লেখক – মাওলানা মো. মোফাজ্জল হোসাইন চিশতী নিজামী
মহানবী (স:) ও আহলে বাইয়্যেত এর প্রতি ভালোবাসাই ঈমান। মানবজাতি তথা মুসলমানের মূল ভিত্তি হল ঈমান; আর ঈমানের মূল ভিত্তিই নবীর প্রেম। আল্লাহপাকের ঘোষনায়- নবী প্রেমের পূর্ণতা হাসিল হবে আহলে বাইয়্যাতের প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে। দয়াল নবীজির সাথে যার মহব্বত নাই তার ঈমান নাই। বেঈমানের যাবতীয় ধর্ম কর্ম মহান আল্লাহ পাকের দরবারে গৃহিত হবে না। ঈমান আছে তো আমলের দাম আছে। ঈমান নেই তো আমলের দাম কোন নেই। যেমন গণিত সংখ্যায় প্রথম ‘এক’ লিখে পাশে শুন্য দিলে দশ হয়, এভাবে শুন্য বাড়ালে গাণিতিক মান বাড়তে থাকবে। প্রথমে ‘এক’ না লিখে শুধু হাজার হাজার শুন্য লিখলে মান হবে জিরো অর্থ্যাৎ সম্পূর্ন লিখনী বাতিল সাব্যস্ত হবে। সুতরাং এক আছে তো শুন্যের দাম আছে প্রথমে এক নাই তো শুধু শুণ্যের কোন দাম নেই।
অনুরূপ ঈমান আছে তো আমলের মূল্য আছে ঈমান নেই তো ভুরি ভুরি আমলের কোন মূল্য নেই। স্মর্তব্য, সর্ব প্রথম আমাকে পূর্ণ ঈমানদার হতে হবে। পূর্ণ ঈমনদার হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ এরশাদ করেন ‘হে প্রিয় হাবীব আপনি বলে দিন- তোমাদের বাপ, দাদা, তোমাদের ছেলে, মেয়ে, তোমাদের ভাই, বোন, তোমাদের স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের কষ্টার্জিত ধন-সম্পদ, ব্যাবসা-বানিজ্য;যার লোকসানের ভয় তোমরা করো, তোমাদের পছন্দনীয় ঘর বাড়ী ইত্যাদি যদি আল্লাহ ও তার রাসুল ও তার পথে জিহাদের চেয়ে বেশি মুল্যবান হয় তবে তা আযাবের অপেক্ষা করে। আর আল্লাহ তায়ালা ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। (সুরা তওবা -২৪)।
উক্ত আয়াত দ্বারা একথা প্রমানিত হয়েছে যে, নবী করীম (সা) কে অপরাপর সবকিছুর উর্দ্ধে ভালোবাসা ওয়াজিব। এ ব্যাপারে সাহাবী হযরত আনাছ (রা) থেকে বর্নিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন,- কোনো ব্যাক্তি ততক্ষন পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষন না আমি তার কাছে তার পিতা মাতা, সন্তান সন্ততি ও অন্যান্য লোক থেকে বেশি প্রিয় হই। (বুখারী ১৪,মুসলিম ৪৪)।
পবিত্র কোরান ও হাদিস দ্বারা ইহাই প্রমানিত হলো যে, ঈমানের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি হলো মহানবী (সা) কে প্রাণাধিক ভালোবাসা। যখন রাসুলুল্লাহ (সা) কে পৃথিবীর সমস্ত কিছু এমনকি নিজের প্রাণাপেক্ষা অধিক ভালোবাসা যাবে, তখনই প্রকৃত ঈমানদার হওয়া সম্ভব। সুতরাং দয়াল নবীজীকে প্রাণাধিক ভালোবাসাই হলো ঈমান। নবীজীর প্রতি যার ভালোবাসার পরিমান যত বেশি তার ঈমান তত মজবুত। পক্ষান্তরে যার ভালোবাসার পরিমান যত কম তার ঈমান তত দুর্বল। ঈমানের মাপকাঠি নবী প্রেম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, নবী মুমিনদের নিকট তার জানের চেয়ে বেশি প্রিয়। (সুরা আহযাব-৬)
কোরআন হাদিস দ্বারা প্রতিয়মান হলো, একমাত্র নবী প্রেমই হলো ইমানের মুল চাবিকাঠি। নুর নবী (সা) হলেন প্রেমের উৎস, সৃষ্টির মুলাধার, শাফায়াতের কান্ডার, রহমতের ভান্ডার, জাতি নুরের জ্যোতি। শাফিয়েল মুজনাবিন, রহমাতুল্লিল আলামিন, মুরাদিল মুস্তাকিম, সিরাজুম মুনির। আল্লাহ পাক বলেন, লাওলা কা লা মা খলাকতুল আফলাক” অর্থ্যাৎ- হে নবী , আপনি যদি না হতেন, তাহলে বিশ্ব জগতের কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না। (তাফসিরে রুহুল বায়ান ২/ ৩৯২)।
পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতুল্লিল আলামিন” অর্থ্যাৎ- আমি আপনাকে জগত সমুহের জন্য রহমত স্বরুপ প্রেরণ করিয়াছি। (সুরা আম্বিয়া -১০৭)। তাহলে নবীর নুরেই জগত সৃজন। যার আনুগত্যেই আল্লাহর আনুগত্য (নিসা ৮০) । যার হাতে বায়াত হলে আল্লাহর হাতেই বায়াত হয় । (ফাত্তাহ ১০)। যার ভালোবাসাই আল্লাহর ভালোবাসা। (আল ইমরান- ৩১)। যার স্বরন বা জিকিরকে আল্লাহ সুউচ্চ করেছেন।(সুরা ইনশিরাহ -৪)। কতটুকু উচ্চ করেছেন তার কোনো সিমা নেই। সেই মহানবী (সা) এর ভালোবাসায় পূর্নতা প্রাপ্ত হতে হলে তার আহলে বায়েত এর প্রতি চুড়ান্ত ভালোবাসা থাকতে হবে নচেৎ নবী প্রেম হবে না।
এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন, “হে হাবীব, আপনি লোকদিগকে বলে দিন যে, শুধুমাত্র আমার আহলে বাইয়াতের প্রতি ভালোবাসা ব্যাতিত (মুওয়াদ্দাতা ফিল কুবরা) রিসালাতের পারিশ্রমিক অন্য কিছুই চাই না।”( শুরা ২৩)। নবীজীর পরিবার বর্গ বা আহলে বায়াতের সঠিক পরিচয় তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট সাহাবী সাদ বিন আবু আক্কাছ (রা)। (মুসলিম শরীফ) তিনি বর্ণনা করেন, রাসুল (সা) এর আহলে বায়েত হলো মাওলা আলী, মা ফাতেমা, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন – (আ)। তিরমিজি, মেশকাত, মুসলিম শরীফ প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে “পাক- পাঞ্জাতন” বা আহলে বায়েত সম্পর্কে যা বর্নিত আছে তার মুল কথা এই যে, হযরত মুহাম্মদ (সা), হযরত আলী (আ), মা ফাতেমা (আ), ইমাম হাসান (আ), ইমাম হোসাইন (আ) -এই পাচজনকেই পাক পাঞ্জাতন বা আহলে বায়েত বলা হয়।
আল্লাহর জাত ও সিফাত প্রকাশ লাভ করেছে তাদের মধ্য দিয়েই। জগতে যা কিছু প্রকাশিত হয়েছে বা সৃষ্টি হয়েছে তা সবই আহলে বায়েতেরই বিকশিত রূপ। যাদের সম্পর্কে বিদায় হজ্বের ভাষণে মহানবী (সা) বলেছিলেন- “আমি উম্মতের মধ্যে দুটি ভারী বস্তু রেখে গেলাম। তা হলো পবিত্র কোরআন ও আমার আহলে বায়েত। এরা কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না, যতক্ষন না হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত হবে। (বুখারী- ৫খন্ড, মেশকাত -৫৮৯২, ৯৩ নং হাদীস)। তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৪৭৭ ও তাফসীরে মাযহারী ৯/৪৯২ পৃষ্ঠায়ও আহলে বায়েতের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আছে।
আউয়াল আখের, জাহের বাতেন, বেলায়েত নবুয়ত সর্বস্থানে আহলে বায়েত পাক পাঞ্জাতন চির বর্তমান এবং অনন্ত কালের বস্তুমোহে নাছুত সাগরে নিমজ্জিত জীবের উদ্ধার কর্তা ও পারের তরণী। দয়াল নবী (সা) ফরমান, “মাছালা আহলে বায়াত কামাছালা সাফিনাতুন নুহীন, মান দাখালা ফান্নাজি” অর্থ্যাৎ- আমার আহলে বায়াত হলো নুহ নবীর কিস্তীর মতো যে ঐ কিস্তীতে আরোহন করবে সে নাজাত প্রাপ্ত বা মুক্তিপ্রাপ্ত হবে।
সাইজীর ভাষায় – পারে কে যাবি, নবীর নৌকাতে আয়, রুপ কাষ্ঠেরই নৌকাখানি নাই ডোবার ভয় ।
ঈমান কোনো তপ জপ, পোষাপ পরিচ্ছদ, বা সার্টিফিকেট পাওয়ার বিষয় নয় – ঈমান হলো দেখে শুনে চিনে জেনে দেহ মন প্রান অর্পন করে ভালোবাসার বিষয়। সুতরাং, বৃথায় জীবন ব্যায় না করে, মওলা আলী (আ) এর ছিলছিলা ভুক্ত একজন কামেল মোরশেদের হাতে বায়াত গ্রহন পূর্বক – ঈমানে বেলগায়েব ছেড়ে ইলমুল,আয়নুল,হক্কোল ও হুয়াল একীনে পৌছে পরিপূর্ন ঈমানদার হয়ে যাই। হে পরম সত্বা প্রভু- সকলকে তৌফিক নসীব করুন। ছুম্মা আমীন।