হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
‘রহস্যময় সৃষ্টি’ নামক কিতাবে বর্ণিত আছে যে, এমন এক সময় ছিল যখন এই বিশ্ব ছিল অন্ধকারময় তথা অঘোর। বিশ্বের কোনো আকার ছিল না। এই রূপে বহু বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পর বিশ্ব কুয়াশাচ্ছন্ন রূপ ধারণ করলো। মহান প্রভু শক্তি রূপে ডিম্বের আকৃতি ধারণ করে এই কুয়াশার মধ্যে অবস্থান করেন। বহু বৎসর এইভাবে কাটালেন। হঠাৎ মহান প্রভু তাঁর স্ব-ইচ্ছায় হু-হা-হে তিনটি শব্দ করলেন। তিন শব্দে প্রভু তাঁর রূপ পরিবর্তন করে নিলেন। এই অবস্থায় ৪০ বৎসর কাটিয়েছিলেন।
৪০ বৎসর পর পুনরায় সৃষ্টির কথা মনে করেন। ডিম্বের এক অংশ আল্লাহর নিজ রূপ বা গুণ মিশিয়ে কুদরতের মাধ্যমে রূহে মোহাম্মদী সৃষ্টি করলেন [আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু রূহ]। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের রূহ সৃষ্টি করে আল্লাহপাক জিজ্ঞাসা করলেন – ‘আল আস্তবে রাব্বিকুম’ অর্থাৎ আমি কি তোমার রব নই? রূহ হতে উত্তর আসলো -‘আনতা আনা’ অর্থাৎ আমি তোমাকে চিনি না। এক হাজার বৎসর এভাবে কেটে গেলো। তারপর পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন ‘আল আস্তবে রাব্বিকুম’ – আমি কি তোমার রব নই? পুনরায় একই জবাব আসলো ‘আনতা আনা’। আবার পাঁচশত বৎসর পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আল আস্তবে রাব্বিকুম?’ এবারও জবাব আসলো ‘আনতা আনা’। আল্লাহপাক ভাবলেন আমার সৃষ্টি আমাকে চিনে না। তাই তিনি চিন্তা করে দেখলেন, রূহানী খাদ্য কুদরতী বাতাস যদি বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে দেখা যাক কি উত্তর আসে। আল্লাহপাক তাই করলেন এবং সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘আল আস্তবে রাব্বিকুম?’ বাতাস বন্ধ করার সাথে সাথে রূহ নড়াচড়া দিয়ে উঠলেন এবং সাথে সাথে জবাব দিলেন ‘কালুবালা’ অর্থাৎ তুমিই আমার প্রভু (রব) সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহপাক খুশি হয়ে রূহানীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কুদরতী এক আয়না তৈরী করে তাঁর সামনে ধরলেন। আয়নায় নিজ রূপ দেখে পর পর পাঁচটি সেজদা দিলেন। এই পঞ্চ সেজদাই পাঁচ সালাত ও পাঁচ ইয়াকীন নামে পরিচিত [ রহস্যময় সৃষ্টি – ৫/৬ পৃষ্ঠা]।
‘তাওয়ারিখে মোহাম্মদী’ কিতাবের প্রথম খন্ডের ৪/৫ পৃষ্ঠায় রাবি আবদুল জলিল হতে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহপাক চার শাখাযুক্ত একটি বৃক্ষ তৈরী করে তার নাম রাখলেন ‘শাজারাতুল ইয়াকিন’ মানে বিশ্বাসের গাছ। সে গাছে নূরকে শ্বেত মুক্তা সদৃশ ময়ূরবেশে গঠন করে সত্তুর হাজার বৎসর বসিয়ে রাখলেন। পরে আল্লাহপাক শরমের এক আয়না সৃষ্টি করে (কারো মতে এরফানি আয়না ছিল) ময়ূরের সামনে ধরলেন। সে আয়নাতে ময়ূর নিজ রূপ দরশন করে ভয় পেলেন এবং তাতে সে নূর পাঁচটি সেজদা করলো। সে পাঁচ সেজদা হতেই পাঁচটি সালাত সৃষ্টি হয়েছিল। আর সে নূরের শরীর হতে যে ঘাম বের হয়েছিল তা হতে আঠার হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেন। তাঁর মাথার ঘাম হতে ফেরেশেতা সৃষ্টি হলো। ‘কপালের’ ঘাম হতে আরশ, কুরশি, লওহ, কলম, চন্দ্র-সূর্য, বেহেশত- দোযখ, গ্রহ-নক্ষত্র, হিজাব সৃষ্টি হলো। ‘সিনার’ ঘাম হতে আম্বিয়া-আউলিয়া, আবেদ, শহীদ, ইমাম, সমস্ত ভালো তাতে সৃজন করলেন। ‘চেহারার ’ ঘাম হতে যতো নবীর উম্মত সৃষ্টি হলো। ‘কানের’ ঘাম হতে ইহুদি, নাসারা, মজুছীর জান তৈরী হলো। ‘বগলের’ ঘাম হতে জিন জাত শয়তান সৃষ্টি হলো। ‘দুপায়ের’ ঘাম হতে অবশিষ্ট সমস্ত কিছু সৃষ্টি হলো।
সে নূরের ‘নাভী’ হতে সাত ফোটা নূর ঝড়েছিল, তা হল আকল, ইলেম, ফাকা, হায়া, ছবর, মেহের এবং তৌহিদ নামক সাতটি দরিয়া পয়দা হয়েছিল। এরপর ময়ূরকে হুকুম করলেন সামনের দিকে তাকাতে। নূর সামনের দিকে তাকিয়ে এক উজ্জল নূর দেখতে পেলেন। আর চারদিকে চারটি নূর তাকে ঘিরে রয়েছে। এ চারটি নূরই হলো হাবিবে খোদা মোহাম্মদ রাছুল সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের পবিত্র আহলে বাইয়েত আলী, ফাতেমা, হাসান এবং হুসাইন আলাইহিস সালাম। হযরত আদম আলাইহিস সালাম এ নূর পঞ্চক তথা পাক পাঞ্জাতনের উছিলাতেই মুক্তি পেয়েছিলেন। কোনো কোনো বাজে বর্ণনা হতে জানা যায়, ঐ চারজন ছিল আবু বকর, ওমর, ওসমান এবং আলী – তা মোটেও সঠিক নয়। নূর পঞ্চক বা পাক পাঞ্জাতন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এ ধরনের বাজে বর্ণনা অনেক বই-পুস্তকে লিখে রেখেছে। ‘সহিহ’ কথাটি বইয়ের মলাটে লিখলেই সত্য বলে স্বীকার করা যায় না, যদি না তার আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিশ্লেষণে সঠিকতার প্রমাণ না মিলে, কোরানের মুহকামাতের সাথে সামঞ্জস্য না হয়। কারণ আত্মার জ্ঞানই হলো ধর্ম জ্ঞান।
আত্মার জ্ঞান যখন নবুয়তে ওহী হয় তখন তা মুতাশাবেহাত হয়ে আসে তথা রূপক-প্রতীক হয়। রূপক-প্রতীকের অর্থ করতে আল্লাহপাক নিষেধ করছেন (সুরা ইমরান)। রূপক-প্রতীক দ্বারা কি বুঝানো হচ্ছে সেটা জানাই হলো কোরানের জ্ঞান লাভ করা বা ধর্ম জ্ঞান লাভ করা। সে জ্ঞান যার নেই তার দ্বারা ধর্ম কথা বলা মানেই ধর্ম বিকৃত করা। ধর্মজ্ঞান রয়েছে পরকাল প্রাপ্ত মানুষের নিকট বা প্রেরিত পুরুষের নিকট তথা ইনছানুল কামেলের নিকট। এটা মাদ্রাসায় খুঁজলে কোনো দিনই পাওয়া যাবে না, বরং মাদ্রাসার বিদ্যা বা ইলমুল কালাম সে ইলেমের সম্পূর্ণ বিপরীত। কোরানের মুতাশাবেহাত এবং তার মুহকামাত চিনলে সে ভেদ জানা যাবে। জানা দরকার ইলেম দু-প্রকার ( মেশকাত, আত তারগীব ওয়া তাহরীব -১ম খন্ড)। একটি ইলমুল লেছানী এবং অপরটি ইলমুল ক্বালবী। হযরত আবু হুরায়রার ভাষায় একটি সবাই জানে অপরটি যা গোপন, সিনার ইলেম তা প্রকাশ করলে তার গলা কাটা যাবে ( বোখারী শরীফ)। এ গোপন ইলেমটিই হলো ইলমে মারেফত বা আত্মার জ্ঞান তথা কোরানের জ্ঞান। এ জ্ঞানের অধিকারীগণই হলে গুরু বা পীর বা মুর্শিদ। এ ইলেম আল্লাহ পরিষদের ব্যক্তির বা পরকাল প্রাপ্ত মানুষের বা প্রেরিত পুরুষের সিনায় নাযিল হয় এবং সিনায়ই রক্ষিত থাকে। এ ইলেম আল জবরুতে যখন প্রকাশ হয় তখনই তা রূপক-প্রতীক হয়ে আসে। নবুয়তে ইহা ওহী এবং বেলায়েতে ইলমে লাদুন্নী বলে বিধৃত আছে। যার বেলায়তী ইলেম নেই ইলমে নবুয়তের ভেদ (যা রূপক-প্রতীক, আলংকারিক) তার বুঝা কখনো সম্ভব নয়। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এবং আল্লাহর ওলী হযরত খিজির আলাইহিস সালামের ঘটনা হতে তার শিক্ষা নেয়া যেতে পারে।
ইমাম আবদুর রাজ্জাক [ইমাম বুখারী দাদা ওস্তাদ এবং ইমাম মালেকের সাগরিদ] তার ‘মোসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক’ নামক হাদিস গ্রন্থে সনদ ও সূত্র পরম্পরায় বিশিষ্ট সাহাবী হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন। হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বলেন, আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উপর আমার পিতা মাতা উৎসর্গীত হউক, আল্লাহ সর্বপ্রথম কোন্-বস্তু সৃষ্টি করেছেন? উত্তরে নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বললেন, “হে জাবের, আল্লাহ তা’য়ালা সর্বপ্রথম আপন বা নিজ নূর হতে তোমার নবীর নূর পয়দা করেছেন।” তারপর আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী ঐ নূর পরিভ্রমন করতে লাগলো। ঐ সময় না ছিল লওহ মাহফুজ, না ছিল কলম, না ছিল বেহেশত-দোযখ, না ছিল আসমান-জমিন, সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র, ছিল না জিন-ইনছান। তারপর আল্লাহপাক অন্যান্য বস্তু সৃষ্টির মনস্থ করলেন, তখন সেই নূর বারো ভাগে বিভক্ত করে সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলেন।
উক্ত হাদিসটি পরবর্তীতে হাদিস বিশারদগণ নিজ নিজ কিতাবে সংকলিত করেছেন। যেমন, ইমাম কাস্তুলানীর রচিত নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের জীবনী গ্রন্থ ‘মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়ায়’ উক্ত হাদিসটি সংকলন করেছেন। মিশরের আল্লামা ইউসুফ নাব্হানী তার ‘আনোয়ারে মোহাম্মদী’ কিতাবে তুলে ধরেছেন। উক্ত হাদিসে ‘মিন নূরিহী’ শব্দটির ব্যাখ্যা মোল্লা আলী ক্বারী মিরকাত শরীফে লিখেছেন – ‘আয়-মিন লামআতে নূরিহী’ অর্থাৎ আল্লাহপাক স্বীয় জাতি নূরের জ্যোতি দিয়ে নবীজির নূর সৃষ্টি করেছেন। যোরকানী ‘মিন নূরিহী’ এ কথাটির ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘মিন নূরিন হুয়া জাতুহু’ অর্থাৎ আল্লাহর জাত বা সত্ত্বা হলো নূর। সেই জাতি নূরের জ্যোতি হতেই নূরে মোহাম্মদী পয়দা হয়েছে। আল্লাহ এবং নবী একই নূরের দুই রূপ। যে আল্লাহ এবং মোহাম্মদ একই নূরের বলে বিশ্বাস করে না, সে নিশ্চয়ই অন্ধ-মূর্খ-জাহেল এবং কাফের। হাজি ইমদাদুল্লাহ মোহাজের মক্কী চিশতী সাবেরীও বলছেন, আল্লাহ এবং মোহাম্মদ একই নূরে, এ কথা যারা বিশ্বাস করবে না তারা কাফের। এ কথা শুনে দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান ছয়জন ওহাবী মৌলবী যার তার মুরিদ ছিল তারা তাঁর বিরোধিতা করেছিল বিধায় তিনি তাদেরকে তাঁর তরিকা হতে খারিজ করে দিয়েছিলেন। সে খারেজী মুরতাদ মুরীদগণ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলে তিনি তখন মক্কায় চলে গিয়েছিলেন। তাদের নামগুলো এ বইয়েই পাবেন বা ‘পরহেজগারীর আড়ালে ওরা কারা!!!’ বইটিতে দেখতে পাবেন। সেই খারেজীগণের গোলাবী ওহাবী (বর্ণচোরা) তরিকা আমাদের বাংলাদেশে বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে এবং মানুষকে খারেজী তরিকায় দাখেল করে পথভ্রষ্ট করে চলছে।