ব্লগ – হযরত আলী (আ) এর ২০ টি বাণী – পর্ব – ০৩

সংকলন – লাবিব মাহফুজ চিশতী

১।  এমন অনেক লোক সিয়াম পালন করে যাদের সিয়াম উপোষ থাকা ও তৃষ্ণার্ত হওয়ার বৈ কিছু নয় এবং এমন অনেক সালাতি আছে যাদের সালাত জাগরণ ও কষ্ট করা বৈ কিছু নয়। তাদের ইবাদাত অপেক্ষা তত্বজ্ঞানীদের খাওয়া, পান করা ও ঘুম অনেক বেশি ভালো।

২। জ্ঞান পার্থিব সম্পদ থেকে অনেক ভালো। জ্ঞান তোমাকে রক্ষা করবে; অথচ সম্পদ তোমার রক্ষা করতে হবে। ব্যয় করলে সম্পদ কমে যায়; অথচ দান করলে জ্ঞান বহুগুণ বেড়ে যায় এবং সম্পদের পরিণাম মৃত্যু যেহেতু সম্পদ বিনষ্ট হয়। জ্ঞান হলো বিশ্বাস যা আমল করা হয়। এর দ্বারা মানুষ জীবদ্দশায় আনুগত্য অর্জন করে এবং মৃত্যুর পর সুখ্যাতি বেড়ে যায়। জ্ঞান হলো শাসক আর সম্পদ হলো শাসিত। যারা সম্পদ স্তূপীকৃত করে তারা মৃত, যদিও তারা সর্বসমক্ষে জীবিত। আবার যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, যতদিন পৃথিবীতে থাকবে ততদিন তারা থাকবে। তাদের দেহ পাওয়া যাবে না, কিন্তু তাদের আকৃতি হৃদয়ে স্থাপিত থাকবে। আমার বক্ষের দিকে তাকাও; এখানে জ্ঞান স্তূপীকৃত হয়ে আছে। আমি আশা করি আমার এ জ্ঞান বহনকারী কাউকে পেয়ে যাবো।

৩। যে নিজের মূল্য জানে না সে রসাতলে যায়।

৪। কখনো সে লোকের মতো হয়ো না, যে আমল ছাড়া পরকালের পরম সুখের আশা করে, আশা-আকাঙ্খাকে দীর্ঘায়িত করে, তওবা করতে বিলম্ব করে  এবং দরবেশের মতো কথা বলে কিন্তু দুনিয়ালোভীর মতো কাজ করে। সে অল্পতে তুষ্ট ও তৃপ্ত হয় না, তাকে যা দেওয়া  হয়েছে সেজন্য শুকরিয়া আদায় করে না। সে অন্যকে বঞ্চিত করে দুনিয়ার সম্পদ বৃদ্ধি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে যা করে না অন্যদের তা করার জন্য  আদেশ করে। সে ধার্মিকগণকে ভালোবাসে কিন্তু নিজে তাদের মতো হয় না। সে পাপীদেরকে ঘৃণা করে অথচ নিজেই তাদের মধ্যে একজন। পাপাধিক্য হেতু সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে; কিন্তু যে জন্য সে মৃত্যুভয়ে ভীত সে বিষয়ে অমনোযোগী। সে পীড়িত হলে লজ্জাবোধ করে, সুস্থ থাকলে নিরাপদ অনুভব করে এবং আনন্দ-উৎসব সবকিছু ভুলে থাকে। যখন সে পীড়া থেকে আরোগ্যলাভ করে তখন নিজের সম্পর্কে দাম্ভিক হয়ে পড়ে আবার যখন দুর্দশাগ্রস্থ হয় তখন নিরাশ হয়ে পড়ে। বিপদ আপতিত হলে সে হতভম্বের মতো প্রার্থনা করে, আবার বিপদ কেটে গেলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার হৃদয় কাল্পনিক জিনিষ দ্বারা পরাভূত হয়। কোনো কিছুতেই তার হৃদয়ে দৃঢ় প্রত্যয় থাকে না। অন্যদের ছোটখাটো পাপের জন্য সে দুশ্চিন্তা করে কিন্তু নিজের বেলায় কৃতকর্মের চেয়ে অধিক পুরস্কার আশা করে। যদি সে  সম্পদশালী হয়ে পড়ে তবে সে আত্ম-কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে এবং পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যদি সে দরিদ্র হয়ে পড়ে তবে সে দুর্বল ও হতাশ হয়ে পড়ে। কল্যাণকর কাজে সে স্বল্প সময় ব্যয় করে অথচ যাচনা করতে সে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে। কামনা-বাসনা যখন তাকে ঘিরে ধরে তখন সে তড়িঘড়ি করে পাপে লিপ্ত হয় অথচ তওবা করতে বিলম্ব ঘটায়। তার ওপর দুর্দশা নিপতিত হলে সে ইসলামের উম্মার সকল নিয়ম-কানুন অমান্য করে। সে উপদেশ নেওয়ার মতো ঘটনাবলী বর্ণনা করে কিন্তু নিজে উপদেশ গ্রহণ করে না। সে অন্যদের উপদেশ দিয়ে বেড়ায় কিন্তু নিজে তা মান্য করে না। সে বাগাড়ম্বরে পটু কিন্তু আমলে খাটো। যা ধ্বংস হয়ে যাবে এমন জিনিসের জন্য সে আকাঙ্খী, কিন্তু যা চিরস্থায়ী তাতে উদাসীন। সে লাভকে লোকসান আর লোকসানকে লাভ মনে করে। সে মৃত্যুকে ভয় করে কিন্তু মৃত্যুর বিরুদ্ধে তার করণীয় কিছুই নেই। সে অন্যের পাপকে অনেক বড় করে দেখে অথচ নিজের পাপকে অতিক্ষুদ্র করে দেখে। সে একটু খানিক আল্লাহর বাধ্যতা দেখালে মনে করে অনেক করেছে কিন্তু অন্য কেউ অনেক আনুগত্য প্রকাশ করলেও সে তা অতিক্ষুদ্র মনে করে। এভাবে সে অন্যকে ভর্ৎসনা করে নিজের প্রতি তোষামুদে হয়। সে ধনশালীদের সঙ্গ পেতে ভালোবাসে। সে দরিদ্রদের সাথে আল্লাহর জেকের করতেও পছন্দ করে না। সে নিজের স্বার্থে অন্যের বিরুদ্ধে রায় দেয় কিন্তু নিজকে গোমরাহিতে ডুবিয়ে রাখে। অন্যরা তাকে মান্য করে কিন্তু সে আল্লাহকে অমান্য করে। সে ব্যগ্র থাকে যাতে অন্যরা তার প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করে কিন্তু অন্যদের প্রতি তার দায়িত্ব সে পালন করে না। সে লোকভয়ে আমল করে কিন্তু তার কাজ-কর্মে সে প্রভুকে ভয় করে না।

৫। ধৈর্যশীলগণ কখনো অকৃতকার্য হয় না; হতে পারে, হতে পারে, তাতে দীর্ঘ সময় লাগবে।

৬। নিশ্চয়ই তোমরা দেখতে পাবে যদি তোমরা দেখার জন্য যত্নবান হও। নিশ্চয়ই তোমরা সৎপথের সন্ধান পাবে যদি তোমাদের কানকে হেদায়েত গ্রহণ কর। নিশ্চয়ই তোমরা শুনতে পাবে যদি তোমাদের কানকে শোনার জন্য আগ্রহান্বিত কর।

৭। তোমরা সদাচারণ দ্বারা তোমার সাথীদের সতর্ক কর এবং তাদের প্রতি আনুকূল্য দেখিয়ে তাদের মন্দ দূরীভূত কর।

৮। পাপ করে তওবা করার চেয়ে পাপ থেকে বিরত থাকা সহজতর।

৯। যখন কোনো কিছুতে ভয় পাবে সোজা তার গভীরে প্রবেশ করবে; কারণ তুমি যতটুকু ভয় পাও তার অনেক বেশি হলো তা থেকে দূরে থাকার প্রবণতা।

১০। লোভ হলো স্থায়ী দাসত্ব।

১১। জ্ঞানের বিষয়ে নীরব থাকার কোনো সুফল নেই; যেমন নির্বুদ্ধিতার বিষয়ে কথা বলে কোনো কল্যাণ হয় না।

১২। ন্যায়ের ব্যাপারে আমি কখনো সন্দেহের বশীভূত হইনি; কারণ আমাকে তা দেখিয়ে দেওয়া হতো।

১৩। অত্যাচারে যে নেতৃত্ব দেয়, পরে সে অনুশোচনায় নিজের হাত কামড়ায়।

১৪। হে আদম সন্তান, মৌলিক চাহিদার বেশি যা কিছু তোমরা অর্জন কর তাতে তোমরা শুধুমাত্র অন্যের জন্য সতর্ক প্রহরী।

১৫। শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়লে হৃদয় ক্লান্ত হয়ে যায়। সুতরাং হৃদয়ের জন্য মধুর বক্তব্যের সন্ধান কর এবং তা উপভোগ করে হৃদয়কে তাজা করে তোলো।

১৬। প্রত্যেক পাত্রেরই ধারণ ক্ষমতা কমে আসে, যতই তাতে কোনো কিছু রাখা হয়। কিন্তু জ্ঞান হলো এর বিপরীত যার ধারণ ক্ষমতা ক্রমেই বেড়ে যায়।

১৭। যে ধৈর্য ধারণ করা অভ্যাস করে তার প্রথম পুরস্কার হলো মানুষ তার সাহায্যকারী হয়।

১৮। যে নিজের কর্মকান্ডের হিসাব-নিকাশ করে সে উপকৃত হয়; আর যে বেমালুম থাকে তার ভোগান্তি হয়। যে ভয় করে সে নিরাপদ থাকে। যে উপদেশ গ্রহণ করে (চারপাশের বস্তু থেকে) সে আলোর সন্ধান পায়।  যে আলোর সন্ধান পায় তার বোধগম্যতা হয়; যার বোধগম্যতা হয় সে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।

১৯। উদারতা সম্মানের রক্ষক, ধৈর্য বোকার লাগাম; ক্ষমা কৃতকার্যতার ধার্যকৃত কর। অসম্মান বিশ্বসঘাতকের শাস্তি; এবং আলাপ-পরামর্শ হেদায়েতের প্রধান পথ। যে নিজের মতামতে তৃপ্ত হয় সে বিপদে পড়ে। সহিষ্ণুতা বিপদে সাহস যোগায়। সবচেয়ে বড় তৃপ্তি হলো আকাক্সক্ষা পরিত্যাগ করা। আকাঙ্খাকে পরাভূত করে অনেক দাসতুল্য ব্যক্তিও উন্নতি লাভ করেছে। ক্ষমতা অভিজ্ঞতা সংরক্ষণ করে। ভালোবাসা মানে হলো সুদৃঢ় আত্মীয়তা। শোকাহতকে বিশ্বাস করো না।

২০। বিনম্রতার পোশাক যে পড়েছে (অর্থাৎ বিনয়ী হয়েছে) তার কোনো ত্রুটি মানুষ দেখতে পায় না।

সংকলন – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর