হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
আমার কৃষক চাষী ভাই, চলো মাঠে যাই,
কান্ধে কোঁদাল, লাঙ্গল-জোয়াল, হাল চষীয়া খাই।
ভাইরে ভাই
আমরা স্বাধীন, নই পরাধীন
বাংলার মানুষ ভাই,
আমার মাটি, আমি খাঁটি
মাটিতে সোনা ফলাই।
ভাইরে ভাই
নতুন দিন নতুন ফলন
ফলাই ক্ষেতেতে,
খেয়ে পরে সুখে থাকবো
আমরা এই মাটিতে।
ভাইরে ভাই
খাল কাটিয়া সেচ লাগাইয়া
পানি দেব ক্ষেতে,
সার ছিটাইয়া চাষ করিয়া
দ্বিগুণ পাব তাতে।
ভাইরে ভাই
আনন্দ রাখিয়া বুকে
কাজ করো ভাই সুখে,
চাষী মজুর কামার কুমার
যাহার যে কাজ জুটে।
ভাইরে ভাই
এই মাটিতে আমার জীবন
হীরা কাঞ্চন পরশ রতন,
রজ্জবে কয় অমূল্য ধন
এই মাটিতে পাই।
গ্রাম বাংলার চিত্র উপরের গানের মধ্যে ফুটে উঠেছে। আমাদের বাংলার কৃষকগণ তাদের জমিতে ধান, পাট, মুগ, মুশুরি, সরিষা, মটর, কলাই, গম, যব, কাউন নানা রকম ফসল উৎপাদন করে থাকে। সে ফসল হতে বাংলার কৃষকগণ সারা বছরের খাবার যোগান দেয়। আবার কারো কারো প্রয়োজনে সে সমস্ত ফসল বাজারে বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করে থাকে। আবার উস্তে, পটল, লাউ, কই, ঝিংগা, তরই, সিম, কফি, শালগম, টমেটো, আলু, লালশাক, পুইশাক, কলমিশাক ইত্যাদি নানা রকম সবজি জমিতে উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করে অনেক টাকা রোজগার করে থাকে। বাতাসের দোলা লেগে সুন্দর কঁচি ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলার দৃশ্যটি দেখে কৃষকের মনে অনাবিল আনন্দের বন্যা বইয়ে যায়। সোনালী রঙের পাকা ধানে মাঠ ভরে উঠে, মনে হয় যেন সোনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মাঠে মাঠে। পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে কৃষকের মন পুলকিত হয়ে উঠে।
বিকাল বা রাতে গরু দিয়ে ধান মাড়ার দৃশ্য সত্যিই এক অনাবিল আনন্দ দান করতো। খুব সকালে গরু সাথে লাঙ্গল-জোয়াল কাধে নিয়ে কৃষকগণ জমিতে চাষ করতে চলে যায়, যেন ইহাই বাংলার কৃষকের এক আনন্দময় খেলা। বাড়ি হতে নাস্তা পাঠিয়ে দেয়া হয়, জমিতে বসেই সে নাস্তা খেয়ে নেয়া হয়। গরুর দুধ, ছাগলের দুধ প্রায় সবার ঘরেই পাওয়া যেতো। কথায় বলে, “দুধে ভাতে বাঙালী”। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পূর্ণিমার রাতে নানা ধরনের খেলায় মেতে উঠতো। পুঁথিপাঠের দৃশ্যটিও ভুলবার নয়। গ্রামের আঁকা-বাঁকা কাঁচা মেঠো পথে গ্রামের লোকজনের চলাচল করতে কতোই না আনন্দ উপভোগ করে। সে পথে যান্ত্রিক কোনো যানবাহন নেই, পায়ে হেটে সবাই চলে। সন্ধ্যার পর জারি, সারি, যাত্রা, পালাগান, কবিগান ইত্যাদি গানের সুরে গ্রামের মানুষের মন স্বর্গীয় আনন্দময় পরিবেশ গড়ে উঠে। গ্রামের আঁকা বাঁকা পথে বাউলের একতারার সুর ভেসে উঠতো। গ্রামের মেঠো পথের দু’পাশে গম, যব, কাউন, মটর, সরিষা জমিতে বাতাসের দোলা লেগে তরঙ্গ সৃষ্টি করার দৃশ্যটি ভুলবার নয়। সরিষা ক্ষেতের দৃশ্যটি যেন হলুদ চাদরে আবৃত হয়ে আছে, তার সুন্দর মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণে মন পুলকিত হয়ে উঠতো। এ সমস্ত সরিষা ফুল হতে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে মৌচাকে জমা করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মৌয়ালরা সে মধু আহরণ করে বিক্রি করে থাকে। আরো আনন্দ দান করতো দল বেঁধে জাল, পলো, চাই, কোচ, টেটা, ওছা ইত্যাদি দিয়ে খাল-বিল, পুকুর হতে মাছ ধরার দৃশ্যটি। বড়শী দিয়ে খাল-বিল, পুকুর, ডোবা হতে অনেক মাছ ধরার দৃশ্য মনে পড়ে। প্রায় শুকনো খাল, বিল, পুকুর, ডোবা সেঁচে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মাছ ধরতো কতো আনন্দের সাথে। তাদের সমস্ত শরীরে কাঁদা মেখে সাদা হয়ে যেতো। এক সময় খাল, বিলে প্রচুর দেশী মাছ পাওয়া যেতো। খালের উপর কাঠ, বাঁশের পুল/সাঁকো হতে লাফ দিয়ে পড়ার দৃশ্যটি তাকিয়ে দেখার মতো।
বর্ষার কাজল কালো জলে খালে বিলে, জমিতে শাপলা, কলমী ফুলের দৃশ্য এক মোহনীয় সৌন্দর্য্য দান করতো। নৌকা বা কলাগাছের ভেলা দিয়ে ঐ সমস্ত শাপলা ও কলমী শাক তুলে নেয়ার দৃশ্যগুলো অহরহ মনে পড়ে। নদীতে দক্ষিনা বাতাসের তরঙ্গের কলতানে অনুরণন বেজে উঠতো। পাল তুলে বড় বড় নৌকা নদী পথে চলে যেতো। বর্ষায় ছৈয়াওয়ালা নৌকায় চড়ে বেড়াতে যাবার দৃশ্যটি এখন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ষড়ঋতুর আমাদের এ মাতৃভূমি বাংলায় বিভিন্ন ঋতুতে নানা ফুল-ফলের দৃশ্যটি বিশেষ ভাবে উপভোগ করার মতো। আম, জাম, কাঁঠাল, কুল, পেয়ারা, নারিকেল, কলা, পেঁপে, আতা, সিতা, সফেদা ইত্যাদি নানা রকম ফলের সমাহার এক এক ঋতুতে পাওয়া যায়। শীতে খেজুরের রস এবং তা হতে খেজুরের গুড় পাওয়া যায়। তা দিয়ে নানা রকম পিঠা, ক্ষীর-পায়েশ তৈরী করে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে খাওয়ার দৃশ্য বাংলার ঘরে ঘরে দেখা যায়। গানের মাঝে তারই প্রতিধ্বনি ফুটে উঠেছে। আমাদের বাংলার দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন স্বর্গীয় আভায় আবৃত হয়ে আছে। গ্রামের সহজ সরল মানুষের মন ছিল বন্ধু ভাবাপন্ন। একে অন্যের প্রতি ছিল শ্রদ্ধাশীল, স্নেহ-মায়া মমতায় আবৃত ছিল তাদের মন। মনে হতো সারা গ্রামটিই একটি পরিবার। গাছ পালায় আবৃত গ্রামের দৃশ্য দেখে মনে হতো যেন মায়ার চাদরে জড়িয়ে রেখেছে। তারা নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আনন্দের সাথে উদ্যাপন করতো।
গ্রামের যে চিত্র গানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে তা এখন প্রায় নাই বললেই চলে। মানুষের মনের এ ধরনের অনাবিল আনন্দ কেড়ে নিয়েছে গ্রামের মানুষের মনে যান্ত্রিকতাময় পরিবেশ সৃষ্টির কারণে। নানা রকম গ্রাম্য খেলাধুলা কতোটুকু বর্তমানে দেখা যায় তা মূলতঃ সবারই জানা আছে, প্রায় নাই বললেই চলে। বলতে গেলে এ সমস্ত খেলাধুলার কথা মনে হলে স্বপ্নের মতোই মনে হয়। মনে পড়ে নানা রকম খেলাধুলা সেই আনন্দঘন পরিবেশের কথা, কতো সুন্দর ছিল সেই সময়গুলো। বাউল আব্দুল করিমের গানটি মনে পড়ে। তিনি বলছেন, “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।” এর মানে এখন আর সেই অনাবিল আনন্দঘন সুন্দর পরিবেশ নেই। মানুষের সাথে মানুষের প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব বন্ধন, এ বাড়ি আর ও বাড়ি ঘুরে গল্প করে সময় কাটানো, নানা রকম মুড়ি, পিঠা, পায়েশ খেয়ে গল্প করা ইত্যাদি সবই স্বপ্নের রাজ্যে চলে গেছে। গ্রামে এ ধরনের চিত্র আর খুব একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে জারি, সারি, মুর্শিদী, ভাটিয়ালী, কবিগান, পালাগান, গাজীগান, গ্রাম্য যাত্রা ইত্যাদি ছিল এ বাংলার মানুষের সংস্কৃতির মূল, মনের আনন্দের মূল উৎস। আজ হতে (২০২১ই) ৩০/৩৫ বৎসর পূর্বেও এ দেশের শহরে, গ্রামে হাজার হাজার কবিগান, পালাগানের আসর বসতো, বিশেষ করে পীর-মুর্শিদ বা অলীদের ওরশের মধ্যে। নানা রকম পশরা নিয়ে মেলার আয়োজন হতো শান্তিপূর্ণ পরিবেশে।
কতো আনন্দময় পরিবেশ ছিল তখন। অলীদের মাজার এ ওরশের সময় মেলা বসবার দৃশ্য এখনো রয়েছে, তবে আগের মতো পরিচ্ছন্ন নয়। তাতে কেউ কোনো প্রকার বাঁধার সৃষ্টিও করতো না। বিশেষ করে কওমী-খারেজি মাদ্রাসার জঙ্গি মৌলবীদের অন্ধ-গোঁড়া কুশিক্ষার ফতোয়াবাজি, জোর-জুলুম, মাজারের বিরোধীতা, ওরশের বিরোধীতা, গান বাজনার বিরোধীতা, বাধা দেয়া, মারামারি, মানুষ হত্যা ইত্যাদি তখনো তেমন ছিল না। তখনও এগুলো মহামারির মতো ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করেনি বিধায় মানুষের মনে এক অনাবিল শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল, নির্মল আনন্দের মাধ্যমে এ সমস্ত অনুষ্ঠানগুলো পরিচালিত হতো।