হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
আল্লাহপাক বলেন, “ফাকতুলু আনফুসাকুম জালিকা খাইরুল্লাহকুম ইন্কুন্তুম তা’লামুন” অর্থাৎ- অতএব তোমাদের নফসকে কতল করো, ইহাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জ্ঞানী হয়ে থাকো। এ কথা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম এবং অন্যান্য মহাপুরুষগণও বলছেন। কাজেই কোরানের নির্দেশ হলো মানুষকে ঐক্যতায় নিয়ে আসা। নির্বোধগণ বুঝেছে অন্য ধর্মের (প্রচলিত ধর্ম) মানুষের গলায় ছুরি চালানো এবং এ ভাবেই শুরু হয় একে অন্যকে আক্রমণ করার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। আক্রান্ত না হলে আক্রমণ করা দ্বীন-এ-মুহাম্মদীর পরিপন্থী। ‘আসলে নফসে আম্মারায় আক্রান্ত ব্যক্তিই বে-দ্বীন, তার কোনো ধর্ম নেই।’ যদি না সংশোধনের কোনো চেষ্টা থাকে। সংশোধনের চেষ্টায় রতো ব্যক্তিগণকে পর্যায়ক্রমে আমানু, মুত্তাকিন বলা হয়েছে কোরানে। নিজের দেহের মধ্যে কাফেরের ঘাঁটি, আর মানুষ হত্যা করে কাফের নিধনের ফতোয়ার কাঁদা ছুড়াছুড়ি করছে অন্ধ-বধির আলেম-মোল্লাগণ। চটকদার বেশ-ভূষণের আড়ালেই বাস করছে কাফের শয়তান, অথচ এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হতে তারা বেখবর।
“মানবাত্মার গুণ-খাছিয়ত অর্জন করাই হলো মানবধর্ম বা আল্লাহর দ্বীন মানে দ্বীন-এ-মুহাম্মদী বা ইসলাম।”
খাঁটি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আর মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই- সমস্ত মহাপুরুষগণ এ কথাই মানুষকে বুঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু ধর্মচোরারা যুগে যুগে তা বিকৃত করেছে, স্বীয় ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করছে, ফলে ধর্মের নামে শত-সহস্র মতান্তর, মতভেদ এবং দ্বন্দ্ব-বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। কোরানুল কারিমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, “ইন্নাছ্ছালাতা তানহা আনিল ফাহশাই ওয়াল মুনকার” অর্থাৎ নিশ্চয়ই ছালাত সমস্ত অশ্লীল কর্ম হতে (মুছল্লিকে) বিরত রাখে। কই, সাড়ে পনেরো আনা’ইতো অসৎ কর্মে লিপ্ত, অধিকাংশ ইমাম সাহেবেগণও তো পিছিয়ে নেই, বরং তারা প্রতিযোগিতায় নেমে আছে। তবে কি আল্লাহর বাণী ভূল, না ছালাত হয়নি ? আসলে ছালাত আদায়ই হয়নি এবং তার অর্থও বুঝেছে আক্ষরিক বা মুতাশাবেহাত, মুহকামাত বুঝেনি। “ছালাত” শব্দটি বহু অর্থবোধক শব্দ। স্বভাবের কু-প্রবৃত্তি ছেড়ে সুপ্রবৃত্তির দিকে ধাবিত হওয়া ছালাত এবং তাতে কামিয়াবী হওয়া ছালাত, প্রেমাগ্নি জাগ্রত করা ছালাত, নিজেকে অণু অণু করে বিশ্লেষণ করে দেখার নাম ছালাত, মানুষ এবং অন্যান্য জীবের মঙ্গল করা এবং মঙ্গল কামনা করাও ছালাত, ছালাত মানে দেখা ইত্যাদি। ছালাতের মূল মর্ম হলো খোদাকে দেখা। যিনি খোদাকে দেখেন তার ছালাতই হলো কোরানিক ছালাত-ছালাতুল মেরাজ।
তাহলে দেখা যাবে ছালাত সমস্ত মন্দ কর্ম হতে অবশ্যই মুছল্লিকে দূরে রাখবে। শুধু আনুষ্ঠানিক ছালাত, সিয়াম বা অন্যান্যতে তো তা হবে না। যারা আত্মশুদ্ধির ক্রিয়া ছেড়ে শুধু বাহ্যিক আনুষ্ঠানিক উপাসনাতে রতো থাকে, আর ভেড়ার দলের মতো মসজিদ, মন্দির, গির্জায় দৌঁড়াতে থাকে, তাদের দ্বারাই ঘটে ধর্মের নামে অধর্মের ক্রিয়া-কর্ম। আসলে এরা উপাসনার নামে ¯্রষ্টার সঙ্গে উপহাস করে থাকে এবং তাদের দ্বারাই পৃথিবীতে সরবে বা নিরবে জঘন্য কাজকর্ম সংঘটিত হতে থাকে। সত্যি বলতে কি আমরা যারা আনুষ্ঠানিক ছালাতগুলো আদায় করছি ঘরে বা মসজিদে, তাদের মধ্যে সাড়ে নিরানব্বই জনেরই কেবলার দিকে মুখ নেই, যাকে আমরা ইমাম বলছি সেও কেবলা তো দূরের কথা মসজিদেই নেই। কে যে কোথায় চলে গিয়েছে তারইতো ঠিক ঠিকানা নেই, ছালাত আদায় হবে কি করে! যেহেতু খোদা চেনা হয়নি সেহেতু মুছুল্লি এবং ইমামের এ দশা হয়েছে। আর হাকিকি ছালাত আদায় করতে হলে হাকিকি কাবাও চেনা দরকার। কারণ, হাকিকি ছালাত হাকিকি কাবাতে আদায় করতে হয়। যারা হাকিকি কাবাতে মোতাওয়াজ্জা করেছে তারাই মনের শিরক থেকে মুক্ত হয়েছে বা মুক্ত হওয়ার সাধনা করছে। আর মনের মাঝে খোদা ভিন্ন অন্য যে সুরত এসে উদয় হবে তা-ই হবে খোদার শরিক। জ্ঞানীগণ কাবা দর্শন না করা পর্যন্ত ছালাতের নিয়ত বাঁধেন না।
হযরত ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলাইহি একবার নামাজে দাঁড়িয়ে তেত্রিশবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামাজের নিয়ত বাঁধেন আবার ছেড়ে দেন। চৌত্রিশবারে গিয়ে নিয়ত বেঁধে নামাজ আরম্ভ করেন। নামাজ শেষে মুছুল্লিগণ জিজ্ঞাসা করলো হুজুর এতোবার আপনি নামাজের তাকবির দিলেন কেনো ? তিনি বললেন, দেখো, আমি কাবাকে না দেখা পর্যন্ত নামাজ আরম্ভ করতে পারিনা ! চৌত্রিশবারে গিয়ে কাবা আমার সামনে এলো আর আমি তখনই নামাজের নিয়ত বেঁধে ফেলি। এ কাবাটি কি ছিলো জানা দরকার নয় কি? তবে ইহা মেজাজি কাবা অবশ্যই নয়, ইহা ছিল কাবার হাকিকত বা হাকিকি কাবা। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাগণের জীবন-পদ্ধতি লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে যে, তাঁরা আত্মশুদ্ধির ক্রিয়ায় কতো উচ্চে আরোহণ করেছিলেন। ছালাত এমন একটি কর্ম যা সমস্ত মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য কর্ম। সবাই নয়, অধিকাংশই রাছুলের আদর্শ ধরে রাখতে পারেনি। “সাহেব” হতে সাহাবী মানে আমার আত্মা। রাছুলকে এবং তাঁর আহলে বাইয়্যেতকে যারা প্রাণের চেয়ে বেশী মহব্বত করেছিলেন এবং তাঁর আদর্শকে আমৃত্যু ধারণ করেছিলেন তাঁরাই হলেন সাহাবী। সবাই কলেমা পড়লেও সবাই সাহাবী হতে পারেনি।
পাঁচ বস্তুর গড়া মানুষের মাঝে শয়তান “খান্নাছ” নামে অবস্থান করছে। আগুন বস্তুর গুণ-খাছিয়তই হলো খান্নাছ। সে মানুষের মধ্যে হতেই অসৎ চিন্তা ও কর্মের উৎপত্তি করে মানুষকে অন্যায়, অবৈধ কর্মে লিপ্ত করে রাখে। সেই অন্যায় কাজটি দু’ভাগে বিভক্ত- একটি জাহেরী বা মেজাজি এবং বাতেনী বা হাকিকি। জাহেরী বা মেজাজি অন্যায় কাজটি ইহলোকের আর হাকিকি অন্যায়টি পরলোকের জন্য সাব্যস্ত আছে। হাকিকি অন্যায় বা পাপটি মানব সুরতকে কেয়ামতের করালগ্রাসে নিক্ষেপ করে সিরাতানুসারে সুরত সৃষ্টি করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। খান্নাছ বাহির হতে আলাদা কোনো রূপ ধরে এ সমস্ত করে না। তার উপর বিজয়ী হলেই মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করে, আর স্বাধীন হওয়াই হলো মুসলমানের পরিচয়। এ কথাটি তথাকথিত ধর্মান্ধ গোঁড়ারা বুঝতে পারলে মানুষ ও মানবধর্ম রক্ষা পেতো এবং পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতো। রাছুল করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বলছেন, “সৎ স্বভাবই ইসলাম”। ইহাই পূণ্য, ইহাই ঈমান। তিনি আরো বলেছেন, “কালা রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম ইননামা বুইছতু লিউতাম্মিমা মা কারিমাল আখলাক” অর্থাৎ রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বলছেন ঃ নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি মানুষের উৎকৃষ্ট গুণগুলো ফুটিয়ে তোলার জন্য। আল্লাহর গুণে গুণান্বি^ত হওয়ার কথাও বহুবার বলা হয়েছে কোরানুল কারিমের মাঝে।
“আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়াই দ্বীন-এ-মুহাম্মদী অর্জন করা এবং আল্লাহর দ্বীন অর্জন হলেই মুক্তি নিশ্চিত।”
আল্লাহ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, “ক্বাদ আফলাহা মান যাক্কাহ” অর্থাৎ যে ইহাকে (দীলকে) পরিশুদ্ধ করেছে সে মুক্তি পেয়েছে। এ কথা সার্বজনীন কথা বিধায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম সমস্ত মানবজাতির মুক্তির জন্য এসেছেন বলে প্রমাণিত হয়। সমস্ত মহাপুরুষগণ এ কথাই বিভিন্ন আঙ্গিকে বলছেন। সৎস্বভাব যোগে চৈতন্যাবস্থাই ইসলাম তথা মানবধর্ম, সমস্ত মহাপুরুষগণের ধর্মও ইহাই এবং এ ধর্ম আদি হতেই প্রচলিত আছে এবং থাকবে। ধর্ম আর মানুষকে যারা অভেদ জ্ঞানে না দেখে প্রভেদ জ্ঞানে দেখে তাদের ধর্ম জানোয়ারের ধর্ম। কারণ, মানবাত্মার অধিকারী হওয়াই ধার্মিক হওয়া। আর ধর্ম ধার্মিকে সুরতেই আছে অভেদ অস্থায়। দয়া, মায়া, প্রেম, ভালোবাসা তথা সমস্ত সৎগুণাবলীর সমষ্টিই হলো ইনছানিয়াত যা মানবধর্ম হতে প্রকাশিত। এ ধর্ম দ্বারা মানব জাতিকে এক দৃষ্ট হয়। এ ধর্ম দ্বারা মানব সমাজ ও অন্যান্য জীবের কল্যাণ সাধিত হয় এবং স্রষ্টার সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়। তারাই মহাপুরুষ, যারা আল্লাহর দ্বীন অর্জন করেছে এবং তাকে চিনে তাতে সংলীন হয়ে আছেন। তাদের পথ ও মতকে বিনয়ের সাথে অনুসরণ করাই হলো ধর্মপথ অবলম্বন করা। কোরানে তাদেরকে “আমানু” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ছালাত, সিয়াম করে, মন্ত্র পাঠ করে, জপমালা জপে, নিয়ম মোতাবেক মসজিদ, মন্দির, গির্জায় গিয়ে যারা অন্যের অমঙ্গল কামনা করে তথা অনিষ্টের চিন্তা করে তাদের কোনো ধর্ম নেই। এ ধর্মান্ধ গোঁড়াদের উপাসনা এক প্রকার হঠকারীতা ব্যতীত নয়। এরাই ধর্মকে বিকৃত করে প্রচার করে, চারি দেয়ালে আবদ্ধ করে ফেরকাবাজি, ফতোয়াবাজি করে মানুষ হত্যার ক্ষেত্র তৈরী করে। যারা সত্যিকার ভাবে স্বধর্মে নিষ্ঠ, তাদের উদার বিশ্ব-প্রেম আপন হতেই জেগে উঠে। ধর্মের নামে ছোঁয়া-ছুয়ি, ধোঁয়া-ধূয়ি, নিচ ব্যবহার ইত্যাদি সবই হলো বকধার্মিক আর বিড়াল তপস্বীদের ক্রিয়া-কর্ম। আসলে যে নিজ ধর্মকে সত্য বলে জানে, ভালোবাসে অবশ্যই সে বিশ্বের সকল মানুষকে ভালোবাসে। ধর্মের নামে বেশ-ভূষণের বা বাহিরের যে ঘটাটা তা কেবল অন্তরের দীনতা-হীনতা ঢাকবার ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। আলমে নাছুত হতে বের হতে না পারলে যে সবই বিফল এ কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। যাকে বলি পরম-সত্য, সেই পরম সত্যটি চিরন্তন-শাশ্বত, হাইউল-কাইয়্যুম।