ছালমা আক্তার চিশতী
এই পৃথিবীতে আল্লাহপাক সবই করেন তাঁর ওলীদের মাধ্যমে। এই কথার ভেদ বুঝা সবার কপালে জুটে না। কারণ, সব তরিকতপন্থীরা গুরুর নীতি আদর্শকে ধারণ করতে পারে না; এ অবস্থানটি পূর্বে থেকেই ঘটে এসেছে আর তা এখন বর্তমানেও ঘটে চলেছে। যারা ঈমানদার তারা এই কথার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন। যারা বায়াতই হয়নি তারা অবশ্যই ঈমানদার নয়, তারা ওলীদের প্রতি বিশ্বাসী নয় বা মাজার বা রঁওজায় বিশ্বাসী নয়। মুক্তির দরজাটি একমাত্র ঈমানদার বা বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে। একজন মুরিদের অবস্থা আর একজন বে-মুরিদের অবস্থা এক নয়। মুর্শিদের ভেদ রহস্য জানা সহজ নয়। যিনি গুরু ভক্ত হয়েছেন তিনিই তার ভেদ রহস্য জানেন। লালন সাঁইজী বলছেন, “যেই জন শিষ্য হয়, সে গুরুর মনের খবর লয়।” গুরুর মনের খবর লওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। আমার মতো নরাধম তার আভাসটুকুও পাইনি। বায়াত হওয়ার পর থেকে একজন মুরিদের পথ চলা শুরু হয়। যেমন, একটি টিস্যু বক্সের মাঝে টিস্যুগুলো ভাঁজ করে রাখা হয় মানুষের যখন প্রয়োজন হয় তখন তা বের করতে পারে, কোনো প্রতিবাদ নেই। তেমনি একজন শিষ্যের অবস্থা। গুরুর যেই ভাবে খুশি তাকে চালাবে, নির্দেশ দিবে। যতো কঠিন হোক ভক্ত তা পালন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। এই জন্য কোরানে বর্ণিত হযরত খিজির ও হযরত মুসা (আঃ)-এর ঘটনাটি স্মরণে রাখতে হবে, কিভাবে গুরুকে অনুসরণ করতে হবে!
তবে ভক্ত আর শিষ্যের মধ্যে অনেক প্রভেদ রয়েছে। ভক্ত হলে তা পালন করা সম্ভব হয়। আমরা হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ, হযরত জালালুদ্দীন কোবরা, হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম, হযরত রাবেয়া বসরী, হযরত হাফেজা জামাল (খাজা বাবার মেয়ে) বা অন্যান্য ওলীদের ঘটনা হতে গুরুভক্তের পরিচয়, গুরুর প্রতি একনিষ্ঠ দৃঢ় বিশ্বাস এবং গুরুর খেদমতের ইতিহাসগুলো দেখতে পাই। বলা হয়, ‘আমলে মিলে আমালিয়াত আর খেদমতে মিলে কামালিয়াত।’ এই খেদমতের পথেই ওলীদের কামালিয়াত হাছিল হয়েছে। কোরানে ইহাকে বলছে ‘এতায়াত করো’ জান-মাল উৎসর্গ করে গুরু বা মুর্শিদের খেদমত করো। এই পথে যত বাঁধাই আসুক তার বিশ্বাস-ভক্তি-প্রেমের বলে সে সমস্ত বাধা জয় করা যায়। আর মুরিদের মনের মাঝে যদি ভেজাল থাকে, বিশ্বাসে সমস্যা থাকে তবে আর মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। তার পরম সম্পদ আদব-নম্রতা, তমিজ-তাজিম হারিয়ে জাহান্নামী অজুদ সৃষ্টি হতে থাকবে। আমাদের অচেতন মুর্দা সমাজে, উলঙ্গ সমাজে অথবা বায়াত হওয়ার পর গুরুর প্রতি যাদের বিশ্বাস-ভক্তির ঠিক নেই তারা গুরুভক্তকে নানা রকম সমালোচনা করে থাকে, আল্লাহর করুণা হতে বঞ্চিত বিধায় তাদের এই দশা হচ্ছে-এটা তারা বুঝতে পারে না। কারণ, গুরুর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি মানেই হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি। সুরা ইমরানের ৩১ নম্বর আয়াতটি তার প্রমাণ। কারণ, বায়াতের অঙ্গীকার হলো একমাত্র আল্লাহর সাথে, উছিলা হলো মানব গুরু, তবে প্রভেদ নেই, অভেদ হয়েই আছে। ইহা বিকৃত স্বভাব থাকতে বুঝবেও না- ইহাই জাহান্নামী হওয়ার লক্ষণ। আমাদের দরবারের নিকট ২/৩ জন লোকেরও (ওরাও মুরিদ ছিল) এই দশা, আমি নিজেই দেখেছি। ওরা ভয়ংকর মুনাফিক, অগ্নি পূজারী, ব্যক্তিস্বার্থের কৃতদাস। তাদের দীলে, চোখে এবং কর্ণে মোহর মারা রয়েছে, গুরুর বাণী তাদের কর্ণে মাত্রই প্রবেশ করছে না। তারা একের পর এক জাহান্নামী অজুদ সৃষ্টি করে চলছে, অথচ নিজেকে সঠিক বলে লোক সমাজে তুলেও ধরছে। কোনো বুঝ-সমুঝ তাদের দীলে নেই, বিশ্বাস-ভক্তির মারাত্মক সমস্যা, দো-দীল বান্দা। কারণ, গুরুর অঙ্গীকার থেকে বের হয়ে যাওয়া, তাঁর বিরোধিতা করা মানে ধর্ম হতে মুরতাদ হয়ে যাওয়া, এরা হলো জাহান্নামী লোক। তাদের এ ধরনের পশুত্ব স্বভাবের পরিণতির উৎকৃষ্ট জবাব আল্লাহপাকই তাঁর হাবিব মুহাম্মদ রাছুলের মাধ্যমে দিয়েছেন সুরা লাহাব এবং সুরা মুনাফেকুন তার প্রমাণ। আমাদের মুর্শিদ সর্বদাই এই কথা বলে যাচ্ছেন। যারা জাহান্নামী হবে তারা নিজেদের ভুলগুলো ধরতে পারবে না। যাক, তথাকথিত মুসলিম উলঙ্গ-মুর্দা সমাজে মেয়েদের জন্য তো আরো সমস্যা, গুরু ভজনের পথে শত অপবাদ তার মাথায় এসে পড়বে, যেমন, একদল আলেম সমাজ কঠোর সমালোচনা করেছিল হযরত খাজা রাবেয়া বসরী (রাঃ)-এর ক্ষেত্রে । তাঁর প্রধান দোষ তিনি বিবাহ করেননি। জাত-কুলের ভেদাভেদ, উলঙ্গ, মুর্দা সমাজের বিরোধীতা করে যে গুরুর করণ করে থাকে তার মানব জনমে সার্থকতা মিলবেই। এই জন্য লালন সাঁইজী বলছেন, “যায় যাবে ছাই জাত কুলমান, আমার তাতে ক্ষতি নাই। যদি আমার প্রাণ বন্ধুরে পাই।” ইহাই একজন সাধকের মনের কথা হতে হবে। আমরা কাকে ভয় করবো? গুরু ভজন করতে কাকে লজ্জা করবো ? কেনো করবো ? সমাজে তো সাড়ে পনের আনাই উলঙ্গ, মুর্দা, বিচিত্র সুরতধারী লোক, স্বভাবে গরু, ছাগল, শুকর, বানর, বাঘ, ভাল্লুক ইত্যাদি, শুধু আকৃতিটুকু মানুষের। সত্যিকারের মানুষ তাদেরকে ভয় অবশ্যই করবে না। তবে গুরুকে ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা, সম্মান করতে হবে-ইহা ইবাদত। মানুষের এবাদত হলো এই মানব সুরতকে অটল রাখা। লালন সাঁইজি তাঁর একটি গানের মাঝে বলছেন, “সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার।” ‘নিষ্ঠা’ অর্থ হলো একাগ্র চিত্তে গুরুতে মন নিবিষ্ট করে রাখা। গুরু ভিন্ন অন্য কিছু হতে মন তুলে নেয়া।
আমার মুর্শিদ হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী, যখন তাঁর গান গাওয়ার ইচ্ছা হয় তখন তিঁনি এই গানটি প্রথমেই গেয়ে থাকেন। এই গানের মূল ভেদ রহস্য জানতে হলে আধ্যাত্মিক এলেম লাগবে। জীবজন্তুর মগজ দিয়ে মাওলার ভেদ রহস্যের দরিয়ায় সাঁতার দেওয়া যায় না। মাওলার ভেদের দরিয়ায় সাঁতার দিতে হলে খোদার কালামগুলো শুনতে হবে। ভালো করে শুনে দীলে ধারণ করলে উত্তম সিরাতের অধিকারী হওয়া সম্ভব। যেমন, একটি গরু সে শুধু ঘাস খাওয়াটাই বুঝবে, গরুর কিন্তু পোলাও, কোরমা খাওয়ার তকদির নেই এই রিজিকটা শুধু মানুষের। তেমনি একজন সাধারণ লোক আর একজন ইনছানুল কামেলের মাঝে আকাশ জমিন পার্থক্য। একজন ইনছানুল কামেল লালন সাঁইজীর এই গানটির ব্যাখ্যা দিতে পারবে আর সাধারণ লোকটি কি তা পারবে ? একজন কামেল গুরুর কাছে না গেলে ঐ আধ্যাত্মিক দেশের ভেদ রহস্য বুঝার উপায় নেই। আর ঐ আধ্যাত্মিক এলেম অর্জন করতে হলে একটি মোমের বাতির মত হতে হবে। গুরুর যখন ইচ্ছা তখনই মোমের বাতিটিকে জ্বালাতে পারবে। সাধারণ মোমের বাতি আর গুরুর মোমের বাতি আলাদা, সাধারণ মোমের বাতির আলো ছড়ানো আর গুরুর মোমের বাতির আলো ছড়ানো এক বিষয় বস্তু নয়। সাধারণ আলো দিয়ে অন্ধকার দূর হয় আর গুরুর আলো দিয়ে, নূর দিয়ে একজন মুরিদ বা শিষ্যের দীলের অন্ধকারগুলো দূর হয়ে যায়, আখেরাত প্রাপ্ত হয়-মুক্তি লাভ করে। ভক্ত নিজেই আদব-নম্রতায় মোমের বাতিতে পরিণত হলে সেই ভক্ত হৃদয়ে নূরের জাগরণ ঘটে।
গুরুর কাছে মুরিদ হওয়াটা সহজ আর গুরুর ভক্ত হওয়াটা অনেক কঠিন। কারণ, একজন ভক্তই গুরুর নিগুঢ় ভেদ রহস্য জানতে পারে। ভক্তের দরজা অনেক উচ্চ স্তরে, আমাদের মতো শুষ্ক মন দিয়ে, ভজনবিহীন মন দিয়ে তা কোনো দিন সম্ভব নয়। হিন্দুদের কীর্ত্তনের মাঝে শিল্পীরা বলতে থাকে, “আছে ভক্তের হাতে প্রেমের ডুরি, ভক্ত যে দিক ঘুরায় সেই দিক ঘুরি।” এই ভক্ত দুনিয়া বিবর্জিত অবস্থায় বাস করে, সর্বদাই গুরুর ধ্যানে-দিদারে কায়েম থাকে, সে বাস করে প্রেম সাগরে। লোক সমাজে তার চাল-চলন সম্পূর্ণ আলাদা। গুরু ভক্তের শক্তি অনেক, যদি কেউ সত্যিকারের গুরুভক্ত হয়ে যায়, গুরু নিজ রূপ ঐ ভক্তের মধ্যেই দেখতে পায়। আমরা দুনিয়ায় ডুব দিয়ে গুরুকে ধারণ করতে চাই দেখেই আমাদের সে শক্তি অর্জন হয় না। খাজা ওয়ায়েস ক্বরণী পেরেছিলেন, ভক্ত হনুমান পেরেছিলেন, হযরত আমীর খসরু পেরেছিলেন। আমাদের মুর্শিদ বলেন, এই ধরনের ভক্ত হলো গুরুর গুরু। সেই ভক্তের প্রতিই গুরুর দৃষ্টি চলে যায়, গুরুই তার হয়ে যায়। যেমন গিয়েছিল নবীজির ওয়ায়েস ক্বরণীর প্রতি, নিজামউদ্দীন আউলিয়ার তাঁর ভক্ত আমীর খসরুর প্রতি। তখন কে কার কাবা তা বুঝা যায় না। কোরানে “ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্ নাবীয়ি”-এই আয়াতে তাঁর প্রমাণ রয়েছে। আমাদের মুর্শিদ প্রায়ই এই আয়াতের ভেদ আমাদের শোনাতেন। ভক্ত হওয়ার জন্য একজন শিষ্য সাধনা করবে কিন্তু সব শিষ্য সেই দেশে যেতে পারে না বিশ্বাস-ভক্তির কারণে, সেই দেশটা হলো এক তৌহিদের দেশ। যে গুরু ভক্ত হয়ে যাবে সে এই তৌহিদের দেশে বাস করবে। যেমনÑ একজন মানুষ একটি বিদেশী ফল মুখে দিলে সেই ফলটির স্বাদ অন্য আরেক জন মানুষ বলতে পারবে না, ঐ বিদেশী ফলটির স্বাদ কি রকম তা না খেলে বুঝা যাবে না। তেমনি গুরুর তৌহিদের সাগরের মাঝে ডুব না দিলে সেই দেশের ভেদ রহস্য উন্মোচিত হবে না। গুরু যাকে তৌহিদের দেশে নিয়ে যাবে তার চাল-চলন, কথা বলার ভঙ্গিমা আলাদা থাকবে। শত কষ্ট হলেও সে গুরুর ইচ্ছার বাইরে চলবে না। কারণ, মুরিদ মানেই নিজ ইচ্ছা উৎসর্গ করা। উৎসর্গ করতে পারলে সে ভক্ত হয়ে যাবে। নিজ ইচ্ছা রাখলে গুরু ভজন হবে না, হবে গোবিন্দ ভজন।
আমার কেবলা কাবা গুরু কাজী বেনজীর হক চিশ্তি নিজামী তাঁর আলোচনার মাঝে অনেক সময় বলতে থাকেন – ‘গুরুকে থুইয়া যে গোবিন্দ/আল্লাহ ভজে সেই পাপি নরকে মজে।’
আমার দাদা গুরু দেওয়ান শাহ্ রজ্জব আলী চিশ্তি নিজামী একটি গানের মাঝে বলছেন- ‘সোনাতে সোহাগা দিলে দুই বস্তু এক যোগে চলে, গুরু শিষ্য এমনি হলে যাওয়া যেত জাতে মিশে।’