হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
নূর মোহাম্মদী ১৮টি নাম নিয়েও প্রকাশ আছে। যেমন –
০১। আল হাকিকাতুল মোহাম্মদীয়া (মোহাম্মদের মূল সত্তা)
০২। হাকিকাতুল হাকিকত (মূল সত্তার মূল সত্ত্বা)
০৩। রূহে মোহাম্মদী (মোহাম্মদের রূহ)
০৪। আল আকল্ আল আউয়াল (প্রথম প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি)
০৫। আল আরশ (সিংহাসন)
০৬। আল রূহুল আযম (সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি সম্পন্ন)
০৭। আল কালামুল আলা (সর্বশ্রেষ্ঠ কলম)
০৮। আল খলিফা (প্রতিনিধি)
০৯। আল ইনছানুল কামিল (পূর্ণ মানব)
১০। আসলুল আলম (বিশ্বের উৎস)
১১। আদম আল হাকিকি (মূল আদম)
১২। আল বরযোখ (মধ্যস্থতাকারী)
১৩। ফালাকুল হায়া (জীবন স্তর)
১৪। আল হককুল মখলুকুবিহি (সৃষ্টির মূলতত্ত্ব)
১৫। আল হায়ুলা (আদিম জড় উপাদান)
১৬। আল রূহ (আত্মা)
১৭। আল কুতুব (কুতুব)
১৮। আবদ আল জামি (সর্বব্যাপী একের দাস)
এই বিশ্ব সৃষ্টির মূলে নূরে মোহাম্মদী। রাছুল পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলছেন, অর্থাৎ আমি আল্লাহর নূর হতে এবং সমস্ত সৃষ্টি আমার নূর হতে সৃষ্টি। আল্লাহ সৃষ্টির কারণে ‘আহাদ’ বিবর্তনে ‘আহামদ’ নাম ধারণ করে সসীমের দিক নির্দেশনার সূচনা করলেন। আহাদ এবং আহামদের মাঝে একটি ‘মীম’-এর পর্দা যা কেবল নামের বিবর্তনে প্রকাশ। এ ‘মীম’ হরফে মুকাত্তায়াতের অন্তর্ভূক্ত বলে ‘আহামদ’ আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় এবং ইহা নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের প্রেমাষ্পদ হওয়ার একটি নিদর্শন।
‘আহাদ’ নামের তিনটি অক্ষর- আলিফ, হে, দাল। ‘আহাদ’ নাম হতে আলিফ বাদ দিলে হয় ‘হদ’ মানে সীমা বা নির্দিষ্টবৃত্ত – যা সসীমের প্রথম দিক নির্দেশনা সূচক। এ ‘হদ’ বা তাইনে আউয়াল বা প্রথম বৃত্ত বা দায়রা লাতাইনের বা অপ্রকাশিত স্তরের নিন্মে অবস্থিত এবং এ দু’য়ের মাঝে একটি সীমা নির্দেশ করছে, যদিও তা অসাধারণ অবস্থা। ‘আহাদ’ হতে যখন শ্রেষ্ঠতর প্রকাশক ‘আলিফ’ লাতাইনে রয়ে গেল তখন ‘হদ’ শব্দকে সীমানির্দেশ হিসাবে ‘তাইনে আউয়ালে’ রাখা হয়েছে এবং সূক্ষ্ম সীমা ‘হদ’ যে মাখলুক তা ভালোভাবে দেখবার জন্য ‘হে’ অক্ষরের পরে ‘মীম’ রাখা হয়েছে এবং তাকে যিনি প্রকাশ করলেন সেই ‘আহাদের’ ‘আলিফ’ সর্বপ্রথমে সম্মান হিসাবে স্থিত রয়েছে। কাজেই বুঝা যাচ্ছে অসীম আল্লাহপাক মাখলুক তথা ‘মীম’-কে প্রকাশ করে স্বীয় অস্তিত্বকে সীমার মাঝে রূপদান করেছেন নাম ও রূপের বিবর্তনের ধারায়। এ ‘আহামদ’ সসীম সৃষ্টি আল্লাহপাকের বিবর্তন ধারায় প্রকাশ আহাদ, আহামদ ও মোহাম্মদ।
হযরত খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু রচিত ‘রাহাতিল কুলুব’ কিতাবের ২৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, যখন আল্লাহপাক বললেন ‘আল আস্তুবে রাব্বেকুম’ তখন আত্মার হালিয়ত চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়লো।
প্রথম শ্রেণী – এই শ্রেণীতে যারা ছিলেন তারা অন্তর ও মুখ দিয়ে বলছিলেন, ‘বালা’ অর্থাৎ সেজদাবনত হলেন। এরা হলো আম্বিয়া আউলিয়া ও শহীদানগণ।
দ্বিতীয় শ্রেণী – এই শ্রেণীতে যারা ছিলেন তারা অন্তর দিয়ে বললো এবং সেজদা করলো কিন্তু মুখ দিয়ে বললো না। এরা হলো কাফের (আল্লাহকে অস্বীকারকারী) ও অন্যান্য বেদ্বীনদের ঘরে জন্ম নেয় কিন্তু পরবর্তীতে তারা মুসলমান হয়।
তৃতীয় শ্রেণী – এই শ্রেণীতে যারা ছিল তারা মুখে ‘বালা’ বলেছে এবং সেজদা করেছে কিন্তু অন্তর দিয়ে বলেনি। এসব নফসগুলো মুসলমানের ঘরে মুসলমান হয়েই জন্ম নেয় কিন্তু পরে পথভ্রষ্ট ও সর্বশেষে কাফের হয়ে দোযখ ভোগ করবে।
চতুর্থ শ্রেণী – এই শ্রেণীতে যে নফসগুলো ছিল তারা ‘বালা’ না মুখে বলেছে না অন্তরে। এমনকি তারা সেজদাও করেনি। এরা কাফের ও নাস্তিক হয়ে জন্ম নেয় এবং কাফের হয়েই মৃত্যুবরণ করে।
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে আল্লাহপাক নূরে মোহাম্মদীকে সৃষ্টি করে পঞ্চাকারে রেখেছিলেন। এ পঞ্চাকারকে একত্র করে ‘দরক্ত ইয়াকীনের’ গাছ তৈরী করলেন। এই গাছের ছিল চারটি ডাল, পাঁচটি কুড়ি বা কলি, তিরিশটি পাতা। চার ডালে চার তরিকা, পাঁচ কলিতে পাঁচটি ছালাত এবং ত্রিশ পাতায় ত্রিশ রোজা। মূল ডালে নবী ‘হাবিব’ নামে বসা ছিলেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, যখন আল্লাহপাক নূরে মোহাম্মদীকে সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি হয়েই নূর সেজদায় চলে গেলেন। তাতে আল্লাহপাক খুব খুশী হলেন এবং নূর নবীকে বললেন হে নূর, শির তোল। তোমাকে নিয়ে আমার সব ইচ্ছা, আমার সব মতলব তোমাকে নিয়েই আমার সমস্ত কাজ। তোমাকে আমি অপূর্ব সাজে সাজাবো। এই নাও তোমাকে আমি দশটি তোহ্ফা বা উপহার দিলাম।
প্রথম – তোমাকে আমি পূর্ণ ‘বিদ্যার সাগর’ দান করলাম।
দ্বিতীয় – আমি তোমাকে দান করলাম ‘হেলেমের সাগর’। এ সাগরে ঢেইয়ে ঢেউয়ে মুক্তা মানিক বের হয়।
তৃতীয় – আমি তোমাকে দান করলাম ‘প্রেমের সাগর’ এশকে এলাহী,সর্বদাই প্রেমের বন্যা বইতে থাকবে।
চতুর্থ – আমি তোমাকে দান করলাম ‘ভয়ের সাগর’ কেবল মহান আল্লাহর প্রতি ভয় থাকবে।
পঞ্চম – আমি তোমাকে দান করলাম ‘রহমতের সাগর’ যার প্রতি বিন্দু পানিতে রহমতে ভরা।
ষষ্ঠ – আমি তোমাকে দান করলাম ‘দানশীলতার সাগর’ যার ফলে সর্বদাই দেলে সাখাওয়াতির ঢেউ খেলবে।
সপ্তম – আমি তোমাকে দান করলাম ‘শোকরের সাগর’ যার ফলে সর্বদাই শোকর গোজারী করতে থাকবে।
অষ্ঠম – আমি তোমাকে দান করলাম ‘আকলের সাগর’ যার জন্য প্রতি মুহূর্তে আকলে পরিপূর্ণ থাকবে।
নবম – আমি তোমাকে দান করলাম ‘খোদার গর্ব’ যার জন্যে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর গর্বে গর্বিত হবে।
দশম – আমি তোমাকে দান করলাম ‘জামে নূর’।
মুসলীম শরীফে হযরত আলী আলাইহিস্ সালাম হতে বর্ণিত আছে যে, এই বিশ্ব সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহপাক ‘লওহ মাহফুজে’ লিখেছিলেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের নাম ‘খাতামুল আম্বিয়া’ তথা নবীদের সিল্মোহর, আল্লাহপাক সমস্ত নবীদের নফস সৃষ্টি করে তাদের নফস হতে এই মর্মে ওয়াদা নিয়েছিলেন যে, তোমাদের সময়ে যদি আমার হাবিব মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম আসে, তবে তোমরাও তাঁর প্রতি ঈমান আনিও এবং তোমাদের উম্মতগণকেও ঈমান আনতে বলে দিও। হাদিস শরীফে আরো বর্ণিত আছে যে, যখন নূর নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম আলমে আরওয়ায় ছিলেন তখন আল্লাহপাক নবীজির ধড়ে রূহ দিলেন। তখন ঐ রূহ পেশানীতে যেয়ে ঘুরতে লাগল ; ফলে নূর নবীর পেশানী হতে পাঁচ ফোটা নূর ঝরেছিল। তা হতে ‘কানাহ্জার’ একটি শব্দ গঠিত হয়েছিল। এ পাঁচফোটা নূরী অক্ষর হতে প্রকাশ হলো পঞ্চ স্তম্ভ। যথা –
প্রথম হরফ ‘কাফ’ (ك) – এর হতে সৃষ্টি হয় কলেমা।
দ্বিতীয় হরফ ‘নুন’ (ن) – এর হতে সৃষ্টি হয় ছালাত।
তৃতীয় হরফ ‘হে’ (ح) – এর হতে সৃষ্টি হয় হজ্জ্ব।
চতুর্থ হরফ ‘জে’ (ز) – এর হতে সৃষ্টি হয় যাকাত।
পঞ্চম হরফ ‘রে’ (ر) – এর হতে সৃষ্টি হয় সাওম।
উক্ত পঞ্চ বেনা বা স্তম্ভগুলোর মূল হলো মোহাম্মদ, আলী, ফাতেমা, হাসান এবং হুসাইন। এ পঞ্চ স্তম্ভের বেলায়তী এবং নবুয়তী নাম সাব্যস্ত আছে। কোন্ বেনা কোথা হতে কিভাবে সৃষ্টি হলো তা জানা দরকার। তাছাড়া পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে একটি হলো ছালাত। তার মূল পাক পাঞ্জাতন-পাঁচ ছালাত সাব্যস্ত আছে। পাক পাঞ্জাতন সমষ্টি করে বা পাঞ্জেগানা সমষ্টি করে ‘আহসান’ সুরতে খোদা হুয়ায জাহেরু বর্তমান। এ পাঞ্জেগানার সৃষ্টি রহস্য অবগত হলে খোদাকে চেনা যায়। সুতরাং যে ছালাতকে হেফাজত করবে আল্লাহপাক তাকে হেফাজত করবেন (সুরা মুমিনুন-৯)। আর যে ছালাত হেফাজত করবে তারই ছালাত কায়েম হবে বরযোখে কোবরাতে। কোরানে ছালাতকে হেফাজত করার নির্দেশ দান করা হয়েছে এবং দায়েমী ছালাতকে কায়েম করার হুকুম দান করা হয়েছে।