পত্রিকা – হবে কিরে মন, শ্রী গুরুর ভজন – ১ম পর্ব

সালমা আক্তার চিশতী

ভজন ও পূজনে মিলবে মাওলার দর্শন। মুর্শিদের ভেদ রহস্য জানতে হলে তাঁর এশকের দরিয়ায় ডুব দিতে হবে। মানুষ যখন বায়াত হয় তখন মুর্শিদের প্রতি প্রবল বিশ্বাস-ভক্তির কারণে তার মনের ভেজালগুলো দূর করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঐ ভেজালগুলো হলো ছয় রিপু । যেমন, কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য। এই রিপুর তাড়নায় মানুষ গুরুকে ভুলে বিষয় মোহের পূজা করে।

যেমন, একটি বাঘের বাচ্চা যখন ছোট থাকে তখন একটি ভেড়ার সাথে খেলতে পারে আর যখন বাঘের বাচ্চাটি বড় হয়ে যায় তখন আর ভেড়ার সাথে খেলতে পারে না তাকে কিভাবে খাবে সেই আশায় তার মন ডুবে থাকে। তেমনি একজন মানুষের দশা, সে যখন শিশু থাকে তখন সবার সাথে মিশতে পারে এমনকি তার শত্রুর সাথেও। আর যখন সেই মানুষটি বড় হয় আস্তে আস্তে ছয় রিপু এসে ঐ মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে তখন সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তখন শুধু সুরতেই মানুষ থাকে, সিরাতে আর মানুষ থাকে না। তখন লোকটি স্বভাবে পশুর সমতুল্য হয়ে উঠে। কোরআনের একটি আয়াত আছে, “লাহুম কুলুবুন লা ইয়াব্কাহুনা বেহা ওয়া লাহুম আইনুন লা ইয়উবসেরূনা বেহা ওয়া লাহুম আজানুন লা ইয়াসমাউনা বেহা। উলাইকা কাল আনআমে। বালহুম আদাল্লুন। উলাইকাহুমুল গাফেলুনা।” অর্থাৎ তাদের দীল আছে বুঝে না, তাদের চোখ আছে দেখে না, তাদের কান আছে শুনে না। উহারাই চতুস্পদ জন্তুর মতো, তার চেয়েও নিকৃষ্ট। এরাই গাফেল, জাহান্নামী।

গুরু ভজনে মিলবে মাওলার দরশন আর যারা গুরুকে রেখে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করতেছে তারা হলো গাফেল লোক। কারণ, গাফেল যারা তারাই জাহান্নামী অজুদ নিয়ে হাশরে উঠবে।

আমার মুর্শিদ হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী তাঁর আলোচনার মাঝে বলতে থাকেন,
“একজন পাক মানুষ বা পরকাল প্রাপ্ত মানুষ নিজেই বেহেশত।”

তেমনি একজন অপবিত্র মানুষ নিজেই জাহান্নাম। আখেরে জাহান্নামীদের বাকশক্তি থাকবে না। মানুষ সৃষ্টির সেরা হয়েছে এই বাকশক্তির জন্য। কারণ, সাত+পাঁচ=বারো’র মিলন ঘটছে এই মানুষের মাঝে। একটি বানরের আকৃতি ঠিক মানুষের মত কিন্তু বানরটি চিড়িয়াখানায় থাকে কেন ? কারণ, সে পশু, তার বাকশক্তি নেই বলে। কোরানের মাঝে বর্ণনা আছে হযরত দাঊদ (আঃ)-এর নিষেধ অমান্য করে তাঁর যে সমস্ত উম্মতগণ শনিবারে মাছ ধরেছে তারা সবাই বানর হয়ে গেছে। শনিবারটা আসলে কি ? তা কি জানা জরুরী নয়? কোরানের সব ইতিহাসই বর্তমান। আর একজন এলমে ইলাহীর অধিকারী ব্যক্তি ছাড়া কোরানের ভেদ রহস্য বা কোরানের জ্ঞান লাভ করা কারো পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়। মাদ্রাসায় শিক্ষা দেয়া হয় ইলমুল কালাম তথা আক্ষরিক বিদ্যা, তা দিয়ে কোরান কখনো বুঝা সম্ভব নয়। কারণ, কোরানের ভাষাগুলো হলো রূপক। রূপকের অন্তরালে রয়েছে মূল ভেদ।

আমার দাদা হুজুর দেওয়ান শাহ রজ্জব আলী চিশ্তি নিজামী তাঁর একটি গানের মাঝে বলছেন, “হরিণীর নাভী মূলে মৃগনাভি, হরিণী তা খুঁজে পায় না।” আমাদের অচেতন মানব সমাজের দশা ঠিক তেমন সে তার মূল হারিয়ে, নিজেকে হারিয়ে এই মায়ার জগতের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। যেমন, আমাদের সবার ঘরেই শোকেস থাকে, এই শোকেসের মাঝে আমরা মূল্যবান সব কাঁচের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখি। কিন্তু আমরা এমন বে-খেয়ালি যে, আমাদের এই দেহ শোকেসের মাঝে আল্লাহ যে বিরাজমান আছে তাকে কি আমরা সাজিয়ে রাখছি, চিনেছি, আমি কে তা কি জেনেছি ? আমাদের দশা হলো আমার দাদা হুজুরের গানের মতো; আল্লাহকে ভুলে এই মায়ার জগতের চাকচিক্য নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি। আর গুরু ভজন করতে হলে এই মোহ মায়ার উপর নিরপেক্ষ হতে হবে, দুনিয়ামুখী ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একজন মানুষের চাকরি, ব্যবসা, কৃষি-কাজ, রিক্সা চালানো, পড়া-লেখা ইত্যাদি কিছুই ছাড়তে হবে না। সব কিছুর মধ্যে থেকেও যিনি মোহমুক্ত তিনি নাছুত সাগরে ভাসমান নূহের কিস্তী (কোরান)। যেমনÑ একটি আয়না যখন ঠিকঠাক থাকে তখন একজন মানুষের চেহারা দেখা যায়, আর যখন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তখন একই আয়নাতে অনেক রূপ দরশন হয়। মানুষের অন্তর জগতটা ঠিক এইরূপ, তা ঠিক থাকলে গুরুরূপ দরশন হবে, আর যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে গুরুর রূপ আর থাকবে না, বরং বহু রূপ দরশন হবে, কেবলা কাবা হারিয়ে ফেলতে হবে।

গুরুজ্ঞানের আলোকে একজন মুরিদের মনটাকে পরিশুদ্ধ করতে হবে তবেই আমরা একজন খাঁটি ভক্ত হতে পারবো। ভক্ত ঐ দেশে বাস করে যেই দেশে থেকে গোপীগণ কৃষ্ণকে, তাদের গুরুকে চরণ ধুলা দিয়েছিল। হযরত আলী (আ.) তাঁর গুরু মহানবী (সা.) এর কাঁধে উঠে কাবা ঘরের মূর্তি ভেঙেছিল। কিস্সাটি অনেক বড়। গুরুর মাথা ব্যথা ছিল কিন্তু ভক্তের চরণের ধূলা নারদ হাতে ধরার সাথে সাথে গুরুর মাথা ব্যাথা সেরে গেল। ভক্ত কি জিনিস শ্রীকৃষ্ণ তার স্ত্রীগণকে এবং নারদকে দেখিয়ে দিলেন। এই পরিস্থিতির নিগুঢ় ভেদ রহস্য রয়েছে তা মোটা বুদ্ধি দিয়ে বুঝা যাবে না। তা বুঝতে হলে গুরুজ্ঞানের আলো লাগবে । তবেই অহেদানিয়াতের দেশে ডুব দিতে পারবে । ঐ দেশে আর দুই নাই সব এক দেশের খেলা চলছে। ঐ দেশটাই হলো তৌহিদের দেশ। জাত কুলের জাতাজাতি থাকলে তৌহিদের দেশে প্রবেশ করা যায় না।

আমার মুর্শিদ হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী প্রায় সময় তাঁর আলোচনার মাঝে একটি গান বলতে থাকেন,
“তোর জাত কুলমান ছাড়তে পারলে প্রাণ বন্ধুকে পাবি।”

আমার দাদা হুজুর দেওয়ান শাহ রজ্জব আলী চিশ্তি নিজামি তাঁর একটি গানের মাঝে বলছেন,
“থাকলে লোক লজ্জা কুল কলংকের ভয় রজ্জব কয় যাইসনে সেইখানে।”

অর্থাৎ গুরুর করণ করতে গিয়ে লোকের মন্দ, অপবাদ, বাধা অপমান ইত্যাদি এবং হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি জাত কুলের ভেদাভেদ সামনে আসবে তা অতিক্রম করতে না পারলে গুরু ভজন করা যায় না, মানুষও হওয়া যায় না।

আমার দাদা হুজুর আরো বলছেন,
“গুরু ভজন সহজ কথা নয়, আমাতে আমিত্ব থাকিতে ভজন নাহি হয়।”

তিনি আরো বলছেন,
“হিংসা ভরা হৃদয় নিয়ে মিছে ধর্মের গল্প করো, আগে জাতির গৌরব ছাড়ো।”

গুরু ভজন করা মানে অসাধ্যকে সাধ্য করা, মনকে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা, মোহমুক্ত হওয়া, আমিত্ব ত্যাগ করা বা মুক্ত হওয়া। আমিত্বই দুনিয়া, দুনিয়া নিয়ে গুরু ভজন হয় না। যেমন, আমরা সাবান দিয়ে যখন হাত ধুই তখন হাতের ময়লা পরিষ্কার হয়ে যায়, তেমনি গুরুর কাছে যাওয়া মানে গুরুর কালামগুলো হলো সাবান, বিশ্বাস-ভক্তি-প্রেমযোগে তা শ্রবণ এবং তাঁর হুকুম নির্দেশের অনুসরণ করলে একজন মুরিদের মনের সমস্ত ময়লাগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। তা এক দিনে সম্ভব নয়, আবার হতেও পারে। তবে গুরু প্রেম যার হৃদয়ে জাগ্রত সেই মানুষের দেহে পাপ থাকে না (সুরা ইমরান-৩১)। সেই অচেনাকে চিনতে হলে বিরামহীনভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে তবেই তার দেখা মিলবে ও এই মায়াময় জগত থেকে মুক্তি মিলবে। একজন লেখক বলছেন, “মানুষের জীবনটাকে চায়ের কাপের সাথে তুলনা করা যায়, কাপের চা যতই তলার দিকে যায় মানুষের জীবনটা ততই শেষের দিকে অগ্রসর হয়।” কিন্ত আমার কথা হলো একজন গুরুভক্ত গুরু ভজন করতে করতে (আমিত্বের পরিশুদ্ধির সাধনায় জয়ী হয়ে) অমরত্ব লাভ করে, মৃত্যুকে জয় করে, তার লয়Ñক্ষয়, ধ্বংস নেই।

মানুষের সাধনাই হলো মৃত্যুকে জয় করে চিরঞ্জীব হওয়া এবং আল্লাহর বাকশক্তি কায়েম রাখা। তা খোদার ফেৎরাতকে ধারণ করতে পারলেই হবে, তখনই আল্লাহর ছুরত প্রতিষ্ঠিত হবে, মৃত্যুকে জয় করা হবে এবং তার মানব ছুরত আর ধ্বংস হবে না। দেহ এবং দেহী কি জিনিস এই দু’য়ের প্রভেদ বুঝতে পারলে মানুষের সাধনা কিসের জন্য তা জানা যায়। কোরানুল করিমে সূরা আর-রহমানের ২৬-২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “কুল্লুমান আলাইহা ফা’ন। ওয়া ইয়াব্কা ওয়াজহু রাব্বিকা জুল্ জালালি ওয়াল ইকরাম।” অর্থাৎ ইহার উপর সমস্ত কিছুই ধংসশীল। এবং বাঁকা হয় তোমার রবের চেহারা, যা জালাল এবং কেরামতের অধিকারী। এই থেকে বুঝা যায় রবের চেহারা রয়েছে। রবের চেহারা ধারণ করা ঈমানদারদের জন্য সহজ আর যাদের ঈমান নড়বড়ে তাদের জন্য অনেক কঠিন। কারণ, একজন মানুষের মুক্তি সুন্দর স্বভাবের বলেই। হযরত খাজা বাবা গরীবে নেওয়াজ (রাঃ)-এর রঁওজায় জিয়ারতের জন্য যারা যায় রঁওজার ভিতরে ময়ূরের পাখা দিয়ে জিয়ারতকারীদের মাথায় স্পর্শ করানো হয়। এর ভেদ রহস্য কি তা জানতে হবে। যদিও এই নিয়ম অনেক ওলীদের মাজার বা রঁওজায়ই প্রচলিত আছে। আমাদের সমাজে কোনো মানুষ যদি অপকর্ম করে তবে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বলা হয় ঝাড়–র বারি দেওয়া উচিত, ইহা অপমানজনক কর্ম। কিন্তু একজন পবিত্র মানুষের বা পরকাল প্রাপ্ত মানুষের বা ওলীর রঁওজার বা মাজারের ধূলা জিয়ারতকারীর মাথায় পড়লে অবশ্যই সে উছিলায় আল্লাহপাক তার মনের মকসুদ পূর্ণ করে দেন, আখেরাতের দরজা খুলে দেন, তাঁর মাগফেরাত হয়ে যায়, মন মস্তিস্ক হতে দুনিয়া বের হয়ে মন গুরু প্রেমিক হয়ে যায়।

আপন খবর