবীগণের দলভুক্ত হওয়ার মত যোগ্যতা আছে বটে। কিন্তু তোমাকে সর্বশেষ নবীর উম্মত করেই প্রেরণ করা হবে। তবে জেনে রেখো, তোমাকে আউলিয়াকূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হবে। তোমার পদযুগল আউলিয়াগণের কাঁধের ওপর হবে। অতঃপর তিনি শান্ত হয়ে আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করলেন।’ ―সূত্র : হযরত গাউসুল আজম : মাওলানা নূরুর রহমান
এমন আলেমে হক্কানী রাব্বানী ও আউলিয়ায়ে কেরাম সম্পর্কেই হুজুর আকরাম (সা.) এরশাদ করেছেন― ‘উলামায়ু উম্মাতি কাআন্নাবিয়্যি বানি ইসরাঈল’ অর্থাৎ ‘আমার উম্মতের জাহেরি-বাতেনি ওলামাগণ জ্ঞান ও ধ্যানের ক্ষেত্রে বণী ইসরাইলের নবীগণের ন্যায়।’ ―সূত্র : তাফসীরে নাঈমী- মুফতী আহমদ ইয়ার খান
প্রকাশ থাকে যে, নবী করিম (সা.) যেদিন মেরাজে গমন করেন, সেদিন হযরত জিবরাঈল (আ.), মিকাঈল (আ.) ও ইসরাফিল (আ.) ৭০ হাজার ফেরেস্তাসহ বোরাক নিয়ে মক্কা মোয়াজ্জমায় বিবি উম্মে হানির ঘরের সামনে হাজির হয়ে নবী করিম (সা.)-কে উর্ধ্বজগতে ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত করে বোরাকে আরোহণের অনুরোধ করেন। কিন্তু বোরাক একটু নাজ ও নখ্রা করে দুলছিল। নবী করিম (সা.) আরোহণ করতে একটু অসুবিধা বোধ করছিলেন। এমন সময় হযরত গাউসুল আজমের রূহ মোবারক সুরত ধারণ করে নিজের কাঁধ পেতে দিলেন। নবী করিম (সা.) তাঁর কাঁধে পা রেখে বোরাকে সওয়ার হয়ে বললেন― ‘যেভাবে এখন আমি আমার পা তোমার কাঁধের ওপর স্থাপন করলাম, সেভাবে আমার উম্মতের অলীগণের কাঁধের ওপরও তোমার পা স্থান পাবে।’
―সূত্র : গাউসুল আজমের জীবনী ও কারামত : মাওলানা নূরুর রহমান।
হযরত গাউসুল আজম তো নবী পাকের আহলে বায়েত। সুতরাং নবী পাকের সাথে তাঁর স¤পর্ক খুবই ঘনিষ্ট― রূহানী ও জিসমানী উভয় দিক থেকে। গাউসে পাকের বেলায়াতের জ্ঞান ও ভেদরহস্য শেরে খোদা মাওলা আলী মুশকিল কুশা (ক. ওয়াজহাহু) জ্ঞানরাজ্যের গুপ্তভান্ডার থেকে উৎসারিত। কাশ্ফের মাধ্যমে অবগত বিষয়কে অস্বীকার করা যায় না। এ ঘটনাটি বেলায়াতের জ্ঞানবৃক্ষের সবুজ পাতা থেকে মুক্তার দানা ছড়িয়ে গাউসে পাকের রূহানী জগতকে আন্দোলিত করেছে। যে জগতের বিস্তৃতি ব্যাপক ও অসীম খোদা তালার জ্ঞানরাজ্যের সামান্য নিদর্শনমাত্র।
মাওলানা নূরুর রহমান তাঁর সংকলিত গাউসুল আজম বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী গ্রন্থে লিখেছেন― ‘হযরত গাউসে পাক স্বয়ং বলেন, মিরাজ শরিফের রাত্রে যখন হুজুর (সা.) সিদরাতুল মুন্তাহা নামক স্থানে তশরীফ নিলেন, তখন হযরত জিবরাঈল (আ.) থেমে গেলেন এবং বললেন― ‘আমি যদি আর এক কেশাগ্র পরিমাণ অগ্রসর হই, তাহলে আল্লাহর নূরের তাজাল্লীতে আমার নূরের পাখা জ্বলে যাবে।’ তখন আল্লাহ তায়ালা আমার (আবদুল কাদের) রূহকে হুজুরে আকরাম (সা.)-এর দরবারে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং আমি হুজুরের কদমবুচী করার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। হুজুর (সা.) আমাকে বললেন― ‘হে প্রিয় বৎস! আজ আমার কদম তোমার কাঁধের ওপর, তোমার কদমও সমস্ত আউলিয়া দের কাঁদের ওপর হবে।’