লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
শত বছর আগের কথা বলছি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে তখন নিয়মিত বসে কবিগানের আসর। তখনকার দিনে কোনো উৎসব হবে কিন্তু কবিগান হবে না, এমনটি ভাবাই যায় না। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গীবাজারের মাঝিরঘাট এলাকায় দুর্গাপূজার উপলক্ষে বসলো বিশাল মেলা। ছিল কবিগানের আয়োজন। ঐ সময়ের জনপ্রিয় কবিয়াল মোহনবাঁশি ও চিন্তাহরণ গান পরিবেশন করবেন।হাজার হাজার মানুষের জমায়েত। গান শুরু হলো। হঠাৎই বিপত্তি। কবিয়াল চিন্তাহরণ অসুস্থ হয়ে গান পরিবেশনের অনুপযুক্ত হয়ে পড়লেন। প্রমাদ গুনলেন আয়োজরা। তারা অনেক চেষ্টা করেও অন্য কোনো কবিয়াল যোগাড় করতে পারলেন না। কবিয়াল দীনবন্ধু মিত্র আসর রক্ষার জন্য পাঠালেন ২১ বছরের এক তরুণ কবি কে।
তরুন কবি মঞ্চে আসতেই অবজ্ঞার হাসি ফুটলো কবিয়াল মোহনবাঁশির মুখে। তিনি অবজ্ঞা ভরে বললেন, “এই পুঁচকের সঙ্গে কি পালা করা যায়?”
বিনীত ভাবে উত্তর দিলেন তরুন কবি,
“উৎসব আর ভয়, লজ্জা কম নয়,
কে বা হারাতে পারে কারে?
পুঁচকে ছেলে সত্যি মানি, শিশু ব্রজ ছিল জ্ঞানী
চেনাজানা হোক না আসরে!”
সেই বিস্ময় তরুণ সেদিন কবিগানের মুগ্ধ করেছিলেন সমস্ত শ্রোতাদেরকে। চমকে দিয়েছেন স্বয়ং কবিয়াল মোহনবাঁশিকে। তার হাত ধরেই বাংলার কবিগান প্রবেশ করেছিল এক নতুন যুগে। তিনি আর কেউ নন, তিনি বাংলার পথ-প্রান্তরের কবিয়াল, মেঠোপথের কবি, ভান্ডারী গানে কিংবদন্তী কবিয়াল রমেশ শীল।
চট্টগ্রামের এই কিংবদন্তী কৃতি পুরুষ কবিয়াল রমেশ শীল বোয়ালখালীর গোমদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রমেশ শীল শৈশব ছিল দুঃখ বেদনাময়, দারিদ্রক্লিষ্ট জীবন। নিজের অবস্থার কথা তিনি নিজে লিখেছেন এভাবে –
“আমিই বালক, চালক, পালক, আমার আর কেহ নাই। মায়ের অলংকার সম্বল আমার, বিক্রি করে খাই।”
কবিয়াল রমেশ শীলের আজীবন সাধনা ছিল মানুষতত্ত্বকে আশ্রয় করে। উপমহাদেশের সুফি সাধনার এক উল্লেখযোগ্য ধারা মাইজভান্ডারী দর্শন নিয়ে কবিয়াল রমেশ শীলের ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান। সুফি দর্শন মানুষকে মানুষ হওয়ার যে আলোকবর্তিকার সন্ধান দেয়, তারই ধারক বাহক ছিলেন কবিয়াল রমেশ শীল। অসংখ্য গানে তিনি পরম প্রেমের মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার কথায়, সুরে প্রবাহিত হয়েছে প্রভুপ্রেমের অনাবিল সুখের স্বর্গীয় ধারা। মূলত তার গান হচ্ছে প্রভুপ্রেমের এক মহত্তম সুর ঝংকার যা ভক্ত হৃদয়ক উদ্বেলিত করে, ভাব-বিহ্বলতায় বিভোর করে। হৃদয়কে প্রেম-বিরহের ঢেউয়ে আন্দোলিত করে।
কবিয়াল রমেশ শীল মাইজভান্ডারের বিখ্যাত সাধক সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভান্ডারীর স্বানিধ্যপ্রাপ্ত। তিনি গুরু সাধনা বা সুফি সাধনাকে পূর্ণরূপে হৃদয়াঙ্গম করে মানুষতত্ত্বকে প্রস্ফুটিত করেছেন তার গানে। লিখেছেন বহু আধ্যাত্মিক গান। মনে করা হয়, তার রচিত আধ্যাত্মিক গানের সংখ্যা তিন শতাধিক। তার রচিত পুস্তকগুলো হলো – আশেক মাওলা, ভান্ডারে মাওলা, শান্তি ভান্ডার, আত্ম তত্ত্ব, নূরে দুনিয়া, সত্য দর্পন, জীবন সাথী, মুক্তির দরবার, মানব বন্ধু, বিচ্ছেদ তরঙ্গ।
অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় চেতনার বলিষ্ঠ জীবন সাধক কবিয়াল রমেশ শীল। তার গান মানুষকে ঐশী প্রেমের পথ দেখায়। জীবনবাদী ধর্মতত্ত্ববিদ কবির মুখে তাইতো শুনি –
“মাটির মূর্তির পূজা ছেড়ে মানুষ পূজা করো’।
“মিমের পর্দা উঠাইলে, দেখবি ওরে মন
রাম রহিম কৃষ্ণ করিম, মূলেতে একজন।”
রচনাকাল – 25/05/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী