লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
দ্বীনে মোহাম্মদীর শাশ্বত বিধান হলো বায়াত গ্রহণ করা তথা যুগের ওলী মুর্শিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁর নির্দেশিত পথে চলা। যুগে যুগে প্রেরিত পুরুষগণ তথা অবতার/রাছুল বা ওলী মুর্শিদগণ বায়াতের মাধ্যমে আপনাপন অনুসারীগণকে পথ প্রদর্শন করে থাকেন। এ পথেই মুক্তি। আর যারা এজিদি ওহাবী তথা খান্নাছ কবলিত অপবিশ^াসের অনুসারী, তারাই এ শাশ^ত বিধানটিকে অস্বীকার করে বদ্ধ হয়ে আছে অন্ধবিশ^াসের চারিদেয়ালের মধ্যে। যুগে যুগে তারাই রচনা করছে অপধর্মের ইতিহাস। তাদের দ্বারাই কলঙ্কিত/কলুষিত হচ্ছে ধর্ম। নিগৃহীত হচ্ছে প্রকৃত ধার্মিকগণ। বায়াত তথা মানুষে আত্মসমর্পণের বিধান কে অস্বীকারকারী বকধার্মিকদের মুখোশ উন্মোচনের জন্যই “আপন খবর” এর (পূর্ব প্রকাশের পর) বর্তমান সংখ্যাতেও থাকছে বায়াত প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা।
এক নজরে দেখে নেই গত পর্বে প্রদত্ত বায়াত বিষয়ক দলিলগুলো –
সুরা ফাতেহা ০৭; সুরা নাহল ৩৬; সুরা ইব্রাহিম ০৪; সুরা রাদ ০৭; সুরা ফাত্তাহ ১০, ১৮; সুরা নিসা ১৩, ৫৯, ৬৯, ৮০, ১৫০, ১৫১; সুরা আল ইমরান ৩১, ৩২, ৭৬, ১৩২; সুরা হুজরাত ০২; সুরা আহযাব ০৬, ৩১, ৩৩, ৩৬, ৫৬; সুরা নূর ৩৫, ৬২, ৬৩; সুরা মুমিনুন ২৪; সুরা ফুরকান ৫৯; সুরা ইউনুস ৪৭, ৬২, ১০০; সুরা কাহাফ ১৭, ৬৬-৭০; সুরা বাকারা ১৫৪; সুরা আরাফ ৫৬, ১৮১, ১৯৮; সুরা মায়েদা ৩৫; সুরা ইয়াসিন ২১; সুরা লোকমান ১৫; সুরা বণী ইসরাইল ৭১; সুরা মরঈয়ম ৮৭; সুরা আম্বিয়া ০৭; সুরা তওবা ১১৯; সুরা মুমতাহিনা ১২; সুরা হাশর ০৭; ইত্যাদি।
মূলতঃ সমগ্র কুরআন ব্যাপিই বায়াতের কথা তথা মানুষগুরু তথা রাছুল বা অলী মুর্শিদগণের আনুগত্য তাবেদারীর মাধ্যমে ধর্মে স্থিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ইসলাম চিরঞ্জীব জগতে অধিষ্ঠিত হওয়ার ধর্ম। যার মাধ্যমে একজন ধার্মিক অধিষ্ঠিত হয় নিত্যপ্রেমের অমর লোকে। যেখানে নেই কোনো ক্ষয়িষ্ণু চিন্তা চেতনা, অন্ধবিশ^াস বা অনুমান কল্পনা, নেই বিভেদ বৈষম্য বা কোনো সংশয়। চিরঞ্জীব জগতে অধিষ্ঠিত হওয়ার মূলমন্ত্রই হলো একজন চিরঞ্জীব মানুষের অনুকরণ অনুসরণ করে তাঁর আদলে নিজের রূপকে রূপায়িত করে নেয়া। যারা ছিবাগাতাল্লাহ প্রাপ্ত তথা আল্লাহর রঙে রঞ্জিত তথা ওয়াজহুল্লার অধিকারী তাঁরাই ধর্ম দানের মালিক তথা বায়াত করানোর মালিক। যারা তাঁদের অনুসরণে নিজেকে সেই প্রভূরঙে রঞ্জিত করে নিতে সক্ষম তাঁরাই লাভ করবে চিরমুক্তির নিত্য পথ। যারা বা যে সমস্ত মানুষ কোনো পরকাল প্রাপ্ত বা মুক্ত মানুষের নিকট বায়াত মুরিদ হয়ে তাঁর নির্দেশিত পথে ধ্যান সাধনায় রতো আছেন তাকে বলা হয় আমানু (যারা ঈমান এনেছে)। আর যারা গুরু বা মুর্শিদের নিকট বায়াত মুরিদ হয় নি তাকে আমানু বলা যাবে না। বায়াত গ্রহণ করে গুরুপথে একান্ত ভক্তিভরে যদি স্থিত থেকে হাছিল করে নেয়া যায় মুক্তি, তখন তাঁকে বলা হবে মুমিন। এই মুমিন ব্যাক্তি তখন অন্য আমানুদের পথের সন্ধান দিবে। এটাই চিরবর্তমান ইসলামের শাশ^ত বিধান। মহান রব তার গুনে গুণান্বিত পবিত্র সত্ত্বাদের মধ্যেই চিরঞ্জীব রূপে প্রকাশিত এবং প্রবাহিত হয়ে চলেছেন সিনা-ব-সিনা পবিত্র মানুষদের মধ্য দিয়ে। সেই অনাদী কালের মহা¯্রােতে শামিল হয় যারা তথা পবিত্র মানুষের চরণে নিজেকে উৎসর্গ (ফানা) বা বিলীন করে দিয়ে তার অনন্ত অখন্ড দিব্য জ্যোতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে তাঁর হয়ে যায় তারাই হয় অমর লোকের বাসিন্দা তথা জান্নাতি মানুষ। “মনে রাখা দরকার,
একজন পবিত্র মানুষের শ্রীচরণে নিজেকে উৎসর্গ না করলে এবং তাঁর দেখানো পথে না চললে কোনোভাবেই মুক্তি সম্ভব নয়।”
ইসলাম ধর্মে কোনো অনুমান কল্পনায় খোদা বিশ^াসের জায়গা নেই। অনুমান বা কল্পনায় খোদার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে শয়তান। এখনো যারা আল্লাহকে অন্ধঅনুমানে কল্পনা করে থাকে তারা শয়তানের অনুসারী। খোদার ভেদ পরিচয় সম্যকরূপে জেনে তারপর তাঁর ভজনা করতে হবে। তবেই লাভ করা যাবে তাঁকে। ইনছানুল কামেলগণ তথা ওলী মুর্শিদগণই তার ভেদ পরিচয় জানেন। তাঁরা নিত্য আল্লাহতেই বাস করেন এবং আল্লাহতেই মত্ত থাকেন। অতএব তাঁরাই আল্লাহ পাবার একমাত্র উছিলা। তাঁরাই প্রভুর খবরদাতা। তাঁদের মাধ্যমেই লাভ করতে হবে পরমপ্রভুকে। এটাই দ্বীন ইসলাম বা মিল্লাতে ইবরাহিম বা খোদাকে দেখে বিশ^াস করার ধর্ম। খোদাপ্রাপ্তির একমাত্র পথ হলো ইনসানুল কামেল বা ওলী মুর্শিদের চরণে নিজেকে সমর্পিত করে বা মুরিদ হয়ে তাঁর ভক্ত হয়ে যাওয়া। তবেই সাধনাবলে প্রকটিত হবেন তিনি।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম তাঁর সমগ্র জীবনে বায়াত মুরিদের মাধ্যমে চিরমুক্তির জগতে স্থিত হওয়ার শিক্ষাটিই প্রচার করেছেন। জ্ঞানীগণ তথা আমানু মুমিনগণ তাঁর দেখানো এই সিরাতুল মুস্তাকিম গ্রহন করে সমর্পিত হয়ে মুক্তি পাচ্ছেন আর অজ্ঞানী হায়ানী আত্মার অধিকারী মূর্খরা শাশ^ত এ বিধানকে অস্বীকার করে পতিত হচ্ছেন জাহান্নামের অতলে তথা চির বন্দীত্বে তথা তারা ধাবিত হচ্ছে ধ্বংসের দিকে।
‘মুর্শিদের অনুকরণ অনুসরণেই আসবে কাক্সিক্ষত মুক্তি। কারন, তাঁরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত ও আল্লাহর জ্ঞানে জ্ঞানবান। আল্লাহ তাঁর ওলী বন্ধুদেরকে তাঁর নিজ জ্ঞান থেকে জ্ঞান ও বিবেক দান করেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।’
আলমে নাছুত এর পথ অতিক্রম করে চির সবুজ, চির শান্তির দেশ ইনছানিয়াতের দিকে সাধকের যে অগ্রযাত্রা তার একমাত্র পথ হচ্ছে গুরু মুর্শিদের পায়রবী তথা দাসত্বে থেকে তার খোদায়ী গুনে নিজেকে গুণান্বিত করে তোলা। আর যেসব লেবাছধারী অতিপন্ডিতের দল গুরু ব্যাতিত সাধনার পথে অগ্রসর হয় তারা অচিরেই নিক্ষিপ্ত হবে নিন্ম থেকে নিন্মে।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী (রহ.) বলেন,
‘যে ব্যক্তি মুর্শিদের উছিলা ব্যতিত সুলূকের পথে পা বাড়ালো সে শয়তানের চক্রান্তে পথভ্রষ্ট ও অন্ধকূপে পতিত হলো।’
‘ঐ মুর্শিদে কামেলের উছিলায় আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ করো, তাঁর পায়রবী ও অনুকরণ হতে কোনো সময় বিরত থাকিও না।’
‘যদি তুমি কোনো পীরের নিকট মুরিদ হও, তবে সাবধান! তাঁর কদমে পুরোপুরি আত্মসমর্পন করো। হযরত মুসা (আ) এর ন্যায় খিজিরের আদেশ মোতাবেক চলো।’
‘মোল্লা রোম নিজে নিজে কামেল হতে পারেনি যতক্ষন না সে শামস তাবরিজের গোলামী করেছে।’
তাই ইনছানুল কামেলের পূর্ণ আনুগত্য অনুসরণ তথা দাসত্বের মধ্যেই নিহিত মুক্তির পথ।
হাফিজ সিরাজী তার কাব্যে বলেন,
জায়নামাজে শারাব রঙিন কর
মুর্শিদ বলেন যদি,
পথ দেখায় যে সেইতো জানে
পথের কোথায় অন্ত-আদি!
গাউছে পাক আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) বলেন,
‘খোদার কসম, ওলী এবং নবীদের অবস্থা একই প্রকার, শুধু নাম ও উপাধি ভিন্ন।’
‘ইনছানুল কামেলগন মুরিদ ও সন্ধানীদের কাবায় পরিণত হন যে, চারিদিক হতে দলে দলে লোক আগমন করতে থাকে।’
‘যে ব্যাক্তি মুক্তিকামী তার উচিত পীরের পায়ের তলার ধুলিতে পরিণত হওয়া।’
গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) বলেন,
‘হে মঈন, তোমার মুর্শিদকে খোঁজো জাগতিক মোহকে বিসর্জন দিয়ে। হতে পারে যদি তুমি দু’য়ের মাঝে অবস্থান করো তাহলে উভয়ই হারাতে হবে।’
‘হে সাকী! তুমি আমাকে একত্ববাদের এ কি শারাব পান করালে যার ফলে আমি প্রতি মুহূর্তে হৃদয়ে হা-হুতাশের শব্দ শুনতে পাই।’
মূলত মুর্শিদ প্রেমে আত্মহারা তথা মুর্শিদে সমর্পিত চিত্তটিই চরমভাবে তৌহিদ সাগরে নিমজ্জিত হয়। সেখানে সে উপলদ্ধি করতে পারে পরম সচ্চিদানন্দ। সে অভিন্ন দেখে মুর্শিদ রাছুল আল্লাহকে। এখানেই মুক্তি। আর যারা সমর্পিত নয় গুরুতে, তারা চিরকাল আবদ্ধ-ই থাকবে রুহে হায়ানীর নিকৃষ্ট জগতে।
তাদের জন্যই বলা হয়েছে –
যার পীর নাই তার পীর হলো শয়তান।
- খারফুতী শরীফের সূত্রে শানে হাবিবুর রহমান, ২০০ পৃ.
- ওহাবীদের নেতা আশরাফ আলী থানভীর রুহে তাসাউফের ১৬০ পৃ.
- তাফসীরে রুহুল বায়ান ৯ম খন্ড, – ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন ৫ম খন্ড
- আওয়ারেফুল মাওয়ারেফ ৭৮ পৃ. – দাওয়াত তাবলীগ ও পীর মুরিদি ২১৯ পৃ.
- বাইয়াত ও খেলাফতের বিধান ৪৬ পৃ ইত্যাদি।
মোহাম্মদী ইসলামে অন্ধ গোঁড়ামীর কোনো স্থান নাই। পৃথীবির সকল মহামানব বায়াত হয়েছেন এবং পতিত মানুষদের মুরিদ করেই মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। যাকে বলা হয় সিরাতুল মুস্তাকিম। সরল সঠিক পথ। ধর্মের সঠিক দেশনা মুর্শিদ আমাদের সকলকে দান করুন।
রচনাকাল – 05/11/2017
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী