হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
বাহ্যিক রূপক কাঠামো অনুসরণকারীরাই মনগড়া বিভিন্ন অর্থ করে ধর্মের নামে শত মতভেদ সৃষ্টি করে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ, খুনাখুনি করে চলেছে। এরাই হলো ইয়াজুজ-মাজুজ, কামড়া কামড়ি করে চলছে। মাওলানা রুমী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হি তাদেরকেই কুকুরের সাথে তুলনা করেছেন। মানব জাতির দুর্ভাগ্য; কোরানের অনুবাদ বা ব্যাখ্যা বলতে এসব রূপক কাঠামোকেই মুসলিম সমাজ গ্রহণ করে নিয়ে কুকুরের মতো একে অন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ করছে, কোরান-হাদিসেরও দোহাই দিচ্ছে! তাতে সাধারন মানুষের ঈমান যাবার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদীরা এবং নাস্তিকরা যথেষ্ট সুযোগ পেয়ে মুসলমানদেরকে আক্রমণ করে চলেছে। এর জন্য কোরান-হাদিসের আক্ষরিক ব্যাখ্যা বা মাদ্রাসার ইলমুল কালামই হলো দায়ী। কোরানের কালাম মানে আত্মার জ্ঞান। আত্মার জ্ঞান হলো ধর্মজ্ঞান, যা চিরন্তন-শাশ্বত কালাম। কোরান কাগজে থাকে না এটা বুঝা দরকার। কাগজের কোরান আল্লাহর তরফের কোরান নয়। কারণ,
“কোরান হলো আল্লাহর নূর, কদিম, কোরান অসীম এবং তা অখন্ড-কালের সাথে সম্পৃক্ত রাছুলের আহলে বাইয়্যেতসহ ”
এটা কাগজে থাকে না, থাকার প্রশ্নই আসে না। কাগজে কোরান থাকলে ধ্বংসশীল একটি বই হয়ে যায়। কোরান জিন্দা, চিরন্তন শাশ্বত- এর ধ্বংস নেই, এর সাথে আল্লাহ আছেন। মুর্দা আরবী বিদ্বানেরা মুর্দা কাগজের কোরানকেই আসমানী কিতাব বা নাজিল কোরান বলে যাচ্ছে। আসলে আল্লাহর কালামকে আরবী ভাষায় লিখে রাখা হয়েছে, যাতে মানুষ ভুলে না যায়। “কোরানের ভাষা হলো রূপক-প্রতীক-মুতাশাবেহাত, আসল বা মুহকামাত হলো এই মানুষ মানে খোদার তরফ থেকে মানবসত্ত্বা বিশ্বস্ত আত্মাসহ নাজিলই আল্লাহর তরফের নাজিল কোরান।” এজন্যই বলা হয়েছে – নাজালা বিহী রুহুল আমীন। কাজেই মানুষই হলো আল্লাহর তরফের নাযেল কোরান তথা কোরানুন্ নাতেক বা বাঙময় কোরান। তিন জমাতভুক্ত জীবাত্মার বা হায়ানী আত্মার মানুষের মধ্যে ‘রুহুল আমীন’ থাকে না। আসলে যা আল্লাহর কালাম তা-ই হলো কোরান। ওহী কালামের কোনো শব্দ নেই, নেই মোরাজের কালামেরও। যার শব্দ নেই তার পার্থিব কোনো ভাষাও নেই। কোরানের কালাম যে রূপক বা প্রতীক- এ কথা দজ্জাল মোল্লা-মৌলবীরা বুঝে না। মোল্লা-মৌলবীগণ ইনছান কোরান বা নাতেক কোরানকে ঘৃণা করছে, আর কাগজ কোরানকে চুম্বন করছে, সম্মান করছে, মানে নিজেকেই অপমান করছে। তারা মানুষের ভেদ-রহস্য বুঝেনি। যদি বুঝতো তবে মানুষকে ঘৃণা করতো না। যেহেতু খোদা মানুষের সাথে আছেন, কাজেই মানুষকে ঘৃণা করলে খোদাকে ঘৃণা করা আর বাকি থাকে না।
এ সমস্ত নির্বোধদের বোধ জাগানোর জন্যই বাংলার বিখ্যাত অলি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন –
মানুষেরে ঘৃণা করি –
ও কারা- কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!
ও মুখ হতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল, মূর্খেরা সব শোনো –
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
মানুষকে চেনার জন্যই কোরান গাইডস্বরূপ আছে। কাজেই যাদের মধ্যে চিরন্তন-শাশ্বত কোরানের ব্যাখ্যা নেই, তারা আক্ষরিক অর্থে কোরানের ব্যাখ্যা করে কোরানকে অপমান করে চলেছে, সীমাবদ্ধ করে কোরান বিকৃত করছে, মানুষকে পথভ্রষ্ট করে চলেছে। ধর্ম-প্রবর্তককে অপমান করছে। কোরানের চিরন্তন-শাশ্বত ব্যাখ্যা হলে বিশ্বের মানুষকে এক দৃষ্ট হতো এবং কোরানের শিক্ষা নিলে মানুষের মাঝে ইনছানি আত্মার জাগরণ ঘটতো তথা রুহু নাযেল হতো এবং লামউতে স্থিত হতো, দ্বন্দ্ব-বিভেদ দূর হয়ে ঐক্যতা সৃষ্টি হতো এবং এ ধরাধামেই স্বর্গ রচিত হতো। মুহকামাতুন অর্থে ধর্মবাণী এক তাতে কোনো দ্বিত্ব নেই। আর কোরানের মুহকামাত মানেই মানুষ। মানুষের ধর্ম হলো মানবাত্মার জাগরণ ঘটানো, যার নফস হলো মুৎমাইন্নাহ। এ নফসের অধিকারী মানুষই হলো মুসলমান আর মুসলমানগণই হলো বেহেশতী। যেহেতু ইনছানি আত্মা বা নফসে মুৎমাইন্নাহর কোনো জাত-ভেদ নেই, কাজেই ইনছানি আত্মার অধিকারী মানুষই হলো খাঁটি মুসলমান; বা খাঁটি হিন্দ;ু বা খ্রিষ্টান; বা বৌদ্ধ; তাদেরও কোনো জাত-ভেদ নেই। ইনছানি আত্মার জগত হলো সৃষ্টির পবিত্রতম স্থান, যেখানে কোনো গলিজ প্রবেশ করে না। এজন্যই কোরান হলো বিশ্বমানব জাতির জন্য।
মোল্লা-মৌলবীদের কোরান-হাদিসের আক্ষরিক ব্যাখ্যার সুযোগেই শত মত, মতভেদ সৃষ্টি হচ্ছে, দলাদলি বা ফেরকাবাজি বা ফতোয়াবাজির ডিগবাজি চলছে। আর নাস্তিকরাও এ সুযোগ নিয়ে কোরান-হাদিসের বিরুদ্ধে বিকৃত মত পেশ করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করছে। ধার্মিকদের জন্য ধর্মান্ধ মোল্লা-মৌলবীরা যেমন বিপজ্জনক, তেমনি নাস্তিকরাও বিপজ্জনক। আঘাত করে রোগী হত্যা করা আর বেশী যতœ করে রোগী মারা রোগীর ক্ষেত্রে একই কথা। তবে নাস্তিকদেরকে চেনা যায়, তাদের থেকে বেঁচে থাকার বা সরে থাকার পথ পাওয়া যায়। কারণ, এরা ধর্মের ছদ্মাবরণে বাস করে না। কিন্তু ধর্মের ছদ্মাবরণে বাস করা অন্ধ-বধির মোল্লাদের থেকে সাধারণ মানুষ রক্ষা পাবে কেমন করে ! এরাতো হলো নাস্তিকদের চেয়েও ভয়ংকর। যদি কোরান কি তা চেনা হতো, কোরানের চিরন্তন-শাশ্বত (সার্বজনীন) ব্যাখ্যা করা হতো তবে অবশ্যই তাদের ধান্ধাবাজির সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে যেতো, মানুষও চির সত্যকে ধারণ করে মানব সুরতকে কায়েম করতে পারতো। নাস্তিকদের বিকৃত চিন্তার পথ রুদ্ধ হতো। কিন্তু তথাকথিত মুসলিম সমাজ বা আলেম-মোল্লারা তাও দেবে না। কারণ, তাতে তাদের ধর্মের নামে ব্যবসাটি বন্ধ হয়ে যায়। কোনো অলি-আল্লাহই কোরানের তাফসির করে যাননি, অজ্ঞ-মূর্খ ধর্মান্ধ আলেম-মোল্লারা তার বিরোধীতা করবে, মানবে না। কারণ, মুসলিম সমাজে ধর্মজ্ঞান নেই ইহাই হলো তার প্রমাণ, আছে রূপক-কাঠামো, প্রতীক, ইলমুল কালাম বা আক্ষরিক বিদ্যা।
মানব সুরতের মাঝেই আল্লাহর সুরত আছে। ‘মানব সুরত কায়েম হলেই বাকশক্তি রক্ষা হয় আর বাকশক্তি রক্ষা হলেই আল্লাহর কালাম কোরান পাওয়া যায়, সে কোরান শ্রবণযোগ্য।’ কাজেই বলা যায়, বাকশক্তি রক্ষা করাই হলো মানুষের সাধনা। ধর্মশাস্ত্রের কথা হলো মানুষকে ঐক্যতায় নিয়ে আসা। এজন্যই নামাজ, রোজা, সদকার চেয়ে উত্তম হলো মানুষের মধ্যে ঐক্যতা সৃষ্টি করা। আর ঐক্যতা সৃষ্টি হবে তখন যখন ইনছানি আত্মার জাগরণ ঘটবে। প্রত্যেক ধর্মের মাঝেই এ সমস্ত জঙ্গি মৌলবাদী নামক জঞ্জালগুলো অবস্থান করছে। তারা এ পথে আসতে রাজি নয়। আসলে যারা ধার্মিক তারাই হলো মানুষ, মানুষ মানেই হলো সিরাতে-সুরতে এক। এরা ধর্মের নামে সন্ত্রাস, প্রতারণা, ঘরবাড়ি পুড়ে ফেলা, পর ধর্মের নিন্দা, মানুষ হত্যা করা ইত্যাদির মধ্যে নেই। সূরা বাকারার ১৯১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ওয়াক্তুলূহুম হাইসূ সাকেফ্তুমুহুম” অর্থাৎ এবং তোমরা তাদেরকে যেখানে পাও হত্যা করো। “ওয়া আখরেজুহুম মিন হাইসু আখরাজুকুম” অর্থাৎ এবং তাদেরকে বের করো, যেখান থেকে তোমাদেরকে বের করেছিলো। “ওয়াল ফেতনাতু আশাদ্দু মিনাল কাতলে” অর্থাৎ এবং ফেৎনা (ঝগড়া-বিবাদ) হত্যা করা হতে জঘন্যতম (অপরাধ)। ১৯৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “কাতেলূহুম হাত্তা লা তাকূনা ফেতনাতুন ওয়া ইয়াকুনাদ্ দ্বীনু লিল্লাহে” অর্থাৎ এবং তাদেরকে হত্যা করো, যে পর্যন্ত না তারা ফেৎনা হতে বিরত না হয় এবং আল্লাহর জন্য দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হয়। কোরানে উক্ত কালাম দ্বারা তথাকথিত ধার্মিকেরা বুঝেছে শুধু মুতাশাবেহাত তথা কাঠামোগত বা রূপক অর্থ, তাঁর মুহকামাত বা গূঢ়ার্থ বা দ্ব্যর্থহীন বা সমুজ্জলটি গ্রহণ করেনি। তাই তারা কাফের বলতে বুঝেছে অন্য জাতি বা ধর্মের মানুষকে এবং কতল বলতে বুঝেছে তাদেরকে জবাই করা বা হত্যা করা।
আর “দ্বীন” বলতে বুঝেছে শুধু বাহ্যিক বা আনুষ্ঠানিক নামাজ, রোজা, দাঁড়ী, টুপি, লম্বা জুব্বা, তাসবিহ জপ ইত্যাদি। অন্য ধর্মের বকধার্মিকরাও ধর্ম বলতে তাই বুঝেছে, যা নিজ নিজ ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত নয়। তাই ধর্মের ছদ্মাাবরণে ধর্মের সাইনবোর্ড কাঁধে নিয়ে একে অন্যকে হিংস্র পশুর মতো আক্রমণ করছে, হত্যা করছে, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, খানকাহ ইত্যাদি দখল করছে আর ভেঙ্গে বা পুড়িয়ে মহাপুণ্যের কাজ করেছে বলে আত্মতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। এরা আলমে নাছুতে সর্বদাই অবস্থান করছে। এ সমস্ত নির্লজ্জ জঘন্য কাজে মারা গেলে শহীদ শহীদ বলে চিৎকার করতে থাকে। তথাকথিত জ্ঞানপাপীরা বুঝেনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম, ঈসা, মুসা, বুদ্ধ, শ্রী কৃষ্ণ আলায়হিমাস্ সালাম তারা ধর্ম বলতে কি বুঝিয়েছেন এবং কিসের বাণী তাঁরা প্রচার করেছেন। তারা ধর্মের মহাপুরুষদেরকে তাদেরই মতো মানুষ মনে করে তাদের অন্ধ মানসিকতার বন্ধ খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখতে চাচ্ছে আর সেই গন্ডীভূত মানসিকতার ব্যাখ্যা দ্বারা ধর্মকে বিকৃত করছে, সেই বিষপাষ্পে আক্রান্ত হচ্ছে মানব সমাজ।