লেখক – মোস্তাক আহমাদ
কোন কোন মাশায়েখ আরও রেওয়ায়াত করেছেন যে, মিরাজ শরিফ এ যখন নবী করিম (সা.) আরশ মোয়াল্লায় গমন করলেন, তখন আরশকে উচু দেখতে পেলেন। কিভাবে আরশে আরোহণ করবেন, সে বিষয়ে তিনি চিন্তা করলেন। এমন সময় এক নূরানী যুবক সামনে এসে কাঁধ পেতে দিলেন। হুজুর (সা.) তাঁর কাঁধে পা মোবারক রেখে আরশে আরোহণ করলেন। এমন সময় গায়েবী আওয়াজ ভেসে আসলো― ‘হে হাবীব! ইনি আপনার বংশের সন্তান। তাঁর নাম হবে মুহিউদ্দীন আবদুল কাদের।’ নবী করিম (সা.) এবারও খুশী হয়ে বললেন― ‘আমার কদম তোমার কাঁধে, তোমার কদম অলীদের কাঁধে হবে।’ উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলো বেলায়াতের উচ্চতর মাকামের অন্তর্ভুক্ত কাশ্ফের দ্বারা উদ্ঘাটিত।
হযরত গাউসুল আজমের আম্মাজান সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (র.) বলেন― ‘যেদিন আমার সন্তান ভূমিষ্ট হয়, সেদিন আমার স্বামী সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী স্বপ্নে দেখেন, নবী করিম (সা.) প্রধান সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে আমাদের ঘরে তশরীফ আনলেন এবং আমার স্বামীকে বললেন― ‘ইয়া আবু সালেহ্ আ’তাকল্লাাহু ইব্নান ছলিহান ওয়াহুয়া ওয়ালাদী ওয়া মাহ্বুবি ওয়া মাহ্বুবুল্লাহি সুব্হানাহু ওয়াতা‘আলা ওয়া সাইয়াকুনু লাহু শানুন ফীল আউলিয়ায়ি ওয়াল আক্তাবি কাশানি বাইনাল আন্বিয়ায়ি ওয়ার রাসুলি।’
অর্থাৎ ‘হে আবু সালেহ! আল্লাহপাক তোমাকে একজন নেক্কার ছেলে সন্তান দান করেছেন। সে আমার বংশধর, আমার প্রিয় এবং আল্লাহ সুবহানাহুরও প্রিয়। সে শীঘ্রই আউলিয়া ও কুতুবগণের মধ্যে এমন মর্যাদা লাভ করবেন, যেমন আম্বিয়া ও রাসুলগণের মধ্যে আমার মর্যাদা।’―সূত্র : গাউসুল আজম : মাওলানা নূরুর রহমান
হযরত বড়পীর (রা.) মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অলৌকিক ক্ষমতাবলে ব্যাঘ্ররূপ ধারণ করে এক ভন্ড ফকিরকে হত্যা করে মায়ের আবরু রক্ষা করেছিলেন। সে ঘটনাটি ছিল এরূপ―
একদিন এক ভিক্ষুক ভিক্ষার উদ্দেশ্যে হযরত সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (র.)-এর বাড়িতে এসে ভিক্ষা চাইতে লাগলো। ঘটনাক্রমে সেদিন বাড়িতে পুরুষ লোক কেউ ছিলেন না। ভিক্ষুক ক্ষুধার তাড়নায় কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। পুণ্যবতী সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (র.) দয়া পরবশ হয়ে পর্দার আড়াল থেকে কিছু খানা ভিক্ষুককে বাড়িয়ে দিলেন। খানা খেয়ে ভিক্ষুক খালী বাড়ি দেখে অন্দর মহলে প্রবেশ করতে উদ্যত হলো। সৈয়দা উম্মুল খায়ের দিশেহারা হয়ে ভিক্ষুকের হাত থেকে বাঁচবার জন্য খোদার কাছে ফরিয়াদ করতে লাগলেন। আল্লাহর কুদরতে জননীর এই চরম বিপদের সময় হযরত আবদুল কাদের জিলানীর রূহ মোবারক মাতৃগর্ভ হতে বের হয়ে একটি বাঘের রূপ ধারণ করে মুহূর্তের মধ্যে ভিক্ষুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাকে হত্যা করে পুনরায় মাতৃগর্ভে প্রবেশ করলেন। জননী কিছু টের করতে পারলেন না। তিনি শুধু এতটুকুই দেখতে পেলেন যে, কোথা হতে একটি বাঘ এসে ভিক্ষুককে হত্যা করে আবার কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
পরবর্তীতে কোন এক সময় গাউসুল আজমের আম্মাজান কোন কারণে একটু রাগ করে বলেছিলেন, ‘আবদুল কাদের! তোমার জন্য তোমার শিশুকালে কত কষ্ট করেছি― মনে আছে কি? এটা ছিল সন্তানের প্রতি মায়ের আদরের শাসন।’ হযরত বড়পীর সাহেবও বলে ফেললেন― ‘আমিও তো গর্ভকালীন সময়ে আপনার একটি উপকার করেছিলাম। সে কথা কি আপনার মনে নেই?’ এ কথা শুনে মাতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন― ‘সেটা কি?’ হযরত বড়পীর সাহেব (রা.) বললেন― ‘ভিক্ষুককে যে বাঘটি হত্যা করে আপনার আবরু রক্ষা করেছিল, সে তো আমিই ছিলাম।’ একথা শুনে সৈয়দা উম্মুল খায়ের অবাক বিস্ময়ে মনে মনে ভাবলেন― ‘আমার এ সন্তান কোন সাধারণ সন্তান নন সে কালে আল্লাহর পরম বন্ধুরূপে গণ্য হবে।’ এরপর থেকে তিনি আর কোন দিন পুত্রের প্রতি বিরক্ত হননি।―সূত্র : মানাক্বেবে গাউসিয়া
হযরত গাউসুল আজমের জন্ম ছিল আধ্যাত্মিক ও রূহানী জগতে মুসলিম মিল্লাতের নবজাগরণ স্বরূপ। মুসলমানগণ যখন নানা ভ্রান্ত আক্বিদা ও মতবাদে জর্জরিত সেই ক্রান্তিকালে তৎকালীন পারস্য, বর্তমান কালের ইরাক দেশের অন্তর্গত জিলান বা গীলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন হাসান বংশীয় এবং মাতা হোসাইন বংশীয়। উভয় দিক থেকে তিনি সৈয়দ ও আওলাদে রাসুল (সা.)। নবী করিম (সা.)-এর পবিত্র রক্তধারা গাউসে পাকের শরীরে প্রবাহমান। সকল অলীগণের গর্দানে তাঁর পবিত্র কদম মুবারক স্থাপিত। এজন্যই তাঁর লকব ‘মালিকুর রিকাব’। ‘মানাক্বেবে গাউছিয়া’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, হযরত গাউসুল আ’জমের আম্মাজান সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (র.) বর্ণনা করেছেন― ‘আবদুল কাদের রমজান শরিফের প্রথম রাত্রে জন্মগ্রহণ করেছেন। জন্মদিন থেকেই দিনের বেলায় তিনি আমার দুধ পান করেননি। ইফতারের সময় থেকে সোব্হে সাদেক পর্যন্ত সারারাত্র তিনি দুধ পান করতেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর এ কারামত সারা জিলান শহরে রাষ্ট্রময় ছড়িয়ে যায়।’
৪৭১ হিজরীর শাবান মাসের ২৯ তারিখ জিলানের আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। লোকেরা রমজানের চাঁদ দেখতে না পেয়ে পরদিন সাবধানতাবশতঃ সেহেরি খেয়ে নিলেন এ আশায় যে, হয়তো অন্য কোন স্থান থেকে চাঁদ দেখার সংবাদ আসতে পারে। পরদিন একজন আল্লাহওয়ালা দরবেশের নিকট চাঁদের বিষয়ে জানতে চাইলে উক্ত দরবেশ বললেন― ‘আবু সালেহ মুসা জঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করো; তাঁর নবজাত সন্তান আজকে সোব্হে সাদেক থেকে মায়ের দুধ পান করেছে কিনা।’ খবর নিয়ে দেখা গেল― নবশিশু সোব্হে সাদেক থেকে দুধ পানে বিরত রয়েছেন। এমন সময়ই খবর হলো― গতকাল চাঁদ দেখার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
জিলান শহরের লোকেরা এই সংবাদ জেনে হযরত গাউসুল আজম বড়পীর এর প্রথম রোজা রাখার কারামত দর্শনে হতবাক হয়ে গেল। দেশের জাহেরি আলেম উলামাগণ আকাশের নবচাঁদ দর্শনে বিফল হলেও বাতেনি শক্তির অধিকারী গাউসে পাক (রা.) ঠিকই চাঁদ দর্শন করে প্রথম রোজা পালন করেছিলেন। এখানে এসেই প্রকৃত নায়েবে নবীর পরিচয় পাওয়া যায়। শিশুকালে গাউসে পাকের জেকের-আজকার ও দোলনায় থাকাকালীন তাঁর রোজা রাখার প্রতি ইঙ্গিত করেই পরবর্তীকালে তিনি নিজেই একটি কাছিদায় একথা উল্লেখ করেছেন। ‘তারগীবুল মানাজির’ নামক গ্রন্থে উক্ত কাছিদার সংশ্লিষ্ট পঙতি উল্লেখ করা হয়েছে। কবিতাংশটি নিম্নরূপ―
‘বিদা‘আতু আম্রি জিক্রুহু মালাআ ফাযা ওয়া সাওমি ফী মাহ্দিবিহী কানা’
অর্থ― ‘আমার শৈশবকালের জিকির-আজকারে সমগ্র জগত পরিপূর্ণ হয়ে আছে। আর শৈশবের দোলনায় আমার রোজা পালনের ব্যাপারটি তো প্রসিদ্ধিই লাভ করেছে।’ ―সূত্র : তারগীবুল মানাজির
‘তাফ্রিহুল খাতির ফি মানাকিবে শেখ আবদুল কাদের’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে।
৫০৯ হিজরী সনে ৩৮ বৎসর বয়সে হযরত গাউসুল আজম (রা.) হজ্ব পালন উপলক্ষে মদিনা মোনাওয়ারায় গমন করে নবী করিম (সা.)-এর রওজা মোবারকের পাশে দাঁড়িয়ে নিম্নের দুখানা শের আবৃত্তি করলেন―
‘ফী হালাতিল বা’দি রূহী কুনতু য়ুরসিলুহা
তুকাব্বালুল আরদা আন্নি ওয়া হিয়া নায়িবাতি
ওয়া হাজিহী নাওইয়াতুল আসবায়ি ক্বাদ হাদারাত
ফামদুদ ইয়ামিনাকা কাই তুহ্জা বিহা সাফাতি।’
অর্থাৎ ‘দূরে অবস্থানকালে আমি আমার রূহকে উপস্থিত করতাম, আর সে আমার পক্ষ হতে প্রতিনিধি হয়ে এই পবিত্র জমিন চুম্বন করতো। এখন স্বশরীরের পালা। আমি নিজে স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছি। ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি অনুগ্রহ করে ডানহাত মোবারক ওপরে তুলে দিন। (চুম্বন করে) আমার ঠোঁট দুটি ধন্য হোক।’
উক্ত কবিতা পঙ্তি আবৃত্তি করার সাথে সাথে নবী করিম (সা.) আপন ডানহাত মোবারক বের করে দেন। হযরত গাউসুল আজম (রা.) উক্ত হাত মোবারক চুম্বন করে ধন্য হন।―সূত্র : তাফ্রিহুল খাতির
সুতরাং আল্লাহপাক আমাদের ভ্রান্তবাদী আক্বিদা ও ফেরকাবাজীর মতপার্থক্যের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে আউলিয়ায়ে কেরামদের অনুসরণীয় আল্লাহ ও নবীর মনোনীত সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে দাখিল করুন। আমীন। আমরা যেন অলি-আল্লাহ ও পীর-মুর্শিদ এর হাতে বায়াত হয়ে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক আকা মওলা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি অধিকহারে দরুদ ও সালতোচ্ছালাম পাঠ করার মাধ্যমে পীর-মুর্শিদের দামান ধরে ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি লাভ করতে পারি। আমীন।
তথ্যসূত্র :
১. নুজহাতুল খাতিরিল ফাতির-ফি তারজিমাতে সাইয়েদীশ শরীফ আবদুল কাদের জিলানী (রা.) : মোল্লা আলী কারী (র.)।
২. বাহজাতুল আসরার : বড়পীর গাউসুল আযম দস্তগীর হযরত সৈয়্যেদেনা আব্দুল কাদের জিলানী (রা.) : ইমাম নূরুদ্দীন আবুল হাসান শাতনুফী লাখমী মিশরী (র.)।
৩. সিররুল আসরার: বড়পীর গাউসুল আযম দস্তগীর হযরত সৈয়্যেদেনা আব্দুল কাদের জিলানী (রা.)
৪. কাউলুল জামীল বা উর্দু শেফা-উল আলীল : হযরত শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (র.)।
৫. গাউসুল আজম (রা.) এর জীবনী : মাওলানা নূরুর রহমান
৬. মোজেজায়ে আম্বিয়া ও কারামাতে আউলিয়া : অধ্যক্ষ হাফেজ এম এ জলিল (র.)