ছালমা আক্তার চিশতী
বুঝতে হবে মুক্তির দরজা একমাত্র গুরুর/রবের করুণা-দয়া (রহিমের) ভিতর রয়েছে, এখানেই তিনি গাফুরুর রহিম। নিজ গুরুকে রেখে পার্থিব স্বার্থ পূরণ করতে গিয়ে গুরুকে ত্যাগ করলে তার দশা হবে কুকুরের ন্যায়। যেমন- কুকুর খাবারের আশায় বিভিন্ন জায়গায় জিহ্বা বের করে দৌড়াদৌড়ি করে থাকে, তাকে কেউ খাবার দেয় আবার কেউ কুকুরটিকে তাড়িয়ে দেয়, তেমনি হয় এই গুরু ত্যাগী লোকদের অবস্থা। এই রূপ অন্ধদের কোন বুঝ জ্ঞান আসে না যে তারা কি ভুল করতেছে। কারণ, তারা হলো বেখবর, তারা হলো তাদের নফসে আম্মারার পূজারী।
পূজা হলো দুই রকমের। একটি হলো নফস মোৎমাইন্নার আর অন্যটি হলো নফসে আম্মারার। কর্ম অনুসারে ফলাফল, কর্ম যদি ভাল হয় তবে ফলাফল ভাল হবে আর কর্ম খারাপ হয় ফলাফল খারাপ হবে। বাজে যুক্তি তর্ক দিয়ে গুরু ভজন হয় না, বরং ঈমানের ক্ষতি হয়। শায়খ সাইয়্যেদ হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) তাঁর ‘আল্ ফাত্হুর রাব্বানী ওয়া আল্ ফায়জুর রাহমানী’ কিতাবের মাঝে বলছেন-“তুমি আমার কথা না শুনিয়া স্বীয় নফস ও কামনা সাথে লইয়া ইবাদত খানায় বসিয়াছ। সর্ব প্রথম প্রয়োজন পীরের সাহচর্য লাভ করা। স্বীয় নফস, কামনা এবং আল্লাহ ব্যতীত সকল কিছু হত্যা করিয়া পীরের দ্বারে চাপিয়া বস।” আর মুরিদ/বায়াত না হয়েই শুধু কারো নামের উপরে গুরু ভজন হলো খাঁটি স্বর্ণের জিনিস রেখে ইমিটেশনের জিনিস নিয়ে বসে থাকা। তারা হলো অন্ধ, অন্ধের কাছে সব কিছুই আলোহীন ঠিক তেমনি অবস্থা এই অচেতন লোকদের। আর এই কর্মগুলো এই অচেতন মানবরূপী জীবেরা করে থাকে। কারণ, তারা মানুষের পোশাক রেখে জীব-জন্তুর পোশাক পরিধান করে আছে মানে এরা উলঙ্গ। যে মেয়ের বিয়েই হয়নি দেশ ভরেই তার শ্বশুর বাড়ি কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বাড়ি দাবী করার সিষ্টেম নেই, তেমনি দশা হলো মুরিদ না হয়েই যারা এজন-সেজনকে পীর দাবী করছে তাদের দশা, স্রোতে ভাসমান কঁচুরী পানার মতো ঘাটে ঘাঠে ভেসে বেড়ায়।
একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে- ‘পাগলও তার নিজের বুঝ বুঝে’। যারা নামের উপরে গুরু ভজন করে তারা পাগলের চেয়েও অধম। একনিষ্ট ভাবে গুরু ভজন করতে হলে মনকে অনুরাগের দরজায় নিতে হবে। গুরুর প্রতি ঈমানের অনুরাগ ছাড়া গুরু ভজন হয় না, অনুরাগ বিনে এই মানব জনমটা বৃথা যাবে। মানুষ কেমন অন্ধকার সাগরের মাঝে পড়ে আছে সে তা দেখতেছে কিন্তু তা বুঝতেছে না। কারণ, বুঝলে আর সে অন্ধকার সাগরের মাঝে থাকবে না। অন্ধকার জগতে যারা অগ্রসর হচ্ছে তারা বুঝবে না তারা যে অন্ধকারে ডুবে আছে। এই অন্ধকারে থাকাটাই হলো অচেতন ভাব আর এই অন্ধকার কেটে আলোর মুখ দেখা হলো চেতন ভাব। যেমনÑএকটি শিশুর দাঁত পরে গেলে সেই দাঁত আবার উঠবে আর একজন বৃদ্ধ লোকের দাঁত পরে গেলে সেই দাঁত আর উঠবে না। এই উপমা থেকে বুঝা যায় গুরুর নিকট শিশুর ন্যায় হয়ে থাকলে সে হোঁচট খেয়ে পরে গেলেও গুরু দয়া করে উঠিয়ে দিবে কিন্তু একজন শিশুর মতো আচরণ করতে না পারলে টেটনামি/পাকনামি করলে তার দশাটি হবে বৃদ্ধের দাঁতের নেয়, টেটনামির জন্য হোচট খাওয়া হলে গুরুর দয়া এই নরাধমের মাঝে পৌছাবে না। কারণ, তাদের কানে, চোখে ও দেলে মোহর মারা থাকবে।
কোরানে সূরা আরাফ ১৯৮ নং আয়াতে আল্লাহ তায়াল নবীকে বলতেছেন- “ওয়া তারাহুম ইয়ানজুরুনা ইলাইকা ওয়াহুম লা ইউবসিরূণ।” অর্থাৎ এবং দেখছেন তারা আপনাকে দেখতেছে অথচ দেখতেছে না। সর্বযুগে আল্লাহতায়ালা হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে এ কথা বলে আসতেছেন। কারণ, কোরানের বাণী হলো চিরবর্তমান। যাদের দিব্য দৃষ্টি খুলে গেছে তারা তা দেখতে পায় এবং কোরানের ভেদ রহস্য উন্মোচন করতে পারে। কোরানের প্রত্যেকটি আয়াত বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় সেখানে গুরুবাদের আলোচনা করা হয়েছে। এক ধরনের পীর আছে দালাল ধরে মুরিদ করে যেমন- হাট বাজারে দালালরা গরু বিক্রি করে ঠিক সেই ভাবে। কিছু কিছু লোক আছে কিছু দিন এই পীরের কাছে আবার কিছু দিন অন্য পীরের কাছে মুরিদ হয়। তাদের এবাদত বন্দেগী হবে না, মূলতঃ তাদের বায়াতই সঠিক নয় এবং তাদের কোনো ঈমান নেই এই সমস্ত কর্ম করে তারা নিজেদেরকে জাহান্নামের উপযুক্ত করে তুলে। কিছু কিছু মহিলা আছে তরিকার দোহাই দিয়ে নানা অপকর্মে নিজেকে লিপ্ত রাখে। তারা দুই দিন পর পর এই পীরের কাছে ঐ পীরের কাছে মুরিদ হয় তাদের অবস্থা সম্পর্কে বা তাদের পরিণতি সম্পর্কে মুন্সিগঞ্জ জেলার গালিমপুরের প্রখ্যাত মরমী সাধক রহিম ফকির সাহেব তাঁর একটি গানের মাঝে বলছেন –
নিকাহ বসিওনা যথা তথা
বেঁচিওনা বেঁচা মাথা,
মাফ হবে না গুনাহ খাতা
সারা জীবন ভরে॥
প্রত্যেকটি সাধকই এইরূপ কথা সর্ব যুগে বলে থাকে বিভিন্ন ভাবে। তাদের কর্ম অনুসারে আখেরে কি হবে তা নির্ধারণ করে রাখতেছে। এই অচেতন লোকদের স্থান হবে সিজ্জিনে। সিজ্জিন হলো ঐ স্থানের নাম যেই স্থানে পাপীদের আত্মা থাকবে। আল্লাহ আর নবীর ভেদ রহস্য জানার জন্য সৌভাগ্য লাগবে। তাঁরই করুণা-দয়া লাগবে। আর সেই সৌভাগ্যটাই হলো গুরুর দয়া। কারণ, তাঁর কৃপা বিনে এই মানব জগতে কিছুই সমাধান হয় না। গুরুর কাছে যাওয়ার পরে তাঁর শিক্ষানুসারে মনের ময়লাগুলোকে পরিস্কার করার জন্য সাধনা করতে হবে। এই সমাজের লোকেরা সাধনা অর্থ কি তারা তা জানে না ? সাধনা করতে হলে অনুরাগের দরজায় দাঁড়াতে হবে।
একজন গুরু ভক্তের সারাটা জীবন প্রমাণ দিতে হয় যে, সে সত্যিকারের ঈমানদার, একজন গুরু ভক্ত। শিষ্য আর ভক্ত এক নয়। ‘শিষ্য’ হলো অনুসারী, যে গুরুর হুকুম-নির্দেশকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করে চলে। আর ‘ভক্ত’ হলো যে মোহমুক্ত হয়েছে, নফস আম্মারার বলয় থেকে বের হয়ে গেছে বা বস্তুবাদ মুক্ত হয়েছে, সে গুরু ভিন্ন অন্য কিছুর ধ্যান-ধারণা তার চিন্তা/মানস জগত হতে উঠে গেছে, জাগতিক জাত-কুলের ব্যাধিমুক্ত হয়েছে। যেমন, কাঁচের মাঝে একটি ডিজাইন করা পেপার লাগানো থাকলে কাঁচের বাহির থেকে ভিতরে কি আছে তা দেখা যাবে না আবার ভিতর থেকে বাহিরে কি আছে তা দেখা যাবে না, তেমন দশা হবে অনুরাগবিহীন লোকেদের। তারা রাসুলের সামনে থেকেও রাসুলকে দেখতে পাবে না। কারণ, তার দীল জুলমাতের পর্দা দ্বারা আবৃত। এই মানব ছুরতটাকে অমর করতে হলে অনুরাগ সাধনায় ডুব দিতে হবে। কোন মানুষ যদি তার নিজ মনের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হয় তবে সে মূল গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। যেমন, একটি ছবির মাঝে একজন মানুষ যেমন স্থির হয়ে থাকে তেমনি হায়ানীয়াত একজন মানুষের ইনসানিয়াতকে স্থির করে/ঢেকে রাখে। ইনসানিয়াতের এই স্থির অবস্থার জাগরণ ঘটাতে হলে মনকে অদৃশ্য সূতার বস্তুবাদের বাঁধন থেকে মুক্ত করতেই হবে। এই সূতার বাধন মানুষের মনকে কঠিন থেকে কঠিন করে রাখে। মনের এই কঠিন অবস্থার জন্য মানুষ তার নিজ মুর্শিদকে ভুলে দুনিয়ার কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারা দুনিয়াটাকে মনে করে বেহেশতের সুখের মতো। কিন্তু ইহা যে ক্ষণস্থায়ী এ চিন্তা তাদের মাথায় আর কাজ করে না, ইহা জাহান্নামী হওয়ার লক্ষণ।
একজন আধ্যাত্মিক জ্ঞানীর বাক্য নিজ অস্তিত্বের মাঝে ধারণ করতে পারলে জাহান্নামের দুর্গম পথ অতিক্রম করা সম্ভব হবে। যেমন, সূর্যের আলো দ্বারা গাছ-পালা খাবার তৈরী করে তেমনি একজন ভক্ত গুরু প্রদত্ত আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আলোকে নিজ ইনসানি আত্মার গুণগুলোর জাগরণ ঘটায়। আমার মুর্শিদ হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশ্তী নিজামী তাঁর আলোচনার মাঝে বলতে থাকে- হযরত জুনায়েদ বোগদাদী (রাঃ) এর এক শিষ্য অনেক দিন ধরে দরবারে আসে না। তাই তিঁনি নিজেই ঐ শিষ্যের বাড়ি গেলেন। শিষ্যকে তিঁনি জিজ্ঞেস করলেন, কতদিন হয় তুমি দরবারে যাও না, কারণ কী? শিষ্যটি বলল হুজুর, আমি এখন প্রতিদিনই বেহেশতে যাই, সে জন্য সময় পাই না। হযরত জুনায়েদ বোগদাদী তার কথা শুনে বিষয়টি বুঝতে পারলেন। হযরত জুনায়েদ বোগদাদী (রাঃ) শিষ্যকে বলল, ঠিক আছে বেহেশতে গিয়ে কিছু খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ্ বলে খাওয়া শুরু করিও। এই কথাটি বলে তিনি দরবারে চলে গেল। শিষ্য প্রতিদিনের মতো বেহেশতে গেল তার সামনে নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার নিয়ে আসল। খাবার যখন সে মুখে দিবে তার গুরুর বাণীটি মনে পরে গেল। যখন সে বিসমিল্লাহ্ বলে খাবার মুখে দিল অমনি সব খাবার চিতাশালের পঁচাগলা মাংসে পরিণত হয়ে গেল ও বেহেশতী হুর-পরীগুলো ভূত-পেত্নী হয়ে গেল। পরের দিন সকাল বেলা তাকে চিতাশালের পাশে একটি জমিতে অচেতন অবস্থায় পাওয়া গেল। এরপর হতে যখনই তার ঐ পচা-গলা মাংসের কথা মনে পরে তখনই সে বমি করতে থাকে। তিন দিন পর শিষ্যটি গুরুর বাড়িতে গেল এবং হযরত জুনায়েদ বোগদাদী (রাঃ)-এর কাছে ক্ষমা চাইলেন। অচেতনদের বেহেশত এমনি হয় তারা দেখবে সেই দেখার মাঝে অনেক অপূর্ণতা থাকবে। কারণ, তাদের বাসিরুনের সাথে গুরুর দেওয়া আলীমুন নেই, মানে এরা অন্ধ-বধির।
গুরুর দেওয়া আলীমুনকে ধারণ করতে পারলে এলমে এলাহীর অধিকারী হওয়া যায়, আর তাতে অন্ধকার কবর আলোকিত হয়ে ‘রঁওজা’ বা জান্নাতের বাগান সৃষ্টি হয়। যারা গুরুর দেওয়া আলীমুনকে ধারণ করতে পারে না তাদের দশা ঠিক এমনি হয় যেমনÑ ডায়াবেটিস রোগ হলে শরীরের সমস্ত অঙ্গ ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। আর মিষ্টি যখন অতিরিক্ত খাওয়া হয় তখন আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা য়ায় না এর ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকে। তেমনি দশা হয় আলীমুনবিহীন লোকেদের। তারা হায়ানীয়াতের মধু (যা মূলতঃ বিষ সমতুল্য) পান করতে গিয়ে অচিরেই মানব সুরতটিকে হারিয়ে ফেলে। যেমন, আমরা সাগরের পারে গিয়ে সূর্য ডুবতে দেখি ঠিক মনে হয় সূর্যটি সাগরের ঐ পাড়ে কিংবা সাগরের মাঝেই ডুবতেছে আসলে এই বিষয়টি কি সঠিক? ঠিক তেমনি যারা পন্ডিত তারা ভাবতে থাকে সে নিজেই একমাত্র শ্রেষ্ট আসলে এই অবস্থানটি যে তার ভুল তার তা বুঝার মতো জ্ঞান নেই, সে নিজ সত্তাকে হারিয়ে ফেলছে। ঐ ব্যক্তিটি এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মাঝে পরে থাকে। তারা এই মায়ার জগতের ভোগ বিলাস করতে করতে নিজ আপন সত্তা থেকে হারিয়ে যায়। ডা. জাহাঙ্গীর আল সুরেশ^রী সূরা বাকারা ১৪৮নং আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন- যে কল্যাণের সাহায্যে মানুষ মরণকে জয় করে নিতে পারে তথা জন্মচক্রের ঘূর্ণায়মান বৃত্ত হতে নিজেকে মুক্ত করতে পারে উহাই আল্লাহ্র দৃষ্টিতে একমাত্র কল্যাণ তথা একমাত্র রহমত। ইহাই আল্লাহ্কে পাবার পথে ধাবিত করে এবং পরিশেষে যাহা পাওয়া উচিত সেই রবরূপী আল্লাহ্র সঙ্গে মিলনে একাকার হয়ে যায়। একজন ভক্তের মূল কর্ম হলো রবরূপী খোদার দীদারের জন্য মনকে প্রস্তুত রাখা। কারণ, খোদা বাস করে একজন মুমিনের অন্তরের মাঝে। যেমন, একটি ডিম লাইট ঘরকে পুরোপুরি আলোকিত করতে পারে না তেমনি গুরুর দেওয়া জ্ঞানের আলো যদি ড্রিম লাইটের মতো কাজে লাগাই তবে আর এই অন্ধকার দেহকে আলোকিত করা যাবে না। একজন মুমিন ব্যক্তির গুণ ধারণ করতে হলে দীলকে এনার্জী লাইটের আলো দিয়ে আলোকিত করতে হবে।